বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫ ।। ৫ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ২৩ জিলহজ ১৪৪৬

শিরোনাম :
‘পিআর পদ্ধতির নির্বাচন ও দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া দেশের জন্য কল্যাণকর’ ইসরায়েলে ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান ভোলায় আব্দুল জব্বার কলেজ ছাত্র শিবিরের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন  আগ্রাসী ইসরায়েলকে রুখে দেওয়ার আহ্বান ছারছীনা পীরের ‘আমরা এসেছি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ও মানবাধিকার রক্ষার জন্যে’ ‘সম্ভাব্য যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তুরস্ক উন্নত সমাজ গঠনে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ জ্ঞানচর্চা: উপদেষ্টা আসিফ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদে একমত রাজনৈতিক দলগুলো খামেনিকে হত্যা করা হবে, প্রকাশ্য ঘোষণা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আইআরজিসির স্থলবাহিনীর নতুন কমান্ডার মোহাম্মদ কারামি

বিশ্বে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি আর চলতে দেওয়া যায় না

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।হামিদ মীর।।

যদি কারো মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি থেকে থাকে, তা এখন দূর হয়ে যাওয়া উচিত। ১৩ জুন ইসরায়েল যখন ইরানের ওপর হামলা চালায়, তখন তার পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি—এই ইস্রায়েলি হামলায় তার সমর্থন ছিল না—সেটা কেবল একটি বিভ্রাট ছিল।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ধারণা ছিল যে, কয়েক দিনের মধ্যেই তারা ইরানের সামরিক নেতৃত্বকে নিপাতিত করে দেবে এবং ইরানের জনগণ সড়কে নেমে সরকারের পতন ঘটাবে। নেতানিয়াহু তার শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সাহায্যে ইরানের সামরিক কমান্ড ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের সহজেই নিভিয়ে দেন, তবে তার রাজনৈতিক অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়।

ইরানের জনগণ অবশ্যই রাস্তায় নেমেছে, তবে তারা স্লোগান তুলেছে- ‘মরগ বর ইসরায়েল’— অর্থাৎ, ‘ইস্রায়েলের মৃত্যু চাই।’ ইরান শুধু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ দেখায়নি, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ‘অজেয়তা’ ভেঙে দিয়েছে। এবং যখন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তেল আবিবে আছড়ে পড়ে, তখন বিভিন্ন মুসলিম দেশ ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে যায়, আর ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়ে যান।

ট্রাম্প কানাডায় চলমান জি‑৭ সম্মেলন ত্যাগ করে হঠাৎ ওয়াশিংটনে ফিরে আসেন এবং ইরানকে হুমকিপূর্ণ সমালোচনামূলক বক্তব্য দিতে শুরু করেন—যা তার শান্তিপন্থী ভাবমূর্তিকে ভেঙে দিয়েছিল। সত্যি বলতে, ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা খামেনিকে হুমকি দিয়ে ‘নির্দিষ্ট ছাড়’ দাবি করে ট্রাম্প নিজেই এই যুদ্ধে প্রবেশ করেছেন।

অন্যদিকে, চীন তাঁর বক্তব্যকে ‘যুদ্ধের আগুনে আরও তেল ঢালা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আবার, ইউএস কংগ্রেসের বহু সদস্য তার আগ্রাসী বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ যুদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নয়—তা কংগ্রেসের হাতে রয়েছে।

প্রকৃত সত্য হলো: আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জনপ্রিয় নন, তবে অধিকাংশ পশ্চিমা সরকার তার পাশে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের পর, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আইন যেন হাস্যকর এক পর্যায়ে পড়েছে। গাজায় ৫৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, নেতা নেতানিয়াহু জাতিসংঘের শান্তি প্রস্তাবগুলো অহংকারভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বর্তমানে ইসরায়েল শুধু ইরানের বিরুদ্ধে নয়, জাতিসংঘকেও চ্যালেঞ্জ করছে।

মনে রাখবেন—জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সেই ১৮১ নম্বর প্রস্তাবই ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ছিল। আজ ইসরায়েলই জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে! কল্পনা করুন, যদি জাতিসংঘ পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যায়, তাহলে বিশ্বের চলার পথ কী হবে?

বর্তমানে বিশ্বে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি কার্যকর— শক্তিধারীর কাছে তাই সর্বস্ব হয়ে যায়। বিশ্বের দুর্বল দেশগুলোকে আর কোনো বিভ্রাটে থাকা উচিত নয়। ইসরায়েল যে পথে যাচ্ছে, তা হলো— ‘জাতীয়তাবাদী হিংসার শাসননীতি’। এই নীতি জাতিসংঘের সংবিধানের পরিপন্থী, তাই রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে এসে জাতিসংঘকে রক্ষা করতে হবে। না হলে, বিশ্বের প্রতিটি অংশে হিংস্র একশাসনের সূচনা হবে—যেমনটি ইসরায়েল প্রবর্তন করেছে।

জাতিসংঘকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হলো: যারা ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে বিরোধী, তারা একত্রিত হয়ে সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব আনবে—‘ইসরায়েলকে সেই ১৮১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও যেহেতু তা মেনে চলছে না, তাই এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হোক।’

প্রশ্ন উঠতে পারে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কি প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে পারে? উত্তর হলো- পারে। এর আগেও এরকম হয়েছে। ১০ নভেম্বর ১৯৭৫-এ সাধারণ পরিষদের ৩৩৭৯ নম্বর প্রস্তাব জায়নিজমকে ‘বর্ণবাদের একটি প্রকার’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। সেই সময় ৭২টি দেশ সমর্থন করেছিল, ৩৫টি বিরোধিতা করেছিল, আর ৩২টি ভোট দেয়নি। ১৯৭৩ সালে ৩১৫১ নম্বর প্রস্তাবে বর্ণবাদের নিন্দাও করা হয়েছে।

১৯৯১ সালে মাদ্রিদে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি নেতাদের আলোচনার প্রচেষ্টা শুরু হলে ইসরায়েল দাবি করেছিল—প্রস্তাব ৩৩৭৯ প্রত্যাহার করতে হবে। সাধারণ পরিষদ সেটি প্রত্যাহার করে, আর তারপর মাদ্রিদে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দল ইসরায়েলের সঙ্গে বৈঠক করে (যেখানে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়ার প্রতিনিধি ছিলেন)। এই সফলতার পর অসলো আলোচনাও শুরু হয় এবং একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পথ খুলে।

তবে তখনও ১৮১ নম্বর প্রস্তাবে নির্ধারিত কিছু অঞ্চল—যেগুলো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা—তা এখনো ইস্রায়েলের দখলে। এবং ১৮১ অনুযায়ী আল আকসা মসজিদের নিয়ন্ত্রণ ভার যে জাতিসংঘের হাতে—তাও বাস্তবে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে আছে।

যদি ৩৩৭৯ নম্বর প্রস্তাব প্রত্যাহার হতে পারে, তাহলে কেন ১৮১ নম্বর না? ২৪ অক্টোবর ১৯৪৭-এ ১৮১ নম্বর প্রস্তাব পাস করার সময় জাতিসংঘের মেম্বার ছিল মাত্র ৫৬টি, যার ৩৩টি দেশ সমর্থন, ১৩টি বিরোধিতা, আর ১০টি অনুপস্থিত ছিল। আজ মেম্বার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৯৩। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের এক বড় অংশ মনে করেন—১৮১ সংবিধানের পরিপন্থী, তাই এটা প্রত্যাহার করে নতুন আলোচনার দরকার।

মনে রাখবেন, সেই সময়ের পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৮১ নম্বর প্রশ্নে বিরোধিতা করেছিলেন এবং ৮ ডিসেম্বর ১৯৪৭ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে লেখা একটি চিঠিতে ১৮১'কে জাতিসংঘ সংবিধানের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। ১৮১ স্পষ্টভাবে বলে—‘জেরুসালেম হবে না ইসরায়েলের, না ফিলিস্তিনের—আমাদের দাবি এটি হবে জাতিসংঘের অধীনে।’

কিন্তু ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল জেরুসালেম ও আল আকসা দখল করেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ২২ নভেম্বর ১৯৬৭-এ ২৪২ নম্বর প্রস্তাবে ইসরায়েলকে দখল ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা মেনে নেয়নি। ২০১৮ সালের ১৪ মে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার শাসনকালে নতুন মার্কিন দূতাবাসকে জেরুসালেমে স্থানান্তর করেন, ১৮১ সংখ্যার মূল উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণ ন্যস্ত করে।

আমাদের ট্রাম্পের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে অবশ্যই শুধু পাকিস্তান–ভারত সংঘর্ষের আলোকে না দেখে বরং এটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করা দরকার। কার্যকর জাতিসংঘ ছাড়া—ফিলিস্তিন বা কাশ্মীর—দুটি ক্ষেত্রেই সমাধান আনা সম্ভব নয়। ১৮১নং প্রস্তাবের প্রত্যাহার এখন সময়ের জরুরি দাবি। যখন ওআইসি এই উদ্যোগ নেবে, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশও সমর্থন দেবে। তখন বিশ্ব থেকে এই ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি শেষ হয়ে যাবে।

[হামিদ মীর পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক। উর্দু দৈনিক জং থেকে লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা]

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ