রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১১ জিলকদ ১৪৪৫


ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী মুসলিম প্রকৌশলী নাজমুদ্দিন হাসান আল রাম্মাহ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইসমাইল বিন আমিন ।। খৃস্টীয় ত্রয়োদশ শতক। সময়টা ছিলো চরম যুদ্ধ-বিগ্রহের । একদিকে মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব , ক্রুসেডারদের ধারাবাহিক আক্রমণ আর অপরদিকে তাতারদের তাণ্ডবলীলা ছেয়ে ফেলেছিলো পুরো মুসলিম দুনিয়া। এই শতকের প্রথম পাদে (১২২০-২৬ সালের মধ্যে) নাজিমুদ্দিন হাসান আল রাম্মাহ আল-আহদাব বর্তমান লেবাননের তারাবলিসে জন্ম গ্রহণ করেন।

তাঁর বাপ-দাদারা যুদ্ধবিদ্যা ও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী ছিলো।সে সূত্রে তিনিও তাঁর দীর্ঘ জীবন এই পথে অতিপান করেন। তাঁর নতুন নতুন আবিষ্কারগুলো অনেক শক্তিশালী বাহিনীর ভিত নাড়িয়ে দেয় রণাঙ্গনে , কাঁপন ধরায় শত্রুমনে।

আরব এবং চিনারা আগ থেকে বারুদ সম্পর্কে জানলেও চতুর্দশ শতকের পূর্বে সেটার মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানোর বিষয়টি কেউই জানতো না। বোমা বানানোর পদ্ধতি সম্পর্কে সর্বপ্রথম এই হাসান আল-রাম্মা'ই কলম ধরেন ।তাঁর আবিস্কৃত সমরাস্ত্রগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে বিজয় এনে দেয় মুসলমানদের জন্য।

১২৪৮ সালে সপ্তম ক্রুসেড শুরু হয় রাজা নবম লুইয়ের নেতৃত্বে। এই যুদ্ধে সর্বপ্রথম হাসানের উদ্ভাবিত কামান ব্যবহার হয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ঐতিহাসিক লর্ড জোইনভিলের মতে কামানের গোলাগুলোর পেছন দিকে বর্শার মতো আগুনের লেজ থাকতো। বাতাস ভেদ করে উড়ে আসতো, মাটিতে পড়ার পর আওয়াজ হতো বজ্রের মতো এবং পুরো রণাঙ্গন আলোকিত হয়ে যেতো। তিনি বলেন, " মুসলমানদের গোলা নিক্ষেপের আওয়াজ শুনলে আমাদের পুণ্যকৃৎ রাজা লুইস বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেন। দুই হাত প্রসারিত করে কেঁদে কেঁদে বলতেন, হে মহান ইশ্বর! আমার লোকদেরকে রক্ষা করুন।

এই যুদ্ধে ক্রুসেডাররা খুব বাজেভাবে পরাজিত হয়।যুদ্ধ শেষে হাসান নিজ এলাকায় ফিরে যান। গবেষণা এগিয়ে নেন সময়ের সাথেসাথে। ১২৬০ সালে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সুলতান কুতুজ তাঁকে ডেকে পাঠান। এতোদিনে তিনি তাঁর কামানের কার্যকারিতা আরো নিখুঁত করে তোলেন । সপ্তম ক্রুসেডে কামান ব্যবহারের কথা কিছু পশ্চিমা ঐতিহাসিক স্বীকার না করলেও আইনে জালুতের এই যুদ্ধকে সবাই সর্বপ্রথম কামান ব্যবহারের ক্ষেত্র হিসেবে মেনে নেন।যুদ্ধে কুতুজ আর বাইবার্সদের ঈমানী বল, তওয়াক্কুল আলাল্লাহ আর যথাযোগ্য নেতৃত্বের পাশাপাশি হাসানের কামান হয়ে ওঠে মোঙ্গলদের অসহায়ত্বের কারণ। তৎকালীন মোঙ্গলদের অপরাজেয় হবার যেই মিথ মানুষের অন্তরে গেঁথে গিয়েছিলো, তা উপড়ে ফেলে আইনে জালুতের এই যুদ্ধ।

মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে মিদফা' ব্যবহার বিষয়ে আরবী ভাষায় লিখিত ৪টি প্রমাণপত্রের উপর নির্ভর করা হয়। তন্মধ্যে একটি রয়েছে রাশিয়ার সান পিটার্সবার্গে (এটি সবচে প্রসিদ্ধ),দুটি প্যারিসের জাতীয় বইঘরে আর একটি ইস্তম্বুলে। আইনে জালুতের যুদ্ধ শেষে সুলতান কুতুজ এবং বাইবার্স তাঁকে সঙ্গে করে কাহেরায় (কায়রো) নিয়ে আসেন এবং সেখানে গবেষণার জন্য একটা জায়গা করে দেন।পরবর্তীতে তারা কায়সারিয়া , যাফা ইত্যাদি যুদ্ধে তাঁর সহায়তা নেন।

১২৬৮ সালে আনতাকিয়াকে ক্রুসেডারদের থেকে মুক্ত করতে বাইবার্স হাসানকে সঙ্গে নেন। এই যুদ্ধে তিনি প্রথম তার উদ্ভাবিত রকেট ব্যবহার করেন। সে রকেটের নাম দেন "তাইয়ার"। যুদ্ধটি উভয় পক্ষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আল্লাহপাক মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেন।

এর কিছুদিন পর হাসান আরেকটা নতুন চমক নিয়ে হাজির হন। তৈরি করে ফেলেন টর্পেডো। অনেকে হয়তো শুনেই চমকে উঠেছেন–ত্রয়োদশ শতকে টর্পেডো! হ্যাঁ, হাসান টর্পেডো তৈরি করেছিলেন। মামলুক সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি শামের সমুদ্র উপকূলে সেটির পরিক্ষা-নিরিক্ষা চালাতেন। আমেরিকার Smithsonian National Air and Space Museum –এ হাসানের উদ্ভাবিত টর্পেডোর একটি নমুনা সংরক্ষিত আছে।

১২৭৭ সালে সুলতান বাইবার্স মারা যাওয়ার পর সুলতান কালাউন ক্রুসেডারদের থেকে হিমস, হামা ইত্যাদি মুক্ত করতে তার সহায়তা নেন। ১২৯১ সালে সুলতান কালাউন মৃত্যুবরণ করলে তাঁর ছেলে আশরাফ খলিল আকা বিজয়ে তার সহায়তা নেন ।ফলে একশত বছর পর "আকা" মুসলমানদের হাতে ফিরে আসে। সেই যুদ্ধে তিনি এক ধরনের ছোট মিনজানিক ব্যবহার করেন, যার নাম দেন আল-ছি'রানুস সাওদা (কালো ষাঁড়), এর ধ্বংসক্ষমতা ছিলো ভয়াবহ রকম। এছাড়াও এই যুদ্ধে একজন সৈন্যের পক্ষে বহনযোগ্য বন্দুক ব্যবহৃত হয়।

এই বছরকেই (১২৯১) ক্রুসেড যুদ্ধের সমাপ্তি হিসেবে ধরা হয়।এর তিন বছর পর ১৯৯৪ সালে নিজ গৃহে গবেষণারত অবস্থায় এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে হাসান মারা যান আর জ্ঞানসম্পদগুলো রেখে যান অলস,অযোগ্যদের হাতে। তাঁর রেখে যাওয়া জ্ঞান চর্চিত না হওয়া ছিলো তাঁর জন্য দ্বিতীয় মৃত্যু।

তাঁর লিখিত বইগুল কিছু গ্রন্থ, (১)الفروسية والمناصب الحربية ( ছাপায় আসা এটিই তাঁর একমাত্র বই) (২)الفروسية في رسم الجهاد (এই বইটির পান্ডুলিপি প্যারিসে এখনো বিদ্যমান। (৩) البنود في معرفة الفروسية. (এটির একটি কপি বর্তমানে দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যাতে আছে

লেখক: শিক্ষার্থী, ইফতা প্রথম বর্ষ, দারুল উলুম হাটহাজারী

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ