রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩২ ।। ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
যেসব দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে  ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলো যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া জাগো হে কওমি তারুণ‍্য! রাতেই ঢাকাসহ তিন অঞ্চলে ঝড়ের আভাস অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হতে হবে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি: বাণিজ্য উপদেষ্টা চবির আরবি বিভাগের নতুন সভাপতি অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন তালুকদার ডেঙ্গুতে একদিনে ১২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৭৪০ সিরাতকে ধারণের মাধ্যমেই সত্যিকার পরিবর্তন সম্ভব: ধর্ম উপদেষ্টা সিরাতুন্নবী (সা.) সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতার লাইভ ড্র অনুষ্ঠান ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট

সুপ্রভাত ফিলিস্তিন: উপন্যাসের মোড়কে ইতিহাসের গল্প

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জাবির মাহমুদ । । 

‘অনেক দিন আগের কথা। সময় পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে অতিক্রম করে বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে ছুড়ে ফেলার আগের কথা। বাতাস ভূমিকে আটকে ধরে রেখে এর পরিচয়-রূপে নাড়া দেওয়ার আগের কথা। আমালের জন্মের অনেক অনেক আগের কথা।’

গল্পের শুরুটা ঠিক এভাবেই। ফিলিস্তিনের শহর জেনিনের পাশে শহরতলী এক গ্রাম 'হাইফা'। হাইফার পশ্চিমে ছিলো আরও একটি গ্রাম। তীন আর জয়তুনের ছায়াঘেরা সুন্দর সুশোভিত গ্রাম। চারদিকে খোলামেলা সূর্যের আলোয় ঝলমলে সেই গ্রাম। ভোরের বাতাসে পাতার মর্মর ধ্বনি, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, পাখিদের কিচিরমিচির আর মোরগের ডাকে ভোর হওয়া সেই গ্রাম-আইনে হুজ।

গ্রামটার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এর গোড়াপত্তনের মূল বহু দূরতম অতীতের গর্ভে প্রোথিত। ইতিহাসের মহাবীর সালাহুদ্দীন আইয়ুবি যখন কুদস বিজয় করেন, তখন তার এক বিশ্বস্ত সেনাপতিকে তিনি খুশি হয়ে গ্রামটা উপঢৌকন স্বরূপ প্রদান করেছিলেন। তিনিই এই গ্রামের গোড়াপত্তক। তার ৪০তম অধস্তনরাই আইনে হুজের বর্তমান বাসিন্দা। এ নিয়ে হুজবাসীদেরও অপরাপর গ্রামবাসীদের উপর গর্বের শেষ নেই!

গর্ব আছে ইয়াহইয়ারও। তিনি আইনে হুজের একজন বংশীয় সম্ভ্রান্ত। জলপাই চাষি। প্রিয়তমা বাসিমা আর মানিকজোড়া হাসান, দারবিশকে নিয়েই তার সংসার। কালক্রমে এই পরিবারটাই গল্পের রথচালক। পারিবারিক বন্ধন, প্রেম, ভালোবাসা, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, সহমর্মিতা, আর ঘৃণার মোহন ও কুটিল পথ বেয়ে কাহিনী এগুতে থাকে। এগুতে থাকে বেদনাতাড়িত, অন্তঃসারশূন্যএক জাজাবরী জীবনের লক্ষ্যে। যে জীবনের দুঃস্বপ্নও হুজবাসীরা কখনো দেখেনি। কখনোই না।

- নুপূরের রিনিঝিনি শব্দে হঠাৎ-ই আপনার চোখের পাঁপড়ি প্রসারিত হবে। বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টি রোমান্সনৃত্যে লম্ফহাঁটা দিবে ছত্র থেকে ছত্রে। একটা কাঁপা শিহরণ শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাবে নিচের দিকে। হ্যাঁ, আপনার বিস্ময় বিস্ফারিত চোখের
চরিত্রটাই ডালিয়া! রিনিঝিনি পায়ে ছুটে চলা কিশোরী। হাসানের অর্ধাঙ্গিনি। ইউসুফ আর ইসমাঈলের জননী। আমালের মমতাময়ী মা। আমাল তখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি!...

বইটি কিনতে ক্লিক করুন 

-জয়তুন গাছের পাতায় তখন কেবলি রঙ ধরতে শুরু করেছে। ঠিক এই সময় গ্রামের একটু দূরে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়! সূচিত হয় পৃথিবীকে অবাক করে দেয়া লজ্জাসকর এক ঘৃণ্য ইতিহাস। সেঁটে দেয়া হয় নির্লজ্জ মানবজাতির ললাটে ললাটে। লাজটিকারুপে! ১৯৪৭-৪৮ সালে ইরগুন, হাগানা ও স্টের্নগ্যাং এই তিনটি ইহুদি সন্ত্রাসী গ্রুপ আইনে হুজ গ্রামে চারবার আক্রমণ করে! এমনি এক আক্রমণের দিন। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ধূমায়িত হয় আইনে হুজের আকাশ।

এরপর একটি মুহূর্ত... "এইমাত্র ইসমাঈল ছিলো ডালিয়ার বুকে। মুহূর্তে নিমিষেই হারিয়ে গেল ইসমাঈল। জীবনের একটি মুহূর্ত। একটি ক্ষণ বদলে দিতে পারে গোটা জীবনকে। একটি মুহূর্ত কেড়ে নিতে পারে বুদ্ধি-বিবেক। বরং জীবনের ইতিহাসটাই বদলে দিতে পারে ছোট্ট একটি মুহূর্ত।

রোমান, বাইজেন্টাইন, উসমানি ও ব্রিটিশরা ধারাক্রমে ফিলিস্তিন শাসন করেছে। ১৯৩৬ এর বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনিদের নিরস্ত্র করে দেয়। ১৯৪৮ সালের মে মাসে লর্ড বেলফোর সেই ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায়। আইনে হুজ গ্রাম তখন দখল করে নেয় ফ্রান্স থেকে আসা ইহুদিরা। আর হুজবাসী নির্লজ্জ পৃথিবীবাসীর ঘোমটা টেনে দিয়ে অজানার পথ ধরে। হাসান ডালিয়াদের আশ্রয় মিলে জেনিনের এক শরণার্থী শিবিরে।

এই শিবিরের কোনো এক জীর্ণ কুটিরেই আমাল প্রথম শব্দ করে কেঁদে ওঠে। দু'চোখ ভরে দেখে রহস্যময় পৃথিবীর আলো। দিন গড়াতে থাকে। আমাল বড় হয়। পড়তে শেখে। প্রতিদিন বাবার গলা জড়িয়ে বসে কবিতা পড়ে আমাল। প্রতিদিনের সূর্য তাদের এভাবেই দেখতে পেত। আমাল এবং ইউসুফ এক ছাদের নিচেই বড় হতে থাকে। আর হারিয়ে যাওয়া ইসমাঈল পরিবর্তিত ডেভিড নামে বড় হতে থাকে এক ইহুদি পরিবারে।

-লেখিকা আমালের মুখ দিয়েই প্রায় গল্পের পুরোটা বলেছেন। আমালের জবানিতেই তাহলে আমরা তার শরণার্থী শিবিরের ঝলসে যাওয়া জীবনের গল্পটা শুনি-- "আমরা সবাই তখন ছিলাম জীবন আর মৃত্যুর মাঝে। জীবন বা মৃত্যু দুটোই যেন আমাদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করছিল।"

"আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে ছিলো মৃত্যুর গন্ধ। আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই বেড়ে উঠছিলাম। যে প্রজন্মের জন্য হয়েছিল শরণার্থী শিবিরের মধ্যে, আনন্দ আর বেদনার মধ্যে প্রার্থক্য করাটা আমাদের জন্য বেশ কঠিন ছিলো। দুঃখগুলো পড়ে থাকত মৃতদের খাটে। জীবন ছিলো আমাদের কাছে মৃত্যুর মতো। আবার কখনো মৃত্যুকে মনে হতো জীবনের মতো।"

"প্রত্যেক বোমার আঘাতে ছিন্ন হয়ে যাওয়া জীবনের গভীরে বেঁচে থাকার একটা ব্যথিত কামনা টগবগ করত।"

"আমরা একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে বাস করছিলাম, যার শেষ নেই। সেই দিনগুলো আমার স্মৃতিতে প্রোথিত হয়েছে রক্তময় বালুকণা আর ঝলসে যাওয়া জীবনের দৃশ্য দিয়ে।"

"জেনিনে আমার শৈশবের স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই বাকি ছিল না। আর ছিল চিরতরে হারিয়ে যাওয়া আমার পরিবারের ধ্বংসস্তূপ। সেসব ইসরায়েলি সৈন্যদের বুটের তলায় আর তাদের ট্যাংকের নিচে পিষ্ট।"

-শরণার্থী শিবিরের এই বিপুল ধ্বংসস্তূপের মাঝেও অঙ্কুরিত হয় ভালোবাসা, হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব। আঙ্গুরের লকলকে ডগার মতোই বেড়ে ওঠে। অসহ্য পৃথিবীর নিরেট এ বন্ধনগুলোকে ঘিরেই কেবলমাত্র জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর
বেঁচে থাকা। গল্পের শুরুটা বিগত শতাব্দীর সে-ই চল্লিশের দশকে হলেও বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে এসে শেষ হয়েছে। উভয় শতাব্দীর মাঝে সুজানের এই বই তৈরি করেছে- সবকিছুর কমপ্লিট এক বাস্তবানুগ মেলবন্ধন।

ফিলিস্তিনের সত্তর বছরের রক্তাক্ত দাস্তানকে লেপ্টে দেয়া হয়েছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। গল্পের কোথাও কোনো মেদ পরিলক্ষিত হয়নি। বাকচাতুরি আর বাহুল্যের পেছনেও শব্দ খরচ করেননি সুজান। সত্তর বছরের এই দীর্ঘ ইতিহাসকে মনে হয় যেন আমাদের যাপিত জীবনের মাত্রই গত হয়ে যাওয়া কোনো হালচিত্র।

দশক দশক ভাগ করে গল্প বলে যাওয়া হয়েছে। গল্পের খাঁজে খাঁজে খুব পাতলা করে সেঁটে দেয়া হয়েছে- ইতিহাস। ইতিহাসের কচকচানির পেছনে পড়ে পাঠক যাতে হাঁপিয়ে না ওঠেন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। এটা মূলত লেখকের অনুসন্ধিৎসা, দূরবীন চোখ, ইতিহাসপাঠ, উন্নত উচ্চমার্গীয় রুচিবোধেরই সাকসেসফুল ডেলেভারি।

প্রিয় সুজান! আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আপনার জন্য শুধুই পরকালীন উচ্চাসন কামনা। নাজমুস সাকিব ভাই! ইউ আর এ মোষ্ট ব্রিলিয়ান্ট। মর্নিংস ইন জেনিনের অনুবাদে আপনি হান্ড্রেড মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পাঠক-হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ার সমস্ত রসদ জড়ো করে ফেলেছেন। এখন কেবল দিগ্বিজয়ের পালা।

- সময়ের হাত ধরে পরিবর্তিত হতে থাকে গল্পের রুপ- চরিত্র-দৃশ্যপট। কিন্তু গল্পের ভিলেন সেই একজনই- ফ্রাঙ্কেক্সটাইন!ফিলিস্তিনিদের কলিজা খামচে ধরা, টেঙ্ক, বুলডোজার আর বুটের তলায় পিষে ফেলা ধ্বংসস্তূপ, আর তার নিচে বোমার আঘাতে ছিঁড়ে যাওয়া দেহের কবস্থ সত্বায় ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা স্বাধীনতা।

জামিলের মতো শত শত শিশুর ঝাঁজরা করে দেয়া বুকের সর্বত্র বিরাজিত স্বাধীন ফিলিস্তিনের মানচিত্র। এসবকিছুর জনক সেই ফ্রাঙ্কেক্সটাইন খ্যাত ইসরাঈল!

একটা স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট প্রতিষ্ঠার লিপ্সায় ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করা এই কুলাঙ্গার জাতটি কোনো ইতিহাসের তোয়াক্কা না করে কি দুর্দান্ত প্রতাপেই না নিরিহ, নিরস্ত্র, স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের ওপর হাতমশকের কাজ করে যাচ্ছে! আর মানবিক পৃথিবী এই বন্যখেলার নির্লজ্জ দর্শক। হায়রে মানবিক পৃথিবী!? হায়রে মানবতা!? হায়রে মানবাধিকার! তোদের মুখে ডাস্টবিনের আবর্জনা!...টয়লেটের!...

- "ইন্তিফাদা" ইসরাঈলিদের দখলদারির প্রায় ২০বছর পর জেগে ওঠা অগ্নিস্ফূলিঙ্গের নাম। যা প্রতিটা ফিলিস্তিনির রক্তে মাদকের মত আসক্তি নিয়ে মিশে আছে। সময়ে অসময়ে ব্যাঘ্রর ক্ষিপ্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নরপিশাচ ইসরাঈলিদের ওপর।

এক নজরে বই-

বই: মর্নিংস ইন জেনিন: সুপ্রভাত ফিলিস্তিন
ধরন: ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস
লেখক: সুজান আবুলহাওয়া
অনুবাদক: নাজমুস সাকিব
প্রচ্ছদ: সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
প্রকাশনা: নবপ্রকাশ
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩৫২
মুদ্রিত মূল্য: ৪৮০ টাকা

আরএম/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ