শনিবার, ০৪ মে ২০২৪ ।। ২০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫


মাহে রমজানের যে মাসায়েলগুলো অবশ্যই জানতে হবে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান মুমিনের দ্বারপ্রান্তে। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার এ মাস। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় একজন মুমিন তাকওয়ার গুনে গুনাণ্বিত হতে পারে। হতে পারে রাসুল সা. এর শ্রেষ্ঠ একজন উম্মত। লাভ করতে পারে ইহকালীন ও পরকালীন প্রভূত কল্যাণ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাতলানো পন্থা ও সাহাবায়ে কেরামের নমুনায় রমজান পালনেই তা সম্ভব।

আওয়ার ইসলাম পাঠকের জন্য মাহে রমজান জুড়ে “মাসায়েলে রমজান” শিরোনামে প্রতিদিন গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসায়েল পাঠকের সমীপে উপস্থাপন করা হবে। নিয়মিত মাসায়েল লিখবেন, শেখ জনূরুদ্দীন র. দারুল কুরআন মাদরাসা চৌধুরীপাড়ার ইফতা বিভাগের মুশরিফ, মুফতি সাদেকুর রহমান।।

আমাদের অবশ্যই রমজানের সব শর্ত-শারায়েত  আদব ও মুস্তাহাবসমূহের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। একজন মুমিন যেন যথাযথ নিয়মে সিয়াম পালন করতে পারে তার জন্যেই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। রাব্বে কারিম প্রত্যেক ঈমানদার পুরুষ ও নারীকে পবিত্র রমজানের রহমত, বরকত ও মাগফিরাত হাসিল করার তৌফিক দান করুন, আমিন। 


রোজা কাকে বলে?
রোজা রাখার নিয়তে সুবহে সাদিক (পূর্ব আকাশে শুভ্র আভা প্রকাশ) হওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং স্ত্রী মিলন থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলে। ফাতাওয়া আলমগীরী- ১/১৯৪; রদ্দুল মুহতার-৩/৩৩০।

রোজা কার উপর ফরয?
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী মুসলমান নারী এবং পুরুষের উপর রমজানেররোজা রাখা ফরয, যখন সে সুস্থ এবং মুকীম অবস্থায় থাকবে। সুতরাং নাবালেগ, পাগল এবং কাফেরের উপর রোজা ফরযই নয়। আর অসুস্থ কিংবা মুসাফিরের উপর রমজানেররোজা ফরয বটে, তবে তা ঐ অবস্থায় আদায় করা ওয়াজিব নয়। ফাতাওয়া আলমগীরী-১/১৯৫

রোজা সহিহ হওয়ার শর্ত:
রোজা সহীহ হওয়ার শর্ত দু’টি। এক. রোজার নিয়ত করা। সুতরাং কেউ নিয়ত না করে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং স্ত্রী মিলন থেকে বিরত থাকলেও শরীয়তের দৃষ্টিতে তা রোজা হিসেবে গণ্য হবে না।

দুই. নারী হায়েয এবং নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া। অতএব মাসিক পিরিয়ড বা নেফাস চলাকালীন কোন মহিলা রোজা রাখলে তার রোজা শুদ্ধ হবে না। ফাতাওয়া আলমগীরী-১/১৯৫

রোজার নিয়ত কিভাবে করবে?
নিয়ত এটি আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হল মনে মনে ইচ্ছা করা। এতএব কেউ যদি সূর্যাস্তের পরবর্তী কোন এক সময়ে মনে মনে এই ইচ্ছা করে যে, আমি আগামী কাল রমজানেররোজা রাখব, তাহলে তার নিয়ত সংঘটিত হয়ে যাবে। নিয়ত সহীহ হওয়ার জন্য মুখে উচ্চারণ করা শর্ত নয়। তবে তা উত্তম। ফাতাওয়া আলমগীরী-১/১৯৫

রোজার নিয়ত কখন করবে?
সূর্যাস্তের পর থেকে পূর্ব (অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের মধ্যবর্তী সময়ের আগ) পর্যন্ত রমজানেররোজার নিয়ত করার অবকাশ আছে। তবে সুবহে সাদিকের পূর্বেই নিয়ত করে নেওয়া উত্তম। বাদায়েউস সানায়ে- ২/২২৯; আল বাহরুর রায়েক-২/২৫৯

সাহরি খাওয়ার দ্বারাই নিয়ত হয়ে যায়?
হ্যাঁ, রোজার জন্য সাহরি খেলেও রোজার নিয়ত হয়ে যায়। আল বাহরুর রায়েক-২/২৫৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/১৯৫

সাহরি সম্পর্কিত কিছু মাসায়েল

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ الله عَنهُ أَن رَسُول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم قَالَ: تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بَرَكَةً.

হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সাহরি খাও। কেননা, সাহরিতে বরকত রয়েছে।- সহিহ বুখারি, হাদিস নং;১৯২৩-

عمرو بن العاص عن عمرو بن العاص أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال فصل ما بين صيامنا وصيام أهل الكتاب أكلة السحر

হযরত আমর ইবনে আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন আমাদের এবং আহলে কিতাব (ইহুদী ও নাসারা) এর রোজার মধ্যে পার্থক্য হল সাহরি খাওয়া। (আমরা সাহরি খাই আর তারা সাহরি খায় না।) সহিহ মুসলিম হাদিস নং-১০৯৬

কী দ্বারা সাহরি খাবে?
প্রত্যেক ব্যক্তি আপন রুচি অনুসারে সাহরি খাবে। চাই তা ভাত হোক কিংবা রুটি বা অন্য কিছু। পেট ভরে সাহরি খাওয়া জরুরি নয়। অতএব কেউ যদি এক দুই লুকমা খাবার কিংবা দুই চারটি খেজুর খেয়ে নেয় অথবা শুধু কিছু পানি পান করে নেয়, তাহলেও সে সাহরির সাওয়াব পেয়ে যাবে। আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৫

সাহরি খাওয়া ব্যতীত কি রোজা হবে না?
অনেক সাধারণ মুসলমান মনে করে যে, সাহরি না খেলে রোজা সহিহ হবে না।তাদের এ ধারণা সঠিক নয়। তবে সাহরি না খেলে সাহরির সাওয়াব পাওয়া যাবে না। কিন্তু রোজা সহিহ হয়ে যাবে।ফাতাওয়া আলমগীরী-১/১৯৪

কখন সাহরি খাবে?
রাতের শেষভাগে সাহরি খাওয়া উত্তম । অর্থাৎ সতর্কতামূলক সময় হাতে রেখে সুবহে সাদিকের পূর্ব-নিকটবর্তী সময়ের্ সাহরি খাওয়া উত্তম। তবে এ পরিমাণ বিলম্বিত করবে না যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয় ১এবং রোজা সহিহ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।- হেদায়া/১২২৫

সাহরির ব্যাপারে বাড়াবাড়ীও নয় ছাড়াছাড়ীও নয়:
অর্ধরাতে সাহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া, এরকম বাড়াবাড়ী ও উচিৎ নয়। আবার এই পরিমাণ বিলম্ব করে সাহরী খাওয়া যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়, এ ধরনের ছাড়াছাড়ী ও ঠিক নয়। হেদায়া- ১/২২৫

সাহরির পর কি চা-পান খেতে পারবে?
হ্যাঁ, সাহরি খেয়ে চা-পান ইত্যাদি খেতে পারবে। তবে এই পরিমাণ বিলম্ব করে খাবে না যে, রোজা সহিহ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। বরং সুবহে সাদিক হওয়ার আগেই কুলি করে মুখ পরিষ্কার করে নিবে। তানভী রহ. কৃত যাওয়ালুস সুন্নাহ্ -১৩

কখন সাহরি খাওয়া মাকরূহ?
সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ তৈরী হলে সাহরি বা কোন কিছু পানাহার করা মাকরূহ। তা সত্ত্বেও যদি কিছু খেয়ে নেয় আর ঐ সময় বাস্তবেও সুবহে সাদিক হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে ঐ রোজা সহিহ হবে না। তার কাযা করে নিবে। আর যদি সুবহে সাদেক হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ রয়েই যায়, নিশ্চিতরূপে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারা যায় তাহলেও সতর্কতাস্বরূপ ঐ রোজার কাযা করে নিবে। হেদায়া- ১/২২৫

ইফতার সম্পর্কিত কিছু জরুরি মাসায়েল:

عن سهل بن سعد أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لا يزال الناس بخير ما عجلوا الفطر

হযরত সাহল রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন মুসলমানগণ কল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে যতক্ষণ তারা তাড়াতাড়ী ইফতার করবে। সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৯৫৭ ;

عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم قال الله عز وجل أحب عبادي إلي أعجلهم فطرا

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন আল্লাহ তায়ালা ফরমান: আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় বান্দা ঐ ব্যক্তি, যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি ইফতার করে। সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-৭০০

عن أبى هريرة ، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال :لا يزال الدين ظاهرا ما عجل الناس الفطر،لان اليهود والنصارى يؤخرون

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন; ইসলাম ধর্ম বিজয়ী হিসেবে থাকবে যতক্ষণ মুসলমানগণ ইফতারকে তাড়াতাড়ি করবে। কেননা ইহুদী এবং খৃষ্টানরা বিলম্বে ইফতার করে। সুনানে আবূ দাউদ, হাদিস নং-২৩৫৩

এ সকল হাদিসর আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, যখন সূর্যাস্তের ব্যাপারে নিশ্চিত হবে তখন আর বিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ ইফতার করে নেওয়া মুস্তাহাব।

কখন ইফতার করা মাকরূহ?
সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে এটা নিশ্চিতরূপে জানার পরও বিলম্ব করে ইফতার করা মাকরূহ। নিশ্চিত সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো দিনের আলো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, অন্ধকার হয়নি, অথবা এখনো শরীরের পশম দেখা যাচ্ছে, অথবা মসজিদ থেকে আযান হচ্ছেনা ইত্যাদি কারণে বিলম্ব করে ইফতার করা মাকরূহ। ফাতাওয়া আলমগীরী-১/২০০

কী দ্বারা ইফতার করবে?
খেজুর অথবা মিষ্ট জাতীয় বস্তু দ্বারা ইফতার করা উত্তম। এর ব্যবস্থা না থাকলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। তাবয়ীনুল হাকায়েক- ১/৩৪৩
عن سلمان بن عامر يبلغ به النبي صلى الله عليه وسلم قال إذا أفطر أحدكم فليفطر على تمر فإنه بركة فإن لم يجد تمرا فالماء فإنه طهور

হযরত সালমান ইবনে আমের রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ ইফতার করতে চাইলে যেন খেজুর দ্বারা করে। কেননা তা বরকতপূর্ণ। আর তা সম্ভব না হলে পানি দ্বারা করবে। কেননা তা পবিত্রকারী। সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-৫৫৮ ; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৬৯৯

عن أنس بن مالك قال كان النبي صلى الله عليه وسلم يفطر قبل أن يصلي على رطبات فإن لم تكن رطبات فتميرات فإن لم تكن تميرات حسا حسوات من ماء

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাগরিবের নামায আদায়ের পূর্বে কিছু পাকা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। আর তা না থাকলে কয়েকটি শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন আর তাও না পাওয়া গেলে কয়েক ঢোঁক পানি দ্বারা ইফতার করতেন। সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং-৬৯৬।

ইফতারের পূর্বে কী করনীয়?
ইফতারের সময় হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে ইফতার প্রস্তুত করে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা,বেশি বেশি দআ-দরুদ পড়া,তাওবা-ইস্তিগফার করা।ঘরে মা বোনরাও এর প্রতি যত্নশীল হবেন।এক্ষেত্রে পুরুষরাও তাদেরকে সহায়তা করবেন।

ইফতারের পূর্বে কী দুআ পড়বে?
হযরত মুআয বিন যুহরা রাযি. বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন- اللَّهمَّ لَكَ صُمتُ وعلَى رزقِكَ أفطَرتُ (হে আল্লাহ তোমার জন্যই আমি রোজা রেখেছি এবং তোমার রিযিক দ্বারাই ইফতার করেছি।) সুনানে আবূ দাউদ, হাদিস নং-২৩৫৮

ইফতারের পরে যেম দোয়া পড়বে
হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর রাযি. বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন নিম্নোক্ত দুআ পড়তেন- ذَهَبَ الظَّمأُ، وابْتَلَّتِ العُرُوقُ، وَثَبَتَ الأجْرُ إِنْ شاءَ اللَّهُ تَعالى (তৃষ্ণা দূর হয়েছে, শিরা-উপশিরা সিক্ত হয়েছে। যদি আল্লাহ চান তবে প্রতিদান অবধারিত হয়েছে।) সুনানে আবূ দাউদ, হাদিস নং-২৩৫৭

ইফতারি ও খানা এক সাথে খেয়ে একটু বিলম্বে মাগরিবের নামায আদায় করা যাবে কি?

উত্তম হলো, সংক্ষিপ্ত সময়ে ইফতার করে নামায আদায় করবে। তারপর ইচ্ছা হলে খানা খাবে। তা সত্ত্বেও যদি বিশেষ কোন কারণে ইফতারী ও খানা একসাথে খাওয়ার পর নামায আদায় করে, তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। তবে এই পরিমান সময় বাকি থাকতেই পানাহার থেকে ফারেগ হতে হবে, যাতে মাকরূহ ওয়াক্তের পূর্বেই নামায আদায় করা যায়। ফাতাওয়া হক্কানিয়া- ৪/১৫৪

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ