শনিবার, ২১ জুন ২০২৫ ।। ৭ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ২৫ জিলহজ ১৪৪৬

শিরোনাম :
ইসরায়েলি হামলায় ইরানের আরও এক পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত ইরানকে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা দেবে রাশিয়া: পুতিন খেলাফত মজলিসের রংপুর বিভাগীয় তরবিয়তি সভা উত্তরসূরিদের নাম ঘোষণা করলেন খামেনি ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনালাপে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইরানের ড্রোন হামলা, ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে বিস্ময় সৃষ্টি আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় ইসলামি শক্তির ঐক্য অপরিহার্য: ইবনে শাইখুল হাদিস পৃথিবীর শান্তি ও মানবতা ধ্বংস করছে ইসরায়েল, পতন অনিবার্য: হেফাজত  যে মাওলানার কাছে ভরাডুবি হয়েছিল সেই ফজলুর রহমানের হল না ছাড়ার সিদ্ধান্ত ঢামেক শিক্ষার্থীদের, আন্দোলন চলবে

স্মৃতির ভিড়ে নানার মুখ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মাহমুদ মুজিব || 

১৮ জুন ২০২২। সেদিন আমার পরমপ্রিয় নানা মাওলানা আবদুল হালিম বোখারীকে সিএসসিআর হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। আইসিউতে গিয়ে নানাকে সালাম জানালাম। আর বললাম- ‘পুরো দেশে আপনার জন্য দুআ হচ্ছে। আপনি সুস্থ হয়ে ওঠবেন।’ সাহস দেয়ায় নানা বড় আওয়াজে তিনবার আলহামদুলিল্লাহ বললেন।

সেসময় আমার আব্বু-আম্মু আমেরিকা থাকায় তাদেরও খোঁজখবর নিলেন। আর বললেন- ‘যওক সাহেব হুজুরকে সালাম জানাবে, দুআ করতে বলবে।’ পরদিন সকালে আমেরিকা থেকে আম্মুর কল। আমি আবার কেন হসপিটালে গেলাম না— তাই বকাঝকা করলেন। তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেলাম। পরে মিলিয়ে দেখলাম, আম্মুর চটপট করার টাইমিং আর নানার ইন্তেকালের সময়— একদম সামঞ্জস্যপূর্ণ। হসপিটালের চতুর্দিকে নানার শুভাকাঙ্ক্ষী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মুহতামিমদের আনাগোনা। যদিও তখনো  জামেয়া পটিয়ার দায়িত্বশীল পর্যায়ের কোনো শিক্ষক হসপিটাল এরিয়ায় দেখা যায়নি, একজনও নন। এ ভেবে হতবাক হলাম যে, যাদের তিনি প্রতিটি কাজ এক-এক করে কলম-কাগজে শিখিয়েছেন, সে ব্যক্তিবর্গও তাঁর শেষ সময়টায় দেখতে আসার প্রয়োজন অনুভব করেননি। অথচ তিনি আইসিইউ বেড থেকেও জামেয়া পটিয়ার নানান বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিচ্ছিলেন। অনেক দায়িত্বশীলদের এটা ও ওটা হুকুম করছিলেন।

সবার দৃষ্টি আইসিইউর সে দরজা আর দায়িত্বরত লোকটির প্রতি। না জানি কখন কোন সংবাদ নিয়ে আসেন। মামাদের চেহারায় মলিন আর চাপাকান্না দেখে আমিও ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছি। একটু পরপর দায়িত্বরত ডাক্তার ডাকছেন, সেজো মামা মাওলানা মানজার হালিমকে। তিনি আসা-যাওয়াতেই ছিলেন। প্রতিবারই তিনি বের হন— মুখ অন্ধকার করে আর কান্না কান্না ভাব নিয়ে। একপর্যায়ে তিনি বলে ওঠলেন, ‘আর নেই...’।

এ শব্দটি সেসময় আমাদের হৃদয়-ভূমিতে বজ্রপাতের মতো আঘাত হেনেছে। বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছিলাম না। তবুও মেনে নেওয়া ছাড়া তো কোনো উপায়ও নেই।  রিলিজ নেওয়ার আগমুহূর্তে জানা গেলো— চট্টগ্রামের এক শিল্পপতি বিল বাবদ টাকা পাঠিয়েছেন, চট্টগ্রামের একটি মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম মারফতে।  কিন্তু মামারা তাতে সম্মতি দেননি। হসপিটালের বিল পরিশোধ করে অ্যাম্বুলেন্সে করে নানাকে মাদরাসায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। পাশে বসে নানাকে দেখে মনে হচ্ছিল, নানা বোধহয় ঘুমিয়ে আছেন অথবা কোথাও বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে মিটিমিটি হাসছেন।

আমরা পটিয়া মাদরাসার কাছাকাছি পৌঁছলাম। এখনো ভেতরে প্রবেশ করিনি, ডাকবাংলোর সেই গেইটও আসেনি।  কক্সবাজার মহাসড়কে ওপর দেখা মিলল— হাজার হাজার ছাত্র সারি সারি করে তাদের প্রিয় মানুষটিকে বরণ করে নিতে দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থা দেখে আমি নিজের অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম। নিজের কান্না দেখে নিজের কাছেই খুব অবাক লাগল। হয়ত আমি কখনো এভাবে কাঁদিনি।

২.
নানার চলে যাওয়াটা আকস্মিক ছিল না। তিনি অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থতার খবরে চতুর্দিকে উদ্বেগ ও শংকা বেঁধে ছিল। তারপরও তাঁর চলে যাওয়ার ঘটনা অনেক বড় রকম বেদনা ও শূন্যতার কারণ হয়েছে। তাঁর ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমৃদ্ধ যুগটিরও যেন সমাপ্তি ঘটে গিয়েছে।  তিনি ছিলেন বহু কাজের কাজি। ছিলেন কর্মমুখর এক মনীষী। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহু দেশেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু ইতিবাচক মনীষার সমন্বয়ক ছিলেন।  তিনি ছিলেন যুগসচেতন আলিম,  বক্তা, ওয়ায়েজ। অন্য দশজন ওয়ায়েজের মতো তিনি ওয়াজ করতেন না। ওয়ায়েজদের মতো সুরেলা কথা কিংবা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের গর্জন ছিলোনা।  তাঁর ওয়াজ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের ছিলো। সম্পূর্ণ নিজস্ব ও স্বতন্ত্র শৈলীতে পাঠদান করতেন তিনি। তিনি ছিলেন বহু মনীষীর পৃষ্ঠপোষক ও পড়ন্ত বেলায় জাতির এক দায়িত্ববান ও দরদি অভিভাবক। তিনি হায়াত পেয়েছিলেন ৭৭ বছর। তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে। ইন্তেকাল ২০২২-এর ২১ জুন।

৩.
নানার বহুমুখী গুণাবলির মাঝে এটিও ছিল যে, যতোই বিপদ-আপদের ঘূর্ণিঝড় তার উপর দিয়ে বয়ে যাক— তিনি সদা হাসি-খুশি ও চিন্তামুক্ত থাকতেন। মুতালাআ বা কাজের সময় কম কথা বলতেন। দেখা যেত— এর মধ্যেই কেউ কেউ দেখা করতে আসতেন। দেশের ভেতর বা বাইরের। প্রবীণ-নবীন, আলেম-সাধারণ, শিক্ষিত-মুর্খ, প্রশাসনিক-প্রাতিষ্ঠানিক, সরকারী দল ও বিরোধী দল। বিচিত্র রুচির ও বয়সের। নানান চিন্তার ও পেরেশানির। কিন্তু তিনি মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনতেন। হিম্মত আফযায়ী করতেন। সান্ত্বনা ও অভয় দিতেন। আবার পরের মুহূর্তেই কাজে ডুবে যেতেন।

৪.
নানা কারো কথা, ভক্তি ও তোষামোদে প্রতারিত বা প্ররোচিত হননি। ঘরের কথা যেমন বাহিরে বলে বেড়াতেননা। মাদরাসা বা বোর্ড সংক্রান্ত  বিষয়গুলোও কখনো ঘরে আলোচনা করতেননা।  কখনো কেউ কৌশলে জানতে চেয়ে থাকলে তিনিও কৌশলে এড়িয়ে যেতেন। 

তাঁর মোবাইল,  ফাইল, চাবি সদা নিজের কন্ট্রোলেই রেখেছেন। এককথায় খাদেম বা সাহেবজাদা নির্ভর ছিলেননা তিনি। তেমনি কারো কানপড়া বা কানকথায় তাঁর বিশেষ আকর্ষণও ছিলো না। 

৫. 
তিনি অত্যন্ত সিরিয়াস, সচেতন এবং রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চলে মাহফিলে গেলে আনন্দ-রসিকতা করে তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। বক্তব্য দিতেন অত্যন্ত ধীরে ধীরে, তবে দৃঢ় ও সুগঠিত ভাষায়। বিষয় ও শব্দের দ্যোতনায় উপভোগ্য হয়ে উঠত তাঁর কথা ও স্বর।

ঘরোয়া আলাপের সময় মিটিমিটি হেসে কথা বলতেন। ছোটরা তাঁকে পেলে বেশ হৈচৈ ও আনন্দে মেতে উঠত। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যস্ততা স্বত্তেও নাতি-নাতনিদের সাথে উপকারী-ইলমি ও আমলি গল্পে মেতে ওঠতেন। নাতি ও নাতনিদের সবাইকে পরীক্ষামূলক প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন। পরক্ষণেই তার উত্তর জানিয়ে দিতেন। 

৬.
মমতা, আবেগ, রাগ, স্নেহ, পৃষ্ঠপোষকতা, কাছে টেনে নেওয়া, আগলে রাখা ও হিম্মতদান এবং অভিভাবকসুলভ আচরণ— সবই ছিল তাঁর মাঝে। যে কারো ব্যক্তিগত যোগাযোগকেও তিনি গুরুত্ব দিতেন। কওমি অঙ্গনের তত্বাবধানের পাশাপাশি ইসলামী অঙ্গনের সংগঠন ও রাজনৈতিক তৎপরতার পরিণতিহীনতায় তিনি আক্ষেপ করতেন। ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষীদের যে কোনো অপতৎপরতার জবাব দেওয়ার জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজতেন এবং কৌশলী সমাধানও বের করে আনতেন।

তাঁর ধৈর্য্যশীলতায় সবাই বেশি অবাক হতেন। পটিয়ার মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া হাফিজাহুল্লাহ প্রায়ই একথা বলতেন, ‘বোখারী সাহেবের নাম যেমন হালিম তিনিও অসম্ভব হালিম। তার ওপর নামের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে।’

৭.
নাতিদের মধ্যে আমি একটু বেশিই থাকতাম নানাবাড়িতে। মাদরাসার ছুটিতে নানার সাথে লম্বা সফরে যেতাম। কখনো কখনো কোনো মাদরাসার শুরা বৈঠকে যেতাম। আবার যখনি বাসায় যেতাম, তিনি তাঁর সাথে খেতে ডাকতেন। আমার ভালো লাগত, আবার নানার জটিল প্রশ্নপর্বের দরুন একসাথে খেতে বসতে এক ধরনের দুঃসাহসিকতাও অনুভব করতাম।  নানার সামনে আমি বোকা আর ভীতু টাইপের হয়ে থাকতাম। যার দরুন তিনি রসিকতা করে বলতেন দুইজন মানুষকে কখনো হাসতে দেখেননি, আমি তাদের একজন। অপরজন জামেয়া পটিয়ার প্রফেসর সিরাজ সাহেব। 

৮.
তাঁর হিকমত আর প্রজ্ঞার কথা সবার মুখেমুখে। তবে আমার স্বচক্ষে দেখা ঘটনাবলী থেকে শুধু একটির বিবরণ দিচ্ছি। ২২ মার্চ ২০১৮ এর ঘটনা। পটিয়া কলেজ মাঠে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী আগমন ও নানান প্রকল্পের উদ্বোধনী পোগ্রাম ছিল। স্থানীয় ও প্রশাসনের লোকজন নানাকে আগ থেকে দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন। সাথে মুনাজাতের দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যাস্ত করলেন। উদ্বোধন হতে যাওয়া প্রকল্পে নানান ধর্মের স্থাপনার কথা থাকায় দেশের শীর্ষ আলিমগণ নানাকে না যেতে অনুরোধ করলেন।  নানা স্পষ্ট করে কোনো উত্তরও দিচ্ছিলেন না। আমি নানার সঙ্গী হতে চলে গেলাম পটিয়ায়। প্রোগ্রামে বের হওয়ার সময় জেনে অপেক্ষা করছি- নানার অফিস কক্ষে। এরইমধ্যে কয়েকজন এমপির কল আসছে দ্রুত প্রোগ্রামস্থলে চলে আসতে। নানা জবাব দিলেন বের হচ্ছি। একটু পরই গাড়িতে ওঠে বসলাম। গাড়িটি আমাদের নিয়ে চলল। অনুষ্ঠানস্থলের কাছে যেতে না যেতে— পুলিশ ও ডিউটিরত ট্রাফিক সদস্যরা গাড়ি থামাতে সিগন্যাল দিলো। যেহেতু রোডে সকল প্রকার চলাচল নিষিদ্ধ; তাই নানাকে প্রশ্ন করল- ‘কোথায় যাবেন হুজুর?’ বললেন, ‘সমাবেশে’। পুলিশ জানাল হেঁটে যেতে হবে। নানা চুপচাপ বসে রইলেন। নানা মুনাজাত করার দায়িত্বে আছেন, সেটা আমি আগ বাড়িয়ে  পুলিশকে জানাতে গেলে— চুপ করো বলে ধমক দিলেন। এরপর আমি ভয়ে চুপচাপ বসে আছি।  

এরমধ্যে উপস্থিত কয়েকজন পুলিশ আর দায়িত্বরতদের ঊর্ধ্বতন একজন অফিসারকে খুঁজলেন। তিনিও আসলেন দাঁড়ালেন গাড়ির সামনে। নানা ব্যাজে লেখা তাদের সবার নাম পড়ে নিলেন। এরপর ড্রাইভারকে বললেন, ‘গাড়ি ব্যাক দাও।’ এবং সোজা মাদরাসার অফিসে চলে এলেন। ততক্ষণে পোগ্রাম শেষ। পরে স্থানীয় এমপি আর প্রশাসনের লোকজন নানা পোগ্রামে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে— নানা বলেন, আমি তো গিয়েছিলাম। কিন্তু বাধাগ্রস্ত হয়ে চলে এসেছি। কয়েকজন পুলিশ সদস্যের নাম বলে জানালেন, তাদের কাছে জিঙ্গেস করে নিন কেন এমন হলো।’ পরে স্থানীয় এমপি বিষয়টি যাচাই করে নিশ্চিত হলেন।

৯.
আল্লাহ তাআলা আমার নানাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার মানুষ তৈরি করে দিন। আমাদের সকলকে তাঁর দেখানো পথে পরিচালিত করুন। আমিন।

লেখক: দৌহিত্র, মাওলানা আব্দুল হালিম বোখারী (রহ.); শিক্ষক, জামেয়া দারুল মা'আরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রাম

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ