শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩২ ।। ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
শেষ হলো ইফার পক্ষকালব্যাপী সিরাতুন্নবী (সা.) অনুষ্ঠানমালা সুদানে মসজিদে ড্রোন হামলায় প্রাণ গেল ৭৫ জনের রপ্তানি সত্ত্বেও ভারতে পাচার হচ্ছে চাঁদপুরের ইলিশ দেশের মানুষ আর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে চায় না: পীর সাহেব চরমোনাই বকেয়া বেতনের দাবিতে ভালুকায় শ্রমিকদের মহাসড়ক অবরোধ শিশু-কিশোর সংগঠন 'অংকুর' এর সীরাতুন্নবী সা. কুইজ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত জুলাই সনদের ভিত্তিতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই - খুলনা ইসলামী আন্দোলন  কাতারের মধ্যস্থতায় আফগানিস্তানে কারাবন্দি ব্রিটিশ দম্পতির মুক্তি মাদকের বিরুদ্ধে মুরাদনগরে ওলামা পরিষদের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ পাকিস্তানে পৃথক বিস্ফোরণে নিহত অন্তত ১১

জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও কলমের আলোকিত সাধক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| সাখাওয়াত রাহাত ||

মানবসমাজে কিছু মানুষ যেন জন্মগ্রহণ করেন একটি কালোত্তীর্ণ বার্তা নিয়ে। তাঁরা হন একাধারে আলোর দিশারী, চেতনার বাতিঘর এবং কর্মে-চিন্তায় অনন্য পথপ্রদর্শক। আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. ছিলেন তেমনই একজন ক্ষণজন্মা মনীষী। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন তিলোত্তমা এক কাহিনী—যেখানে জ্ঞান, সাধনা, সাহিত্য, সমাজচিন্তা ও আধ্যাত্মিকতা প্রবাহিত হয়েছে একই ধারায়।

জন্ম ও শৈশব: প্রত্যাশার আলোয় আবির্ভাব

১৯৫৭ সালের ৫ জুন মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানার হোগলাকান্দি গ্রামে তাঁর জন্ম। দীর্ঘ ১৮ বছরের প্রার্থনাপূর্ণ নিঃসন্তান জীবনের অবসানে পিতা আব্দুস সালাম সিকদার ও মাতা সাকিনা বেগমের কোলজুড়ে আশীর্বাদ হয়ে আসে এই সন্তান। শিশুটির জন্ম তাদের মনে ফিরিয়ে আনে পবিত্র গ্রন্থের সেই স্নিগ্ধ স্মৃতি—হজরত ইবরাহিম ও সারা আ. এর জীবনের শুভসংবাদ। তাই কৃতজ্ঞ চিত্তে ও ঈমানি আবেগে তার নাম রাখা হয়—'ইসহাক'।
শৈশবেই তার অন্তরে দোলা দেয় ধর্মীয় জ্ঞানলাভের গভীর আকাঙ্ক্ষা। হোগলাকান্দি জামে মসজিদ মাদরাসায় অল্পসময়েই সম্পন্ন করেন কুরআনের হিফজ। শিশুমনে তখনই গেঁথে যায় কুরআনের আলো। হৃদয়ে জমে ওঠে ধর্মীয় স্পর্শ।

শিক্ষা জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রা

তরুণ ইসহাকের শিক্ষাগ্রহণ ছিল এক ধ্যানমগ্ন অভিযান। নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ এবং ঢাকার জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদরাসায় প্রাথমিক জামাতগুলো সম্পন্ন করেন। এরপর দারসে নিজামির উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম, ফরিদাবাদ মাদরাসায়। সেখানে কাফিয়া, শরহে জামি, শরহে বেকায়া, হেদায়া এবং জালালাইন জামাত অতিক্রম করেন প্রখর মেধা ও মননের জোরে।
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় ‘শরহে বেকায়া’ জামাতে তিনি অর্জন করেন পুরোদেশের মধ্যে ২য় স্থান। ১৯৮৩ সালে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন ঢাকার জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ মাদরাসা থেকে। সারাদেশের মেধা তালিকায় স্থান পান ৩য়। প্রতিটি ধাপে তিনি প্রমাণ করেন—জ্ঞানার্জন শুধু তাঁর কর্তব্য নয়, বরং তাঁর ভালোবাসা।

শিক্ষকতা ও মাদরাসা উন্নয়নে অসামান্য অবদান

শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন কুমিল্লার জামিয়া আরাবিয়া কাসেমুল উলুম মাদরাসায়। তখন সেই প্রতিষ্ঠানটি ছিল মাত্র কাফিয়া জামাত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। তাঁর আগমনে এক নতুন সূর্যোদয় ঘটে। এক বছরের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে দাওরায়ে হাদীস পর্যায়ে উন্নীত করেন। এর মধ্য দিয়ে তার সংগঠকসুলভ দূরদর্শিতা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও শিক্ষাগত প্রজ্ঞার দ্যুতি প্রকাশ পায়।

পরবর্তীতে তিনি নিজ এলাকার রওযাতুল উলূম কাউনিয়াকান্দি, পীরজঙ্গি মাদরাসা, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, মিফতাহুল উলূম মধ্যবাড্ডা, দেওভোগ এবং চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় খেদমত করেন। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষক, শায়খুল হাদীস ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর হাতে গড়ে ওঠে বহু গুণী আলেম, যাঁরা আজ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত।

তিনি কিছুদিন ঢাকার শাহজাহানপুরের বিখ্যাত ঝিল মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন চৌধুরীপাড়া নূর মসজিদের খতিব। তাঁর বয়ান ছিল অন্তর্ভেদী। ভাষা ছিল হৃদয়গ্রাহী। চিন্তা ছিল সময়ের প্রেক্ষিতে পরিপক্ব ও সুগভীর।

সাহিত্যচর্চা: কলমের মাধ্যমে চিন্তার জ্যোতিষ্ক

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। কাফিয়া জামাতেই তিনি উপলব্ধি করেন—বাংলা ভাষায় দ্বীনি জ্ঞানের ঘাটতি ও আলেমসমাজের সাহিত্যিক পশ্চাদপদতা। সে অভাব পূরণে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন। ফলত, সত্তরের অধিক গ্রন্থের রচয়িতা, অনুবাদক ও সম্পাদক হিসেবে বাংলা ইসলামি সাহিত্যে তাঁর অবস্থান হয়ে ওঠে শিখরস্পর্শী।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন
২. ইসলামী রাষ্ট্র ও রাজনীতি
৩. ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা
৪. বাতিল যুগে যুগে
৫. উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র 
৬. ইসমতে আম্বিয়া (উর্দু)
৭. নবীপ্রেমের অমর কাহিনী
৮. সুদ: একটি অর্থনৈতিক অভিশাপ
৯. জীবন গঠনে কুরআনের অবদান
১০. কওমী মাদরাসা কী ও কেন?
১১. সিনেমার কুফল ইত্যাদি।

এসব গ্রন্থে তিনি প্রথাগত ধর্মীয় চিন্তার পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামি ভাবধারাকে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর লেখায় ছিল পরিশীলিত যুক্তিবাদ, সাহিত্যিক সৌন্দর্য এবং চিন্তার স্বচ্ছতা। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লেখক, গবেষক ও সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন, যা তার জ্ঞান ও চিন্তার পরিসরকে আরও সম্প্রসারিত করেছে।

সাংগঠনিক জীবন ও আধ্যাত্মিক সাধনা

তাঁর জীবন ছিল সংগঠন-নির্মাণেরও এক অবিচল নিদর্শন। শিক্ষাজীবনেই গঠন করেন 'ইসলামী ছাত্র ঐক্য পরিষদ' নামের সংগঠন। পরবর্তীতে 'লাজনাতুত তলাবা' নামে সাহিত্য সংগঠনেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ছিলেন সেবামূলক সংগঠন 'ইসলাহুল মুসলিমীন'-এর যুগ্ম-মহাসচিব। নিজ এলাকার আলেমদের নিয়ে গঠন করেন 'হেফাজতে মুসলিমীন পরিষদ'। খেলাফত আন্দোলনের কুমিল্লা জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহকারী সম্পাদকের পদ, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব পদ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব—সবখানে তিনি ছিলেন সংগ্রামী, দৃঢ় ও প্রজ্ঞাবান।

তিনি ছিলেন আসআদ মাদানী রহ. এর হাতে বাইআতপ্রাপ্ত ও পরবর্তীতে জমিরুদ্দিন নানুপুরি রহ. এর খেলাফতপ্রাপ্ত একজন আধ্যাত্মিক সাধক। 'ইহসান: আত্মশুদ্ধি ও তাসাউফ’ বইটি তাঁর চিন্তাচর্চা গভীর ও অন্তর্দর্শিতায় পূর্ণ। তাঁর সর্বশেষ রচিত এই বইটি সেই আত্মসন্ধানেরই এক মূল্যবান দলিল।

বিদায়: এক প্রজ্ঞাবান হৃদয়ের নিঃশব্দ প্রস্থান

২০০৫ সালের ৫ জুন। তাঁর পীরের নামে উৎসর্গিত সেই আত্মশুদ্ধির বইটি পৌঁছে দিতে চট্টগ্রামের নানুপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু যাওয়ার পথে কুমিল্লায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর জীবন যেন একটি পূর্ণচন্দ্রের মতো—আকাশভরা আলো ছড়িয়ে চুপিসারে অন্তরালে মিলিয়ে যাওয়া।

তিনি সমাহিত হন তাঁর এলাকার কাউনিয়াকান্দির ‘বাগে জান্নাত’ মসজিদের পাশে নিজ টাকায় কেনা সমাধিতে—যেখানে তাঁর রুহের সঙ্গী আজো কুরআনের প্রতিধ্বনি, হাদীসের মর্মবাণী।

শেষকথা 

আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. ছিলেন তাঁর সময়ের এক বিরল মনীষা—যিনি একাধারে আলেম, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সংগঠক ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবন ছিল নিঃস্বার্থ খেদমতের প্রতিচ্ছবি। তাঁর কলম ছিল ন্যায় ও হকের কণ্ঠস্বর। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর চিন্তা, শিক্ষা ও সাহিত্য আজো আমাদের আলোকিত করে চলেছে। এমন মানুষ মৃত্যুতে মুছে যান না—তাঁরা রয়ে যান প্রজন্মের হৃদয়ে। ইতিহাসের পাতায়। আলোর স্মারকে।
রহিমাহুল্লাহু রহমাতান ওয়াসিয়াহ...

লেখক: কবি, গ্রন্থকার ও লেখক

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ