শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ ।। ২০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫


মুসলিমদের জাতীয় ঐক্য যে কারণে সবচেয়ে বেশি জরুরি!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাহমুদুল হাসান নু’মান বিন আল্লামা মুফতি মাওলানা উসমান গনী বালিয়া রহ.

বাংলাদেশসহ মুসলিম জাতির যে মহাদুর্যোগ চলছে এর কারণ হলো কুরআন থেকে বিচ্যুতি ও পাশ্চাত্য মতবাদের উপর নির্ভরতা। অথচ ইসলামের ভিত্তি হলো ইনসাফ আর পাশ্চাত্য মতবাদের ভিত্তি ন্যাচারাল সিলেকশন-এর মত নিষ্ঠুর থিউরি। ডারউইনের বিবর্তনবাদের মূলকথা হলো Struggle for life and survival of the fittest অর্থাৎ জীবজগতে খাদ্য বাসস্থান ইত্যাদিতে টিকে থাকার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম চলছে।

এই সংগ্রামে যে প্রাণী পরিবেশের সাথে নিজেকে অধিক খাপ খাওয়াতে পারে সে টিকে যায় ও প্রজনন করে, যে ব্যর্থ হয় সে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এটাকেই বলে ন্যাচারাল সিলেকশন- প্রাকৃতিক নির্বাচন। হার্বার্ড স্পেন্সার ‘সোশ্যাল ডারউইনিজম’ নামে এই থিউরি সমাজবিজ্ঞানে প্রয়োগ করেন। অর্থাৎ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হবে, সেখানে যোগ্যরা টিকে থাকবে অযোগ্যরা ধ্বংস হয়ে যাবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, দুঃখ করার কিছু নেই।

এই নিষ্ঠুর থিউরির উপর পশ্চিমা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত। যেমন পুঁজিবাদ শুধু উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট চারটি উপাদানের মধ্যে আয় বন্টনের কথা বলে। সমাজতন্ত্র শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব-এর ঘোষণা দিয়ে ব্যক্তি মালিকানা খতম করে রাষ্ট্রীয় মালিকানার কথা বলে। এর বাইরে উক্ত দুটি মতবাদ বৃহত্তর মানবাধিকার সম্পর্কে কিছুই বলে না। যেমন নিঃস্ব, দরিদ্র, ইয়াতিম, বিধবা, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গ, পতিতা, হিজড়া দুর্বল, মজলুম ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর কি হবে- এ সম্পর্কে কিছুই বলে না।

তবে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মূল দর্শন থেকে বেরিয়ে এসে সমাজতন্ত্রের ভয়ে পুঁজিবাদ কল্যাণ রাষ্ট্র, সমাজতন্ত্র সামাজিক নিরাপত্তা ও জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করেছে- যা খন্ডিত, অপূর্ণাঙ্গ, অসার্বজনীন।

তাছাড়া এগুলি বাস্তবায়নের জন্য কোন কর্তৃপক্ষ বা আইনি বাধ্যবাধকতা নাই। পক্ষান্তরে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন মানবাধিকার দিয়েছে, এগুলি ঈমান আকিদার সাথে সংশ্লিষ্ট বিধায় বাস্তবায়ন না করলে ইহ-পরকালে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল হক্কুলাহ অংশটা ব্যতীত কুরআন হাদিস থেকে হুকুমত ও মানবাধিকার অংশটা বাদ পড়ে গেছে।

কোন ফিরকার সিলেবাসে এসব বিষয় নাই বিধায় আমরা এগুলি জানিও না, প্রচার ও প্রতিষ্টার চেষ্টাও করি না। অথচ পশ্চিমা সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থাটা গড়ে তোলা হয়েছে বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দর্শন অনুযায়ী, তারা এসব প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগ করেন। এটাই হলো পশ্চিমা মতবাদের বিজয় আর ইসলাম পরাজয়ের কারণ।

এ সম্পর্কে “মুসলিম ঐক্যের ডাক, ইসলাম ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ” গ্রন্থদ্বয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তবে এখানে হুকুমত তথা রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রশাসন, আইন, বিচার ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা সম্ভব নয় বিধায় মানবাধিকার সংক্রান্ত কিছু বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব এই উদ্দেশ্যে যে- (১) কোরআন-হাদিস থেকে বাদ পড়া বিষয়গুলি সিলেবাস ভুক্ত করতে হবে (২) এগুলি রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর করতে হবে (৩) তার জন্য ভোট জিহাদ করতে হবে। এখানে কুরআন- সুন্নাহ থেকে বাদ পড়া কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি, কারো আপত্তি থাকলে শরিয়া আদালতে ফায়সালা হবে- এর বাইরে বিতর্ক কাম্য নয়।

দরিদ্রের আর্থিক অধিকারঃ ইসলাম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণে দায়বদ্ধ। তজ্জন্য যাকাত-ইনফাক, উশর-খুমুস, জিযিয়া-খারাজ ইত্যাদির বিধান দেয়া হয়েছে কিন্তু কোরআন- হাদিসের এসব বিধান বাদ পড়ে গেছে। যেমন- ১। যাকাতঃ কোরআনে সালাতের সাথে সাথে যাকাতের উল্লেখসহ অতিরিক্ত ইনফাকের তাকীদ এসেছে, হযরত আবু বকর (রাঃ) যাকাতের জন্য যুদ্ধ করেছেন, কোন কোন ফকীহ বলেন যারা যাকাত আদায় করে না তাদের নামাজ কবুল হয় না। অথচ যাকাতকে বর্জনের স্তরে ফেলে রাখা হয়েছে। যেমন দেশে সালাত আদায়ের জন্য সাড়ে তিন লক্ষ মসজিদ আছে কিন্তু যাকাত উত্তোলন কেন্দ্র নাই (বিচ্ছিন্ন দুয়েকটা সংস্থা ব্যতীত)। মসজিদ-মাদ্রাসা, খানকা, সকল ফিরকা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে নামাজ-রোজা, যিকির শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কিন্তু দরিদ্রের জন্য কেউ যাকাত আদায়ের দায়িত্ব পালন করছেন না। হক্কুল্লাহ শিক্ষাদানের জন্য তাবলীগের জন্ম হয়েছে কিন্তু হক্কুল ইবাদ আদায়ের জন্য কোন দল গঠিত হয়নি। অর্থাৎ হক্কুল ইবাদ বাদ দিয়ে শুধু হক্কুল্লাহর দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে।

২। ইনফাকঃ যাকাতে দরিদ্রের প্রয়োজন না মিটলে বিত্তবানদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে দরিদ্রের প্রয়োজন মেটাতে হবে। দলীলঃ সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে বরং বড় সৎকাজ হল--- আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতের আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। (বাক্বারা : ১৭৭) উক্ত আয়াতের ব্যখ্যায় রাসূল (সাঃ) বলেন "ধনীদের সম্পদে যাকাত ব্যতীত আরো অতিরিক্ত হক্ব আছে (তিরমিজি)। এ সম্পর্কে ফকীহগণের মতামত হল – ১। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন ‘যাকাত দ্বারা যদি অভাবগ্রস্থদের অভাব মোচন সম্ভব না হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের জন্য অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে হলেও অর্থ ব্যয় করতে হবে, (আস সিয়াসাতুশ শারইয়া)। ২। ইবনে আবেদিন বলেন ‘বিচারপতি যেমন অক্ষম দরিদ্র ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণের জন্যে তার ধনী অভিভাবক বা নিকটাত্মীয়কে বাধ্য করবে, তেমনি রাষ্ট্র প্রধানকেও বিচারের মাধ্যমে এজন্যে বাধ্য করবে। (আত তাশরীউল ইসলামী)। ৩। ইবনে হাজম বলেন ‘যাকাত ফান্ড দরিদ্র জনগণের প্রয়োজন পূরণে অক্ষম হলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের পেটভরা খাবার ও শীত গ্রীষ্মের উপযোগী পোশাক দিতে হবে। বর্ষা, শীত ও রৌদ্রতাপ থেকে বাঁচার জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পথচারীদের জন্যও এরূপ ব্যবস্থা করতে হবে। (আল মুহাল্লা, ইবনে হাজম, ৬ষ্ঠ খণ্ড)। এ বিষয়ে প্রায় সকল ফকিহ একমত।

৩। সম্পদের সমবন্টন বা ইসলামি সমাজতন্ত্রঃ যাকাত ও ইনফাকে যদি দরিদ্রের প্রয়োজন না মিটে তাহলে সম্পদ কেউ সঞ্চয় করতে পারবে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মুস্তাদআফের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। দলীলঃ (১) আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা (কানয) করে রাখে কিন্তু আল্লাহর পথে ব্যয় করে না- তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। (৯:৩৪) (২) আর লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? বলে দাও, আফবু অর্থাৎ নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। (বাক্বারাঃ ২১৯) (৩) আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রাসূল (সাঃ) কে যা দিয়েছেন- তা আল্লাহর, রাসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। (৫৯: ৭) (৪) তাদের ধন-সম্পদে নির্ধারিত হক আছে সায়েল (ভিক্ষুক) ও বঞ্চিতের। (মাআরিজ- ২৪ ও ২৫)

ব্যাখ্যাঃ হযরত আলী (রাঃ) বলেন, চার হাজার দিরহামের কম হলে সেটা পারিবারিক ব্যয় আর বেশি হলে কানয হিসেবে গণ্য হবে। হযরত আবু যর (রাঃ) এর মতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ কানয- তা দরিদ্রদের মধ্যে দান করে দিতে হবে। হযরত আবু হুরায়রা, ইবনে আব্বাস, জাবির বিন আব্দুল্লাহ, কাতাদা, সুদ্দী, হাসান বসরি বলেন 'আফবু অর্থ পারিবারিক ব্যয়ের অতিরিক্ত সম্পদ, তা দরিদ্রদের মাঝে দান করে দিতে হবে। (ব্যাখ্যা সূত্রঃ তাবারী, কুরতুবী, ইবনে কাসির ও অন্যান্য তাফসীর) কাজেই মুস্তাদআফ শ্রেণিকে ভোট জিহাদ করতে হবে। অর্থাৎ যে দল তাদের দাবী মানবে সেই দলকে তারা ভোট দিবেন।

মজলুমের বৈচারিক অধিকারঃ ইসলাম পাঁচ প্রকার হত্যার মধ্যে শুধু ইচ্ছাকৃত হত্যার ক্ষেত্রে কিসাস (প্রতিশোধ) ও দিয়ত-এর এখতিয়ারসহ বাকি সকল ক্ষেত্রে দিয়তের বিধান দিয়েছে। আর দিয়ত হলো একশত উট বা দশ হাজার দিরহাম বা তৎসম পরিমাণ মূল্য। এই ক্ষতিপূরণ পেলে নিহতদের ধ্বংসোন্মুখ পরিবারগুলি বাঁচতে পারত। কাজেই নিহতদের পরিবারগুলিকে ভোট জিহাদ করতে হবে। অর্থাৎ যে দল তাদের দাবী মানবে সেই দলকে তারা ভোট দিবেন।

শিশু অধিকারঃ শিশু জন্মের পর আকিকা, শিক্ষা-দীক্ষা থেকে নিয়ে বিয়ে-শাদি পর্যন্ত সকল দায়িত্ব পিতা-মাতা বহন করবে। কিন্তু শিশুর অভিভাবক যদি দরিদ্র থাকে তাহলে সরকার তার ভাতা দিবে। দলীল- তোমরা রিজিকের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না, আমি তাদেরকে ও তোমাদেরকেও রিজিক দিব (ইসরা- ৩১)। খলিফাগণ শিশুসহ সকল নাগরিককে ভাতা দিতেন। এমনকি হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) যাকে খলিফা না বলে আমির বলা হয়- তিনিও একজন মন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন নবজাতক শিশুদের খুঁজে খুঁজে বের করে ভাতা জারি করার জন্য।

নারী অধিকারঃ প্রাক ইসলাম নারী ছিল মূর্তিমান অভিশাপ। ইসলাম নারীর যে অধিকার দিয়েছে তা অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদে কল্পনাতীত। যেমন নারীর তিনটি পর্যায়- ঝি, জায়া ও জননী। ইসলাম নারীর এ তিনটি অবস্থার যাবতীয় দায়িত্ব তিন শ্রেণীর পুরুষ তথা পিতা, স্বামী ও সন্তানের উপর ফরয করে দিয়েছে। ১। নারী শিক্ষাঃ ইসলাম পুরুষের সাথে সাথে নারীর জন্যও দ্বীন- দুনিয়ার প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন ফরয করেছে। দলীল- তলবুল ইলমি ফরিজা--- ইলম (জ্ঞান) অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ। ২। নারীর কর্মঃ পর্দা রক্ষা করে নারীর কর্ম জায়েজ। দলিল- রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে নারীগণ ঘরে বাইরে কাজ করতেন, উট ঘোড়া ছাগল চড়াতেন, খেজুর পারতেন, মসজিদ ও ঈদগাহে গিয়ে নামাজ পড়তেন, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতেন। যেমন হযরত আবু বকরের কন্যা আসমা ঘরে বাইরে যাবতীয় কাজ করতেন, ঘোড়াকে ঘাস পানি দিতেন, দুই মাইল দূর থেকে খেজুর তুলে আনার পথে অনেক সময় রাসূল (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যেত, রাসূল তাকে নিষেধ করেননি। ইত্যাদি ঘটনা প্রমাণ করে মেয়েরা ঘরে বাইরে কাজ করতে পারবেন। ৩। সামাজিক দায়িত্বে নারীঃ হযরত ওমর শিফা নাম্নি এক বুদ্ধিমতী মহিলাকে বাজারের কোন কোন দায়িত্ব অর্পণ করতেন। সামুরা বিনতে নুহাইক হাটে বাজারে গিয়ে সৎ কাজের আদেশ এবং খারাপ কাজে বাধা দিতেন। কেউ অন্যায় করলে চাবুক মারতেন। ৪। নারী সংগঠনঃ হযরত জায়েদের কন্যা আসমা একদল নারীর নেত্রী হয়ে রাসূলের (সাঃ) কাছে গমন করেন। ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতায় নারী স্বাধীনতাঃ ইসলাম তিন শ্রেণীর পুরুষের উপর নারীর যাবতীয় দায়িত্ব ফরজ করার পরও চাকরি-নকরীর অনুমতি দিয়েছে। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য সভ্যতায় দুর্বল নারীর দায়িত্ব কারো উপর অর্পণ তো করেইনি বরং স্বাধীনতার নামে তার জীবন জীবিকার দায়িত্ব নারীর উপরই অর্পণ করে জুলুম করেছে। অর্থাৎ বেচারীকে উপার্জন করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। এই হল ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতায় নারী স্বাধীনতার পার্থক্য। কাজেই ইসলামের কন্যাদের ইসলাম প্রদত্ত অধিকার আদায়ে ভোট জিহাদ করতে হবে।

সংখ্যালঘু অধিকারঃ মদিনা সনদ সংখ্যালঘুদের শ্রেষ্ঠ রক্ষা কবজ। আরো কিছু বিষয় পেশ করা হলো। ১। ইসলাম গ্রহণের জন্য জোর জবরদস্তি নাই। দলিল- দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নাই, কারণ হেদায়েত গুমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। (বাকারা- ৩৪) (২) জানমালের নিরাপত্তাঃ রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন যিম্মীর উপর জুলুম করবে কেয়ামতের দিন আমি স্বয়ং আল্লাহর দরবারে তার বিরুদ্ধে বাদী হব (মায়ারিফুস- সাহাবা)। অন্য হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি জুলুম করল বা তার অধিকার ক্ষুন্ন করল বা তার সাধ্যাতিত বোঝা (জিঝিয়া কর) চাপিয়ে দিল বা সম্মতি ছাড়াই তার কাছ থেকে কোন জিনিস কেড়ে নিল- এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কেয়ামতের দিন আমি নিজেই আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদি হব। (আবু দাউদ) (৩) ধর্মীয় স্বাধীনতাঃ রাসূল ও খলিফাগণের যুগে অমুসলিমদের পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। যেমন হযরত আবু বকর সিরিয়া অভিযানের সময় সেনাপতি উসামাকে নির্দেশ দেন অমুসলিমদের উপাসনালয় ও পুরোহিতদের হেফাজত করতে। তেমনি ওমর বিন আব্দুল আজিজ তার গভর্নরদের কাছে ফরমান পাঠান, তারা যেন জিম্মিদের উপাসনালয় ও পুরোহিতদের রক্ষা করে।

খলিফাদের যুগে বিভিন্ন উপাসনালয়ে আর্থিক সাহায্যও দেওয়া হতো। (৪) নাগরিক অধিকারঃ ইমাম নববী বলেন, মুসলমানরা রাষ্ট্রের যে সুযোগ-সুবিধা পাবে অমুসলিমরাও তাই পাবে, আবার অপরাধ করলে মুসলমানদের উপর যে দন্ডবিধি প্রয়োগ হবে তাদের উপরও তাই হবে। অর্থাৎ সুযোগ সুবিধা ও অপরাধের শাস্তি উভয় শ্রেণীর জন্য সমান- এক রত্তিও কম বেশি হবে না। (৫) অক্ষম ও দুর্বলদের রাষ্ট্রীয় ভাতা প্রদানঃ হযরত ওমর এক বৃদ্ধ ইহুদিকে ভিক্ষা করতে দেখে তার জিজিয়া মওকুফ করে বাইতুল মাল থেকে ভাতা জারি করে দেন। হযরত আবু বকরের আমলে হীরাবাসীদের সাথে চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, কোন অমুসলিম ধনী থেকে দরিদ্র হয়ে গেলে বা বৃদ্ধ অকর্মণ্য হয়ে পড়লে বায়তুল মাল থেকে তার ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করা হবে। (কিতাবুল খারাজ) প্রমাণিত হলো ইসলাম সংখ্যালঘুর যে অধিকার দিয়েছে অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদ তা দিতে পারেনি। কাজেই হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান পরিষদের কাছে আবেদন, আপনারা ইসলাম প্রদত্ত অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হউন, আমরা আছি আপনাদের সাথে।

শ্রমিক অধিকারঃ (১) আবু যর গিফারি (রাঃ) বলেন, আমি একজনকে (বেলাল) কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান বলে লজ্জা দিয়েছিলাম। ঘটনা শুনে নবী করীম (সাঃ) আমাকে বললেন, হে আবু যর তোমার মধ্যে তো জাহেলিয়াতের স্বভাব রয়েছে। খাদেমরা তোমাদের ভাই- যাদেরকে আল্লাহ তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। যার অধীনে তার কোন খাদেম ভাই থাকবে তাকে সে নিজে যা খাবে তাই খেতে দিবে, সে নিজে যা পরবে তাই পরতে দিবে। তাদের উপর সাধ্যাতিত কাজের বুঝা চাপিয়ে দিও না, যদি কঠিন কাজ করাতেই হয় তাহলে নিজেরা তাদেরকে সাহায্য করবে (বুখারি)। (২) হযরত আবু হুরায়রার ((রাঃ) বরাতে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, তোমাদের কারো খাদেম যদি খাদ্য প্রস্তুত করে নিয়ে আসে তবে তাকে নিজের সঙ্গে খাওয়ায় শরীক করো। কারণ সে তোমার জন্যই আগুন ও ধোয়ার জ্বালা সহ্য করেছে (বুখারি)। (৩) অন্য হাদিসে এসেছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, মজুর ও শ্রমিককে তার উৎপন্ন দ্রব্য হতেও অংশ দিবে। কারণ আল্লাহর মজুরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যায় না। (মুসনাদে আহমদ)

প্রথম হাদিস থেকে কয়েকটি মূলনীতি বেরিয়ে আসে। ১। শ্রমিক মালিক ভাই ভাইঃ ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক মালিক মর্যাদাগত কোন পার্থক্য নাই, তারা ভাই ভাই। ২। শ্রমিক মালিকের জীবনমান সমান থাকবে। এই সাম্যের অর্থ হলো মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে সমান তবে গুণগত মানে পার্থক্য থাকতে পারে। যেমন মালিক উন্নত খানাপিনা, পোশাক ও সাত তলায় থাকবে কিন্তু শ্রমিক মানসম্পন্ন খাবার, শীত গ্রীষ্মের উপযোগী পোশাক ও বাসস্থান পাবে ইত্যাদি। ৩। কাজের সময় ও প্রকৃতিঃ শ্রমিকের উপর সাধ্যাতিত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এর অর্থ হলো শ্রমিকের জন্য ১৬ ঘন্টা শ্রম সময় হারাম।

তেমনি ভাবে প্রকৃতিগতভাবে কোন কঠিন কাজ যা তার জন্য কষ্টকর হবে বা তার ক্ষতির কারণ হতে পারে- এমন কাজের ক্ষেত্রে মালিক নিজে হোক বা অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে হোক তাকে সাহায্য করতে হবে। ৪। উৎপন্ন খাদ্য ও পণ্যে শ্রমিকের অংশীদারিত্বঃ দ্বিতীয় হাদীস দ্বারা প্রমাণিত- শ্রমিক যদি খাদ্য তৈরি করে তবে তাকে খাদ্যে ভাগ দিতে হবে। তৃতীয় হাদীস দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে- শ্রমিক যদি পণ্য উৎপাদন করে তবে সেই পণ্যে তাকে ভাগ দিতে হবে। এটা দান নয় শ্রমিকের হক্ব- প্রাপ্য। কারণ প্রাপ্য না হলে বঞ্চনা শব্দ ব্যবহার করা হতো না। তাছাড়া শ্রমিক হল আল্লাহর মজুর মালিকের নয়। এখন প্রশ্ন হল, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র কি শ্রমিক শ্রেণীর জন্য এর চেয়ে উত্তম ফয়সালা দিতে পেরেছে? কাজেই সবাইকে ইসলামিক শ্রম নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। সেই সাথে শিল্প কারখানায় বছর শেষে হিসাব করে শ্রমিকদের মুনাফার অংশ দেওয়া আবশ্যক। তার জন্য শ্রমিক সংগঠনগুলিকে ভোট জিহাদ করতে হবে। অর্থাৎ যে দল তাদের দাবী মানবে সেই দলকে তারা ভোট দিবেন।

আরো অন্যান্য অধিকারঃ যেমন (১) সন্তানের অধিকার হলো- আযান-আকিকা থেকে নিয়ে শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-নকরি, বিয়ে-শাদী পর্যন্ত পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের অবহেলায় সন্তানের ক্ষতি হলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। (২) পিতা মাতার খেদমত আল্লাহর পরেই ইবাদত বলে গণ্য। তাদের প্রতি আহ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা হারাম। পিতার চেয়ে মাতার অধিকার তিনগুণ বেশি (৩) প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, জিব্রাইল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অব্যাহত ভাবে ওসিয়ত করতে থাকেন। আমার ধারণা হতে লাগলো যে, তিনি প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবেন (বুখারী মুসলিম)। (৪) মুসাফির ও মেহমানকে ন্যূনতম তিন দিন বাসস্থান ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। (বুখারি) বস্তুত ইসলাম প্রতিটা ব্যক্তি ও মানব জীবনের দুলনা থেকে কবর পর্যন্ত প্রতিটা পর্যায়ের কোন কিছু বাদ দেয়নি বরং এমন ইনসাফ পূর্ণ বিধান দিয়েছে যা পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদে পাওয়া যায় না।

বিজ্ঞানঃ বিজ্ঞান চর্চা ব্যতীত মানব কল্যাণ সম্ভব নয় তেমনি কোরআনের অনেক আয়াত বুঝা যায় না। যেমন আমরা সূরা আলাকের দ্বিতীয় আয়াতের অনুবাদ করি 'আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিণ্ড (আলাক) থেকে। অথচ আলাক ও তদ্ভব সকল শব্দের অর্থ- লেগে থাকা, জুড়ে থাকা, লটকে থাকা। আবার রক্ত মরে গেলে জমে যায় বিধায় তা থেকে প্রাণের উদ্ভব হতে পারে না। বিষয়টা চৌদ্দশত বছর পর এসে গত শতকে খ্রিস্টান ডাক্তার মরিস বুকাইলি দেখালেন যে, নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ু প্রাচীরে লেগে থাকে জুড়ে থাকে- যা ভ্রূণে রূপান্তরিত হয়। অথচ কোন মুসলমানের পক্ষে এ তথ্যটা দেয়া সম্ভব হয়নি। এভাবে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট অনেক আয়াত পরিত্যক্ত পড়ে আছে বা ভুল তরজমা করা হচ্ছে।

জিহাদঃ জিহাদ হলো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ম্যাগনাকার্টা। হুজুমি জিহাদের উদ্দেশ্য কাউকে কলেমা বা নামায পড়ানো নয় বরং কলেমা না পড়লে জিজিয়া-খারাজ দিতে হবে, পড়লে যাকাত-উশর-খুমুস দিতে হবে। অস্বীকার করলে মুসলিম-অমুসলিম উভয় শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে। কারণ এটা দরিদ্রের হক, এটা মানবাধিকার। আর দরিদ্রের হক বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামই জিহাদ। কাজেই যারা বলে জিজিয়া অমুসলিমদের জন্য লজ্জাকর তাদের কাছে প্রশ্ন, তাহলে কি মুসলমানদের জন্য যাকাত সৎকা-ফিতরা লজ্জাকর নয়? আসলে উভয়টি একই বিষয় অর্থাৎ দরিদ্রের হক। উল্লেখ্য যে, কিতাল অর্থ সশস্ত্র যুদ্ধ আর জিহাদ অর্থ প্রচেষ্টা, আন্দোলন-সংগ্রাম। প্রতিটি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জিহাদ ফরজ- যা আমরা বর্জন করেছি।

যেমন- মুসলিম বিশ্বঃ শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বে ১২৫৮ সালে হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংসের ন্যায় বর্তমানেও শিয়া- সুন্নী দ্বন্দ্বে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়ামেন ধ্বংস হয়ে গেছে, ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বে আফগানিস্তান ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ শিয়া- সুন্নী যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জিহাদ (আন্দোলন সংগ্রাম) করা, তাদের দূতাবাস ঘেরাও করা ফরজ ছিল যা আমরা করিনি। দলীল- (১) যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। (হুজরাত- ৯)। (২) আর তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর রাহে লড়াই করছ না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর; এখানকার অধিবাসীরা যে জালিম! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অভিভাবক নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও। (নিসা- ৭৫) মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে উম্মাহর সমস্যাগুলির সমাধান করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গঃ গণতন্ত্রের নামে হরতাল দিয়ে মানুষ হত্যা ও সম্পদ ধ্বংস, অতলান্ত দুর্নীতি, অবৈধ অর্থ উপার্জন, অর্থপাচার, ছাত্র ও যুব রাজনীতির নামে ছাত্র হত্যা ও মানুষ হত্যা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নারী নির্যাতন- ধর্ষণ- পাচার ইত্যাদি অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম, প্রতিরোধ গড়ে তোলা (জেহাদ) ফরজ ছিল যা আমরা করিনি। দলীল- (১) ফিতনা নির্মুল না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও। (বাক্বারা- ১৯৩) (২) তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের চয়ন করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে, দুর্নীতি প্রতিরোধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। (আল-ইমরান- ১১০) কাজেই এসব বিষয়ের জন্য ভোট জিহাদ করতে হবে। অর্থাৎ যে দল দাবী মানবে সেই দলকে আমরা ভোট দিব।

জিহাদ ও খিলাফতের উদ্দেশ্যঃ হক্কুল্লাহ প্রতিষ্ঠার নাম যদি খিলাফত হয় তাহলে তো বলতে হয় সারা দুনিয়ায় খিলাফত চলছে। কারণ কোন দেশেই নামায-রোযা, মসজিদ-মাদরাসায় বাধা দেয়া হচ্ছে না। বস্তুত জিহাদের ন্যায় খিলাফতেরও প্রধান উদ্দেশ্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, কলেমা বা নামায পড়ানো নয়। দলীল- খোলাফায়ে রাশেদার কার্যক্রম ও ঘোষণা। তারা বলেননি যে, কেউ নামায রোযা না করলে গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে বরং তাদের সকল কার্যক্রম, চিঠি-পত্র ও ফরমান মানুষের আর্থিক ও বিচারিক অধিকার সংক্রান্ত। কাজেই এ যুগে খিলাফত (মানবাধিকার) প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ্ব-জেহাদের দরকার নাই বরং ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকারগুলি প্রচার করলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবে। কাজেই জিহাদের অপব্যাখ্যায় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যারা নিজেদের ইহকাল পরকাল নষ্ট করছেন এবং ইসলামের ক্ষতি করছেন- তাদের প্রতি আবেদন, আল্লাহর ওয়াস্তে ধ্বংসাত্মক পথ বর্জন করে মূলধারায় ফিরে এসে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বা ভোট জেহাদে শরিক হোন। এটাই জিহাদ এটাই ইসলাম।

ফিরকা বিভক্তির বিধানঃ কোরআন-হাদিসে ফিরকাবাজির ন্যায় অন্য কোন বিষয়ের জন্য এত কঠোরতা আরোপ করা হয়নি। কারণ নামাজ রোজা না করলে ব্যক্তির ক্ষতি হয় কিন্তু ফিরকা বিভক্তির কারণে ইসলাম ও উম্মাহর ক্ষতি হয়। বর্তমান মুসলিম জাতির অবস্থাই এর প্রমাণ। এ বিষয়ে 'ইসলামে ফিরকা-বিভক্তির বিধান' গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি আয়াত তুলে ধরা হল।

১। তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু (কোরআন) মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করে বিভক্ত হয়ো না ৷ আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো ৷ (আল-ইমরান/১০৩)

২। সেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। তাদেরকে বলা হবে, ঈমানের নিয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরী করেছিলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই নিয়ামত অস্বীকৃতির বিনিময়ে আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো। (আল-ইমরান- ১০৬)

ব্যাখ্যাঃ প্রথম আয়াতে ঐক্য ফরয বিভক্তি হারাম করা হয়েছে, মাঝের আয়াতগুলিতে বিভিন্ন সতর্কবার্তা দিয়ে ১০৬ নং আয়াতে ফিরকাবাজদের কাফের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যেমন 'তোমরা কি ঈমান আনার পর কুফুরি করেছিলে'? ইমাম কুরতুবী এ আয়াতের দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় হাউজে কাওসার ও ৭২ ফিরকার হাদিসসহ বিস্তারিত আলোচনার পর বলেন 'যারা বিদআত সৃষ্টি করবে (মান গায়্যারা, বাদ্দালা, ইবতাদাআ ফী দ্বীনিল্লাহ) এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে (মান খালাফা জামাতাল মুসলীমিনা ওয়া ফারাকা) তারা কাফের হয়ে যাবে, তবে কাফেরে জাহেদ নয়। (ফরয অস্বিকার করলে কাফের হয়ে যায়)

৩। এ ছাড়াও তাঁর নির্দেশ হচ্ছে এইঃ এটিই আমার সোজা পথ। তোমরা এই পথ অবলম্বন কর, ভিন্ন ভিন্ন মত-পথ অবলম্বন করো না তাহলে তোমরা বিভক্ত হয়ে যাবে। (আনআম- ১৫৩) ব্যাখ্যাঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন 'রাসূল (সাঃ) মাটিতে একটি সরল রেখা টেনে বললেন এটা সিরাতে মুস্তাকিম। তারপর এর ডানে-বামে কয়েকটি রেখা টেনে বললেন এগুলির প্রত্যেকটার উপর একজন করে শয়তান বসে মানুষকে সে দিকে আহবান করছে। অর্থাৎ এই ডান বামের রেখা বা রাস্তাগুলি হল বিভিন্ন ফিরকা- যার মুরুব্বীরা স্ব-স্ব ফিরকার দিকে আহবান করছেন।

৪। তারা আল্লাহ্‌কে ছেড়ে দিয়ে তাদের আহবার ও রুহবানদের (আলেম ও পোরুহিতদের) রব (বিধানদাতা) হিসাবে গ্রহণ করেছে। (তওবা: ৩১) ব্যাখ্যাঃ রাসূল (সাঃ) আদি বিন হাতেমকে (রাঃ) বলেছেন 'আয়াতের অর্থ ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে ইবাদত-বন্দেগী করা নয় বরং তারা আল্লাহ প্রদত্ত হালালকে হারাম আর হারামকে হালাল করে আর অনুসারীরাও তা মেনে নেয়'। (যেমন মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তা'লা ঐক্য এবং হক্কুল ইবাদ ফরজ করেছেন কিন্তু মুরুব্বীরা বিভক্তি ফরজ এবং হক্কুল ইবাদ বর্জন করেছেন এবং আমরাও তা মেনে নিয়ে তাদেরকে রব (বিধানদাতা) হিসাবে গ্রহণ করেছি)।

৫। আপনাদের এই উম্মত সব তো একই ধর্মের অনুসারী এবং আমি আপনাদের পালনকর্তা; অতএব আমাকে ভয় করুন। অতঃপর মানুষ তাদের বিষয়কে (ধর্ম) বহুধা বিভক্ত করে দিয়েছে ফিরকা বা কিতাবাদির ভিত্তিতে (যাবুর)। প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত হচ্ছে। (মুমিনুন- ৫২, ৫৩) ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনে জারীর তাবারি অত্র আয়াতের দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় বলেন, তারা দ্বীনকে বিভক্ত করল কিতাবাদির ভিত্তিতে- যেগুলি তারা নিজেদের মযহাব প্রতিষ্ঠার জন্য দলীল আদিল্লা হিসাবে উদ্ভাবন করেছে। খ। ইমাম কুরতুবি উক্ত আয়াতের চতুর্থ ব্যাখ্যায় ৭২ ফিরকার হাদীস এনে মুসলমানদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন- তারা মাযহাবি কিতাবাদির ভিত্তিতে দ্বীনকে বিভক্ত করে।

৬। বলুনঃ হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আস-যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান- যে, আমরা আল্লাহকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না, তাঁর সাথে কোন শরীক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া নিজেরা পরস্পরকে রব হিসাবে গ্রহণ করব না। (আল-ইমরান- ৬৪)। ব্যাখ্যাঃ অন্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্য তো দূরের কথা বরং আমরা একক উম্মাহ হয়েও বিভক্তির প্রতিযোগিতা করছি।

৭। নিঃসন্দেহে যারা তাদের ধর্মকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দল হয়ে গেছে, তাদের জন্য তোমার (রাসূলের) কোন দায়দায়িত্ব নেই। নিঃসন্দেহ তাদের ব্যাপার আল্লাহ্‌র উপর ন্যস্ত, তিনিই পরকালে তাদের জানাবেন যে তারা কী করেছিল। (আনআম- ১৫৯) ব্যাখ্যাঃ আয়াতের অর্থ স্পষ্ট। অর্থাৎ ফিরকাবাজদের সাথে রাসূল (সাঃ) এর কোন সম্পর্ক থাকবে না। (ব্যাখ্যা সূত্রঃ তাবারি, কুরতুবী, ইবনে কাসিরসহ অন্যান্য তাফসীর)

বিভক্তির কারণঃ ভারতবর্ষে আকিদা ও বুনিয়াদি বিষয় বহির্ভূত অপ্রয়োজনীয় যেমন- রাসূল (সাঃ) নূরের সৃষ্টি নাকি মাটির সৃষ্টি তিনি গায়েব জানেন কিনা, মিলাদ-ক্বিয়াম, 'আম্বিয়ায়ে কেরামের ইসমত ও সাহাবায়ে কেরামের মি'য়ার, মাযহাব ও তাকলীদ জায়েজ না হারাম ইত্যাদি বিদআত নিজেরাই সৃষ্টি করে আকিদার নামে বিভিন্ন ফিরকার জন্ম দিয়ে উম্মাহকে বিভক্ত করে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। অথচ শরয়ী বুনিয়াদি বিষয় বহির্ভূত এসব বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে কোরআন-হাদীসের কোন দলিল নাই, জান্নাত-জাহান্নামের সংবাদ দেয়া হয়নি, ইহকালে পরকালে প্রয়োজনীয় কোন বিষয় নয়। অর্থাৎ শিক্ষা-পরীক্ষা, চাকরি, বিয়ে-শাদী বা কবরে এ জাতীয় কোন প্রশ্ন হয় না। সাধারণ মানুষ ও ছাত্রসমাজ এসব বুঝেও না মাথাও ঘামায় না, শুধু মুরুব্বীরা আকিদার দোহাই দিয়ে তাদেরকে বিভক্ত করে ইহকাল পরকাল ধ্বংস করছেন। অথচ ঈমান-আকিদার সংজ্ঞা হল- ক। নিশ্চয় যারা মুসলমান, যারা ইহুদী, ছাবেয়ী বা খ্রীষ্টান, তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহর প্রতি, কিয়ামতের প্রতি এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। (মায়েদা- ৬৯) খ। রাসূল (সাঃ) বলেন 'মান ক্বালা লা ইলাহা--- যে কলেমা পড়বে সে জান্নাতে যাবে। (বুখারি) এরপরেও ইমামগণ ঈমান-আকিদার পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন- আমান্তু বিল্লাহি ওয়া মালায়িকাতিহি---- অর্থাৎ আল্লাহ, ফিরিস্তা, আসমানি কিতাবসমূহ, সকল নবী রাসূল, কিয়ামত দিবস, তাকদীরের ভাল-মন্দ, পুনরুত্থান- এই সাতটি বিষয়ের উপর যে ঈমান আনবে সে মুসলমান- পাক্কা মুসলমান। সে যত বড় পাপীই হোক (ইন যানা ও ইন সারাক্বা) তার সাথে ফিরকা- বিভক্তি হারাম।

আলাইকুম ইছমুল আরিসিয়্যীনঃ উল্লেখিত বিষয়গুলি ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা থেকে বাদ পড়ে গেছে। এখন শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের কাছে প্রশ্ন হলো- ফিরকাবাজি জায়েজ কিনা? শরীয়ত বহির্ভূত অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে নিজেরাই কৃত্রিম বিতর্ক সৃষ্টি করে উম্মাহকে বিভক্ত করে পরস্পরের শত্রু বানিয়ে দুর্বল করে পশ্চিমাদের দাস বানিয়ে ইহকাল-পরকাল নষ্ট করা জায়েজ কি না? এই বিভক্তির মাধ্যমে ইসলামের খিদমত হচ্ছে নাকি ক্ষতি হচ্ছে? ফিরকাবাজি করে আমরা ইসলাম ধ্বংস করছি নাকি রক্ষা করছি? কোরআন কি ফিরকাবাজির জন্য নাযিল হয়েছিল? রাসূল (সাঃ) কি কোরআনের মাধ্যমে আরবদের বিভক্ত করেছিলেন? এসব ফতোয়া জাতির সামনে প্রকাশ করুন এবং সর্বাত্মক ঐক্যের ঘোষণা দিন। আমাদের সুন্নিদের প্রধান ছয়টি ফিরকা হল- দেওবন্দ, তাবলীগ, জামাতে ইসলামী, বেরলভী, আহলে হাদিস ও সালাফি। এ ছয়টি ফিরকার প্রধান ছয়জন মুরুব্বির উপর ইসলাম ও উম্মাহর কল্যাণ- অকল্যাণ নির্ভর করছে। তারা যদি ঐক্যের ডাক দেন তাহলে উম্মাহর ঐক্য ও মুক্তি নিশ্চিত হয়ে যাবে। উম্মাহর এই দুর্দিনে এখনো নিশ্চুপ বসে থাকলে ‘আলাইকুম ইছমুল আরিসিয়্যীন’ উম্মাহর পতনের দায় সম্পূর্ণ আপনাদের উপর বর্তাবে। কারণ কুরআন সুন্নাহ উপেক্ষা করে রাসূলের একক উম্মাহকে বিভক্ত করার অধিকার কারো নাই। আর অনুসারীদের উপর ফরজ হলো মুরুব্বিদেরকে বিনয়ের সাথে ঐক্যের জন্য বাধ্য করা।

ইসলাম ও অন্যান্য মতবাদঃ এখন প্রশ্ন হল, ইসলাম যে মানবাধিকার দিয়েছে তা কি বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দিতে পেরেছে নাকি এর ধারে কাছে ঘেষতে পেরেছে ? কাজেই পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের চেয়ে ইসলাম শ্রেষ্ঠ- এতে কারো সন্দেহ থাকলে আসুন আমরা আলোচনা করে ফায়সালা করি। এখন আমাদের আহ্বান হল, ভিনদেশ ও ভিন জাতির তন্ত্র-মন্ত্র বাদ দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলুন আমরা সম্মিলিতভাবে ইসলামী বিধান বাস্তবায়ন করি।

পর্যালোচনাঃ আলোচ্য বিষয়গুলিসহ পার্থিব জীবন সংশ্লিষ্ট হুকুমত (রাষ্ট্র রাজনীতি প্রশাসন আইন বিচার অর্থনীতি সমাজবিদ্যা ইত্যাদি) ও মানবাধিকার সংক্রান্ত সকল বিষয় কোরআন সুন্নাহ থেকে বাদ পড়ে গেছে। অর্থাৎ এগুলি কোন ফিরকার সিলেবাসে নাই, এমনকি মাদ্রাসা সিলেবাসেও নাই, এ জাতীয় কোন কিতাব পাঠ্যভুক্ত নাই, পরীক্ষায়ও এজাতীয় কোন প্রশ্ন করা হয় না। সঙ্গত কারণেই আমরা এসব বিষয় জানি না, এগুলির প্রচার-প্রসার ও বাস্তবায়নের চেষ্টাও করি না। আমরা সকল ফিরকা শুধু পারলৌকিক- হক্কুল্লাহ অংশটা নিয়ে ব্যস্ত আছি আর হুকুমত ও মানবাধিকার অংশটা বর্জন করেছি। অর্থাৎ ইসলামের সেই অংশটা বাদ পড়ে গেছে যার দ্বারা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মোকাবেলা করা যায়, সেই সুবাদে ইলায়ে কালিমাতিল্লাহ- মুসলিম বিশ্ব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। এ কারণেই আমাদের পশ্চিমা মতবাদের গোলামী করতে হচ্ছে। কাজেই ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা সাত দফা দাবি পেশ করছি। তার জন্য ভোট জিহাদ করতে হবে অর্থাৎ যারা দাবি মানবে আমরা তাদের ভোট দিব।

সাত দফার আন্দোলনঃ
মুসলিম বিশ্বঃ কামাল আতাতুর্ক ১৯২৪ সালে উসমানিয়া খেলাফত বিলুপ্ত করার পর থেকে বিগত ১০০ বছর ধরে মুসলিম জাতির উপর দিয়ে যে কিয়ামতের বিভীষিকা বয়ে যাচ্ছে- তাতে প্রমাণ হয় যে ইসলামের নির্দেশ মোতাবেক একটা কেন্দ্র ব্যতীত মুসলিম জাতি টিকে থাকতে পারবে না। কাজেই মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা ফরজ। সাবেক তুর্কি প্রেসিডেন্ট নাজমুদ্দিন এরবাকানসহ অনেকেই আশা প্রকাশ করেছিলেন ভারতকে সাথে নিয়ে মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে পরাশক্তি গুলির বিরুদ্ধে একটা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলা। এর উদ্দেশ্য হলো- (১) ন্যাটোর ন্যায় সামরিক জোট গঠন করে মুসলিম বিশ্বের সকল সমস্যার সমাধান করা। (২) রোহিঙ্গাসহ পৃথিবীর সকল মুস্তাদআফ- উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা ও অক্ষমদের ভাতা দেয়া। (৩) ইউরোপীয় ইউনিয়নের ন্যায় মুসলিম বিশ্বে একই শিক্ষা, মুদ্রা, আইন, ভিসাহীন ভ্রমণ, উন্মুক্ত কর্মসংস্থান থাকবে। (৪) ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে বিজ্ঞান ও বাণিজ্যে বিশ্বে প্রাধান্য বিস্তার করতে হবে। (৫) ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধ ও মুসলিম জাতিসংঘের দাবিতে সৌদি-ইরানসহ সকল মুসলিম দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদানসহ প্রয়োজনে অবরোধ করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গঃ বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলি হল- ত্রিমুখী শিক্ষা, দুর্নীতি, অর্থপাচার, দরিদ্র ও দুর্বলের অধিকার, ধর্মীয় ফিরকা- বিভক্তি ও গণতন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ। এগুলি প্রতিকারের লক্ষে আমরা ছয় দফা গণইশতেহার পেশ করছি।

১। শিক্ষা সংস্কারঃ আধুনিক সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থাটাই বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দর্শন অনুযায়ি গড়ে তোলা হয়েছে। তারা এসবের প্রচার-প্রসার ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকরের চেষ্টা করেন, কারণ তারা ইসলাম সম্পর্কে জানেন না। ফলে ত্রিমুখী শিক্ষার প্রভাবে জাতির মন মানসিকতা চিন্তাধারা জীবনাচার ত্রিমুখী ও সাঙ্গঘর্সিক ধারায় বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে।

সেকুলার শিক্ষার প্রভাবে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির অবস্থা তো দেখাই যাচ্ছে, সেই সাথে শুধু পরকালমুখী শিক্ষার প্রভাবে মাদ্রাসা শিক্ষিতরা রাষ্ট্র ও রাজনীতির অযোগ্য হয়ে শুধু দান-খয়রাত নির্ভররূপে গড়ে উঠছে। এই হল পশ্চিমা মতবাদের বিজয় আর ইসলামের পরাজয়ের কারণ। কাজেই এখন মুসলিম জাতির প্রধান ফরজ হচ্ছে ত্রিধারায় বিভক্ত শিক্ষাকে একমুখী করা। যেমন কোরআন-হাদিস থেকে বাদ পড়া হুকুমত ও মানবাধিকার অংশটা শিক্ষা সিলেবাসে ফিরিয়ে আনলে মুসলিম জাতির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই সাথে রেনেসাঁও শুরু হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব হল- সমগ্র সিলেবাস ও নম্বর বন্টন তিনভাগে বিভক্ত করতে হবে। অর্থাৎ কোরআন-হাদিস-ফিকহ এবং দাওরা, কামিল ও ইসলামিক স্টাডিজের কিতাবাদি ও নম্বর বন্টন হবে- ৪০% হক্কুল্লাহ সংক্রান্ত অজু গোসল নামাজ রোজা ইত্যাদি ফিকহের বিষয়াদি, ৩০% রাষ্ট্র রাজনীতি প্রশাসন, আইন-বিচার, অর্থনীতি সমাজনীতি ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাংকিং ইত্যাদি বিষয়াদি, ৩০% মানবাধিকার সংক্রান্ত যা আমি পূর্বে আলোচনা করেছি। এ সিলেবাস প্রণয়ন শুধু কোরআন- হাদিসের ভিত্তিতেও হতে পারে অথবা সকল ধর্ম ও শাস্ত্রের সমন্বয়েও হতে পারে। সংখ্যালঘুদের জন্য তাদের স্ব স্ব ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। আলেম সমাজ, মাদরাসা ছাত্র ও সকল মুসলমানের এ দাবীতে ভোট জিহাদ করা ফরয। এ সম্পর্কে 'শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন' গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

২। দুর্নীতি নির্মূলঃ বাংলাদেশে দুর্নীতি সার্বজনীন অর্থপাচার জাতীয়করণ করা হয়েছে। চিরতরে এই দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে চাইলে- শাসন ব্যবস্থার প্রথম ইউনিট হতে হবে মসজিদ ভিত্তিক। অর্থাৎ প্রত্যেক ওয়ার্ডের প্রধান মসজিদের ইমাম, মসজিদ কমিটি, প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান- তারা মিলে বোর্ড গঠন করবেন। এভাবে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কমিটি গঠিত হবে। এই বোর্ডের কাজ হল- (ক) যাকাত উত্তোলন ও বিতরণ, বন্যা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন এবং ত্রাণ বিতরণ করা। (খ) গ্রামীণ সালিশি ও মামলার প্রাথমিক তদন্ত ভার গ্রহণ করা। (গ) দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্তদের বিনা সুদে সরকারি ঋণ প্রদান ও উসুল। এই বোর্ড ইমামের নেতৃত্বে আরো অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবেন এবং সরকারি স্কেল অনুযায়ী ইমামগণ বেতন পাবেন। এসব কাজ জুমার দিন সকলের সামনে সম্পাদন করা হবে বিধায় ন্যূনতম দুর্নীতির সম্ভাবনাও থাকবে না। অঙ্কুরেই দুর্নীতি বিনষ্ট করার জন্য এর বিকল্প নেই। সাড়ে তিন লক্ষ মসজিদের ১০ লক্ষ ইমাম মুয়াজ্জিন খাদেমের পরিবার, মুসুল্লী ও অনুসারীসহ কয়েক কোটি ভোটার আছে। যে দল ইমামদের দাবি মানবে তারা সেই দলকে ভোট দিবেন।

৩। পাচারকৃত অর্থঃ দেশের কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ঋণ আবার বিদেশে পাচার হয়েছে তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি টাকা। এর অর্থ হল এক দিক দিয়ে ঋণ আনা হয়েছে অন্য দিক দিয়ে পাছার হয়েছে। এই ঋণের টাকা আমরা দেখিও নাই ভোগও করি নাই বিধায় এই ঋণের এক টাকাও আমরা জনগণ দিব না। পাছারকৃত টাকা উদ্ধার করে অথবা দেশে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। যে দল এই দাবি মানবে আমরা তাদের ভোট দিব।

৪। মুস্তাদআফের অধিকারঃ পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে যে, মুস্তাদআফ- প্রলেতারিয়েত গোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও ভাতা প্রদান করতে হবে। এজন্য সকল অবৈধ সম্পদ ফেরত আনতে হবে। (খ) নিহতদের পরিবারকে দিয়ত (রক্তমূল্য) দিতে হবে। ধর্ষিতা ও এসিড আক্রান্তা মেয়েদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। (গ) কৃষিখাতে জ্বালানি সম্পূর্ণ ফ্রী করতে হবে এবং সার ও কীটনাশকে ভর্তুকি দিতে হবে। (ঘ) গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানার শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করতে ইসলামি শ্রম আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। (চ) নারী-শিশু-সংখ্যালঘু ও শ্রমিকের ইসলাম প্রদত্ত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই প্রত্যেকটা শ্রেণি একেকটা সংগঠন করে ঘোষণা দিবেন- যারা আমাদের দাবি মানবে আমরা তাদের ভোট দিব।

৫। শরিয়া আদালতঃ উম্মাহর পতনের কারণ হল- (১) ফিরকা বিভক্তি (২) কোরআন সুন্নাহ থেকে হুকুমত ও মানবাধিকার অংশটা বাদ যাওয়া (৩) কোরআন সুন্নাহ উপেক্ষা করে সবাই স্ব স্ব ফিরকা ও সিলেবাসকেই সঠিক ইসলাম মনে করে অনুসরণ ও প্রতিনিধিত্ব করা। (৪) বিদআত ও ফিরকার জন্ম দিয়ে হক্কুল্লাহ নষ্ট করা হয়েছে, হুকুমত ব্যবস্থা নাই এবং রাষ্ট্র ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকার আদায় করে না। কাজেই ইসলাম কোথায়? কোরআন ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ কবজের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন শরিয়া আদালতে এসব বিষয়ের ফয়সালা ও প্রত্যেক ফিরকার ভুলগুলি প্রমাণ ব্যতীত কোরআনে ফিরে আসাও সম্ভব হবে না উম্মাহর মুক্তিও জুটবে না। কাজেই এ সকল সমস্যা সমাধানের লক্ষে প্রত্যেক ফিরকা থেকে একজন করে বিজ্ঞ আলেম নিয়ে উলামা পরিষদ/ ফতোয়া বোর্ড/ শরিয়া আদালত গঠন করে ঈমান ও উম্মাহ রক্ষার ব্যবস্থা করা ফরয। কারণ পার্থিব ধান- চাল-গরু-মুরগি চুরির ন্যায় ঈমান চুরির বিচারের জন্যও আইন আদালত থাকতে হবে। যে দল শরিয়া আদালত গঠন করে দিবে আমরা সকল ফিরকার অনুসারীরা তাদেরকে ভোট দিব।

৬। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ফলাফলঃ বাস্তবতা তো এটাই বলে প্রচলিত বুর্জোয়া গণতন্ত্র একটা জাহেলী মতবাদ। কারণ- (১) চিরন্তন যুদ্ধঃ আগেকার দিনে কালে ভদ্রে কোন দেশ আক্রান্ত হতো যুদ্ধ হতো কিন্তু গণতন্ত্রের সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে চিরস্থায়ী চলমান যুদ্ধের ব্যবস্থা করা হয়েছে (২) আগেকার দিনের যুদ্ধে রাজা ও সৈন্য মরত সাধারণ মানুষের কোন ক্ষতি হতো না। কিন্তু গণতন্ত্রের সরকারি দল ও বিরোধী দলের যুদ্ধে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয় ও তাদের সম্পদ ধ্বংস করা হয়। (৩) হরতালঃ সৃষ্টির আদি থেকে বা জাহেলি যুগে এমন কোথাও দেখা যায়নি যে কোন রাজা-বাদশা সরদার নেতা তার অনুগত প্রজাকে আগুনে পুড়িয়ে বা বুলেটে ঝাঁঝরা করে হত্যা করেছে এবং খেটে খাওয়া প্রজাদের ধন-সম্পদ, বাড়ি- গাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য ভেঙ্গে চুরে বা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের সাধের গণতন্ত্র এ কাজগুলিই করছে। (৪) ছাত্র ও যুব রাজনীতিঃ যে ছাত্ররা এক মুঠো ভাত ভাগ করে খাওয়ার কথা সেখানে বিশ্বজিৎ আবরার ফাহাদের মতো ছাত্রদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, মানিকরা ধর্ষনের সেঞ্চুরি উৎসব পালন করে। (৫) দেশে মারামারি খুনাখুনি দুর্নীতি অর্থ পাচার নারী নির্যাতন ইত্যাদি সকল অপরাধ রাজনৈতিক কারণে বা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ৯০% বা ৮০% সংগঠিত হচ্ছে (৬) জুলুম নির্যাতনঃ যে দলই বিরোধী দলে থাকেন তারা গুম খুন জুলুম নির্যাতনের শিকার হন, পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে বলা হয় গরুর রক্ত মাখিয়ে গিয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে। (৭) রোহিঙ্গাবস্থাঃ বিরোধী দলের অনেক নেতা কর্মী রোহিঙ্গা হয়ে যায়। অর্থাৎ জেলে বা বিদেশ গিয়ে সরকার পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকে (৮) মহিলা নেত্রীদের রাজপথে কাপড় খুলে নেয়ার উদাহরণ আছে (৯) বাকযুদ্ধঃ শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে এমন সব অসত্য আজগুবি কথা বলেন যে তারা জনগণের উপহাসের পাত্রে পরিণত হন। (১০) রক্তাক্ত প্রান্তরঃ সামনের নির্বাচন উপলক্ষে দেশটা আবার জাহান্নামে পরিণত হবে। কাজেই গণতন্ত্রের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে আমরা সর্বদলীয়- যৌথ সরকার চাই।

মুস্তাদআফের তরফ থেকে ভোটের ডাক

শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদদের প্রতি আবেদনঃ আজন্ম রাজনীতি নিরপেক্ষ ও চির ভাগ্য বিড়ম্বিত বঞ্চিত মজলুম হিসাবে আমার প্রশ্ন হল, নামাজ রোজার মাধ্যমে আমরা হক্কুল্লাহ আদায় করছি কিন্তু আল্লাহ আমাদের যে হক রাষ্ট্রের উপর ফরজ করেছেন তা পাচ্ছি না কেন? একদিকে আমাদের অক্ষম অসহায়রা ডাস্টবিনে ও ফুটপাতে পড়ে আছে, অসহায় মেয়েরা পেটের দায়ে ইজ্জত নিলামে তুলছে, কেউবা বিদেশ গিয়ে এক হাত উঁচু পেট নিয়ে দেশে ফিরছে। পক্ষান্তরে আমাদের ক্ষুধার অন্ন কেড়ে নিয়ে লুটেরারা মদ মাৎসর্য্য নারীর আসরে মওজ করছে, বেগম পাড়ায় বিলাস-ব্যাসনে ডুবে আছে- এ বৈষম্যের জন্য দুনিয়াবাসীর কাছে না হলেও আকাশবাসীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে ? গণতন্ত্র নামক দেবতার উদ্দেশ্যে আর কতকাল জনগণের জানমাল বলি দেয়া হবে ? এসব জুলুমের বিরুদ্ধে প্রত্যেক মুসলমানের জিহাদ করা ফরয। কাজেই নেতৃবৃন্দের কাছে সবিনয় নিবেদন, এভাবে আমাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসার প্রতিদান না দিয়ে ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে আলোচ্য সাত দফা বাস্তবায়িত করুন। (২) ঐক্যমত্যের সরকার বা জাতীয় সরকার বা ইসলামী বিধান অনুসারে সরকার গঠন করে গণতন্ত্রের ধ্বংসলীলা থেকে জনগণকে মুক্তি দিন। তবে সংসদে ইসলামী বিধানগুলি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য আলেম এবং ইসলামী দলগুলিকে যুক্তি সঙ্গত আসন দেয়া আবশ্যক।

শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের কাছে আবেদনঃ প্রত্যেক ফিরকার আলেম ও মুরুব্বীদের কাছে সবিনয় প্রশ্ন, আমরা কি কোরআন বর্জন করে ফিরকাবাজিতে লিপ্ত থেকে ভাই ভাই কামড়াকামড়ি করে ইহকাল পরকাল নষ্ট করবো নাকি কোরআনের অনুসরণ করে বিশ্ব নেতৃত্বে যাব ? (১) কাজেই ধর্মীয় সমস্যা সমাধানের জন্য প্রত্যেক ফিরকা থেকে একজন করে বিজ্ঞ আলেম নিয়ে শরিয়া আদালত গঠন করে উম্মাহর মধ্যে ফরজ ঐক্য স্থাপন করুন। স্বাধীনতা উত্তর সর্বদলীয় আলেমগণের ব্যর্থ ঐক্য প্রচেষ্টার প্রতিক ‘ইত্তেহাদুল উম্মাহ’ এর ব্যানারে আমরা ঐক্য চাই, অন্তত সাত দফা আদায়ের লক্ষ্যে। (২) রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে মুস্তাদআফের প্রত্যেক শ্রেণী নিয়ে এক একটা সংগঠন গড়ে তুলুন। যেমন দরিদ্র অক্ষমদের সংগঠন, প্রতিবন্ধী বিকলাঙ্গদের সংগঠন, গুম খুন মজলুমদের সংগঠন, ধর্ষিতা নারীদের সংগঠন ইত্যাদি। তারপর ভোট জিহাদের ডাক দিন অর্থাৎ যারা সাত দফা মানবে তারা ভোট পাবে। (৩) উম্মাহর এই দুর্দিনে এখনো নিষ্ক্রিয় থাকলে ‘আলাইকুম ইছমুল আরিসিয়্যীন’ উম্মাহর পতনের দায় আপনাদের উপর বর্তাবে এবং আল্লাহর আদালতে দাঁড়াতে হবে।

ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতি আবেদনঃ কওমি ও আলীয়ার একজন শিক্ষক (মুহাদ্দিস) হিসেবে উভয় ধারার ছাত্র ও ইসলামী সংগঠনের ছাত্রদের প্রতি আমার ফরয দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে প্রশ্ন করছি, তোমরা কি কোরআন বর্জন করে ফিরকাবাজিতে লিপ্ত থেকে নিজেদের ইহ-পরকাল নষ্ট করবে নাকি কোরআনে ফিরে এসে ইহকালে বিশ্ব নেতৃত্ব আর পরকালে জান্নাত চাও? এ ফিতনার যুগে কোরআন দ্বারা যাচাই ব্যতীত কোন ফিরকার অনুসরণ জায়েয নাই। কাজেই কোরআনে ফিরে এসে দুটি বিষয়ের জন্য মার্টিন লুথারের ন্যায় প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন করা তোমাদের উপর ফরজ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে আমাকে ভাঙ্গা কোলা হিসাবে ব্যবহার করতে পার অর্থাৎ, কোরআন সুন্নাহ থেকে হুকুমত ও মানবাধিকার অংশটা বাদ পড়ে গেছে, আমাদের কোন ফিরকাই সঠিক ইসলামের উপর নাই এবং ইসলাম ও উম্মাহর পতনের জন্য আমরা আলেমরাই দায়ী- শরিয়া আদালতে এসব প্রমাণ করার দায়িত্ব আমার। আমাদের কৃতকর্মের কারণে উম্মাহর উপর খোদার গজব চলছে। কাজেই গজব থেকে বাঁচতে চাইলে কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক দুটি কাজ করলে আল্লাহর কসম ইহকালে পাবে বিশ্ব নেতৃত্ব আর পরকালে জান্নাত, ইনশাল্লাহ। (১) ঐক্য প্রতিষ্ঠাঃ তোমরা ‘ইত্তেহাদুল উম্মাহ’ নামে ঐক্যবদ্ধ হও, ঐক্যের জন্য সবিনয়ে মুরুব্বিদের বাধ্য করো, মিছিল মিটিং কর, উম্মাহ ধ্বংসকারী ফিরকা ও ফিরকার জননী বিদাতগুলি সাত তবকা মাটির নিচে দাফন কর, শরিয়া আদালত গঠন কর। তবে ইসলামের শ্রেষ্ঠ খেদমত হবে যদি কেউ হাইকোর্টে এ মর্মে আবেদন করেন যে, হাইকোর্ট ঈমান ও উম্মাহ রক্ষার জন্য শরিয়া আদালত গঠনের নির্দেশ দিবেন অথবা নিজেই ফিরকা বিভক্তির বিলুপ্তি ঘটাবেন। কেউ ঐক্যের অন্তরায় হলে ইসলাম ও উম্মাহর শত্রু হিসাবে ইঙ্কুইজিশন কোর্টের ন্যায় শরিয়া আদালতে তার ফায়সালা কর। (২) মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাঃ তাবলীগে পরকালীন লাভ দেখিয়ে আমল ইবাদতে উৎসাহী করার ন্যায় ইসলাম প্রদত্ত পার্থিব লাভের বিধানগুলি জলে স্থলে অন্তরীক্ষে নিরীক্ষে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, তজ্জন্য “তাবলীগে হক্কুল ইবাদ” নামে একটা প্রচার সংগঠন ও মিডিয়া প্রতিষ্ঠা কর। তারপর মুস্তাদআফের প্রত্যেক শ্রেণী নিয়ে একেকটা সংগঠন করে ভোট জেহাদের ডাক দাও এবং আলোচ্য সাত দফা বাস্তবায়ন কর। অন্যথায় নিজের খোরে নিজের কবর খননের নামান্তর হবে। এরপর সাধারণ ছাত্র ও যুব সমাজের সাথে ঐক্য প্রতিষ্ঠা কর।

(৩) ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ সর্বস্তরের ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে অন্তত বয়সে মুরব্বি হিসাবে আবেদন করছি, তোমরা কি ইংরেজের divide and rule নীতির অনুসারী হয়ে ভাই ভাই লাঠালাঠি করে মরবে নাকি ইসলামের ঐক্য, মৈত্রী, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবাধিকারের ঝান্ডা উঁচিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বে যাবে? কাজেই প্রকৃত ইসলাম বুঝার জন্য তোমরা আলোচনায় বস অথবা “মুসলিম ঐক্যের ডাক, ইসলাম ও জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার সনদ” বই দুটি পড়লেও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারবে। এখন তোমরা ইসলামপন্থী ও পাশ্চাত্য পন্থী ভাই ভাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ কর। (৪) কারণ- (ক) মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় রাজনৈতিক যেকোনো ফিরকা বিভক্তি হারাম (খ) বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়া আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন বিধায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে (গ) আওয়ামীলীগ বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল আমাদের পূর্বপুরুষরা গঠন ও পরিপুষ্ট করেছেন। কাজেই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক দলগুলির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে গণতন্ত্রের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে ঐক্যমত্যের সরকার ও আলোচ্য সাত দফা বাস্তবায়ন কর। (৫) তারপর ভারতকে সাথে নিয়ে মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে পরাশক্তি গুলির বিরুদ্ধে জোট নিরপেক্ষ শক্তি গড়ে তুলতে হবে। তজ্জন্য মুসলিম দূতাবাসগুলিতে যোগাযোগ, স্মারকলিপি প্রদানসহ প্রয়োজনে অবরোধ করতে হবে। তাহলে বিশ্ব নেতৃত্ব তোমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে, সেই সাথে পৃথিবীর তাবৎ সম্মান ও সম্পদ তোমাদের পদতলে লুটোপুটি খাবে। এভাবে ইটালি থেকে ইউরোপীয় রেনেসাঁর ন্যায় বাংলাদেশ থেকে মুসলিম রেনেসাঁর সূচনা হবে ইনশাআল্লাহ। আর যদি এ দায়িত্ব পালন না করা হয় তাহলে পূর্বের ইহুদি জাতির ন্যায় ইসলামপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থী আমরা কেউ খোদার গজব থেকে রেহাই পাবো না।

সবশেষে মাতাদ্বয়ের প্রতি আবেদনঃ অর্থাৎ মাননীয় প্রধান মন্ত্রি শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। প্রজা ও প্রজন্ম হিসেবে আমরা আপনাদের সন্তান। কাজেই মায়ের প্রতি আবেদন- একজন মুস্তাদআফ হিসেবে ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকারের কথা বলায় যদি আমাকে মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী আখ্যা দেওয়া হয় তাহলে নিজেকে মায়ের হাতে সমর্পন করলাম- যা ইচ্ছা বিচার করুন। আর যদি মানুষ মানবতা ও মুসলিম জাতির মুক্তি ও উন্নতি কামনা করেন- তাহলে আলোচ্য সাত দফা বাস্তবায়ন করুন, ধন বৈষম্য বিলুপ্ত করুন, মোস্তাদআফ শ্রেণীর পুনর্বাসন করুন ও ভাতা দিন, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিন, শরিয়া আদালত গঠন করে ঈমান ও উম্মাহ রক্ষার ব্যবস্থা করুন। বিশেষতঃ মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে বা ডাক দিয়ে মিল্লাতের মাতৃত্বের আসনটি অলঙ্কৃত করুন। তাহলে পাবেন দুইশ' কোটি মুসলমানের মাতৃত্বের শ্রদ্ধা আর পরকালে পাবেন আল্লাহর সন্তুষ্টি।

ইসলাম, মুসলিম ও মানবতার রক্ষা কবজ এক নজরে সাত দফা দাবি- (১) মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানদের সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে (২) কোরআন-সুন্নাহ থেকে বাদ পড়া হুকুমত ও মানবাধিকার অংশটা পাঠ্যভুক্ত করে ত্রিমুখী শিক্ষাকে একমুখী করতে হবে (৩) দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে মসজিদ ভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে (৪) অবৈধ ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে হবে অথবা তাদের দেশীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে (৫) মোস্তাদআফ শ্রেণীর পুনর্বাসন ও ভাতা দিতে হবে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে (৬) শরিয়া আদালত গঠন করে ধর্মীয় ফিরকা বিভক্তি মিটিয়ে ঈমান ও উম্মাহ রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। (৭) গণতন্ত্রের ধ্বংসলীলা থেকে জনগণের জান মালের নিরাপত্তা দিতে হবে। জাতীয় স্বার্থে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে উক্ত সাত দফা বাস্তবায়ন করতে হবে।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ