রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ।। ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১১ জিলকদ ১৪৪৫


বৈশ্বিক সমাজে মুসলিমরা কেনো পিছিয়ে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানী
ভাষান্তর: মাওলানা তাওহীদ আদনান কাসেমী নদভী

কুরআন ও হাদীসের মর্ম বাণী অনুযায়ী বুঝা যায়, শক্তিশালী মুমিন ও দৃঢ় ঈমানদারদের আল্লাহ পাক ভালোবাসেন। সুতরাং মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো, কুরআন ও হাদীসের এই মর্মবাণীতে আমাদের প্রতিচ্ছবি খোঁজা।

ভারতের কথাই বলা যাক। এখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হলেও বাস্তবিক বিচারে ধর্মের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলিমরা পিছিয়ে। কিন্তু কেনো?

সংখ্যালঘুরা যদি সমাজে সম্মানজনক অবস্থান গ্রহণ করতে চায়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমান বা তাদের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করতে হয়। সুতরাং মুসলিম যুবকরা সমষ্টিগতভাবে যতক্ষণ না সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের সমান বা তাদের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করবে, যতক্ষণ না তারা অন্যদের সমপর্যায়ে পৌঁছুতে পারবে, ততক্ষণ তাদের নিজ অংশের চেয়েও বেশি কাজ করে যেতে হবে। তাহলেই কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমপর্যায়ে পৌঁছা সম্ভব।

ভারতে যত সরকারি-বেসরকারি অনুসন্ধানী বিশ্লেষক কমিশন গঠন করা হয়েছে, সকলেই মুসলমানদের অবস্থা বিশ্লেষণে ঐকমত্য হয়েছে যে, মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, শিক্ষার অভাব।

শিক্ষার অভাব বলতে যে, মুসলিম শিশুদের মেধা নেই, বিষয়টা এমন নয়। বরং বিষয়টা হলো, মুসলিম শিশুরা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর শেষ করে আর আগায় না। মাধ্যমিক স্তরেও আসে না। অপূর্ণাঙ্গভাবেই ইতি টানে শিক্ষা জীবনের। আর যেহেতু তারা শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে, ফলে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায় জীবনের সকল কর্মক্ষেত্রেও।

শিক্ষাক্ষেত্রে অনাগ্রসরতার প্রধান কারণ হলো, শিক্ষাগত ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারা। বিপুল সংখ্যক মুসলিম শিশু সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির মধ্যেই ঝরে পড়ে। অনেকেই ম্যাট্রিক পর্যন্তও পৌঁছে না। আবার যারাই ম্যাট্রিক শেষ করে, এর থেকে আর সামনে এগুয় না। প্রতিটি স্তরেই এই অবস্থা চলতে থাকে। এমনকি উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাদের আনুপাতিক হার ন্যূনতম হয়ে যায়।

শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে পুলিশ-প্রশাসন ইত্যাদিতে মুসলমানদের সংখ্যার হ্রাস এই কারণে নয় যে, তাদের সাফল্যের হার তুলনামূলক কম। বরং এই সংখ্যা হ্রাসের কারণ হলো, এ সমস্ত সেক্টরে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী মুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যাই কম। সুতরাং যাদের অংশগ্রহণ কম, তাদের সংখ্যাও কম হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে এই শিক্ষা ও আনুষঙ্গিক পতন রোধ মুসলমানদের জন্য এখন একটি জাতীয় কর্তব্য।

আল্লাহ পাকের শুকরিয়া যে, মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার চেতনা বাড়ছে। বস্তিতে বসবাসকারী দরিদ্র মুসলমানরাও তাদের সন্তানদের স্কুল-কলেজে ভর্তি করা শুরু করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, কয়েকটি সিঁড়ি আরোহণ করেই জ্ঞান অন্বেষণকারী এ প্রেরণা হারিয়ে ফেলে তারা। ফলশ্রুতিতে কয়েক কদম আগে বেড়ে আবার পিছিয়ে যায় তারা।

মুসলমানরা তাদের শিক্ষা চালিয়ে যেতে না পারার প্রধান কারণ ২ টি:

১. দরিদ্র পিতামাতার চাহিদা। অধিকাংশ সময়েই দরিদ্র পিতামাতার চাহিদা থাকে যে, তাদের সন্তান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুই/চার টাকা উপার্জন শুরু করুক এবং কিছু হলেও পিতামাতার হাত খরচ দিক। যেমন, চাকায় হাওয়া দেওয়ার দোকান বা মেরামত ইত্যাদির দোকানের কথাই ধরা হোক বা হোটেল-রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির কথাই বলা হোক, সর্বত্র ভারি ভারি কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে ছোট ছোট বাচ্চারা। এদের ৯০% নব্বই শতাংশেরও বেশি হলো মুসলিম শিশু-সন্তান।

২. দারিদ্র্য ও মুখাপেক্ষিতা। বিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরুর পরেই বইয়ের খরচ, টিউশন ফি, ইউনিফর্ম বানানো ইত্যাদির নামে শুরু হয় খরচ। ফলে বছর দুয়েক তো দরিদ্র ও শ্রমিকরা কোন না কোনভাবে তা বহন করে নেয়। কিন্তু তারপরে আর তাদের সাহসে কুলায় না। এরপর তারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আমাদের বাগানে যে মুকুল এসেছে, তা ফোটবার নয়। আমরা যেভাবে দুংখে-কষ্টে দিনপাত করেছি, তারাও সেভাবেই কাঁটার মাঝেই কাটিয়ে দিক জীবন।

প্রধান এ'দুটি কারণই দিন দিন মুসলিম শিশুদের করে তুলছে পড়া-লেখায় নিম্ন ও নিম্নতর। এ তো গেলো সমস্যার কথা। কিন্তু এর সমাধান কী? এর সমাধানে মৌলিকভাবে ৩ টি বিষয় মাথায় রাখা যায়:

১. মুসলমানদের দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণীর লোকদের সান্ত্বনা দেওয়া ও বোঝানো যে, দারিদ্র্যের মাঝেই নিজেকে মানিয়ে নিন। পুরাতন কাপড়-চোপড়েই ঈদগুলো কাটাতে অভ্যাস করুন। ব্যক্তিগত বাসা-বাড়ি ক্রয়ের প্রচেষ্টায় না থেকে, কোনো একটি ভাড়া বাসায়, হোক তা কুঁড়েঘর, মাথা গুজে নিন। সাদামাটাভাবে বিবাহ উদযাপন করুন। তবুও যে কোনো মূল্যেই হোক সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষা চালু রাখুন; যেনো একসময় দারিদ্র ঘুচে যায়, সমৃদ্ধির আগমণ ঘটে এবং আপনাদের অবস্থা নিম্ন থেকে উচ্চতর হয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে মদীনার কথা। বদর যুদ্ধের সময় দুর্ভিক্ষ চলছিল মদীনায়। বদরী যুদ্ধবন্দীদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাইলে আর্থিক মুক্তিপণ দিতে বাধ্য করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি শিশুদের শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ফলে যারা পড়া-লেখা জানতো তাদের জন্য মুক্তিপণ ঘোষণা করেছেন, দশজন করে মুসলিম শিশুদের শিক্ষাদান।

এর মাঝে আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে যে, মুসলমানের ক্ষেত্রে দারিদ্রকে তো মেনে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু জ্ঞানের দৈন্যতা মেনে নেওয়া অসম্ভব।

২. মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার জন্য পৃষ্ঠপোষকতার মনোভাব তৈরি করা। এটা এভাবে যে, যারা ধনী ও বিত্তবান, তারা সবাই তাদের পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও পাড়া-মহল্লার এক-দুইজন করে এমন সন্তানদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে, যাদের শিক্ষার শৃঙ্খল দারিদ্র্যের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচা আবু তালিব-এর আর্থিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হজরত আলী রা.-এর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। একইভাবে হজরত আব্বাস রা. লালন-পালনের দায়িত্ব নেন আবু তালিব এর আরেক পুত্র হজরত জাফর রা.-এর।

এটি শিক্ষা-দীক্ষার জন্য পৃষ্ঠপোষকতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই উদাহরণটি মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার; যাতে শিশুদের রত্ন দিয়ে সজ্জিত করা যায়, জ্ঞান অন্বেষণের সফর চালু থাকে।

৩. বর্তমানে শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করণে দরিদ্র ও অনবগত মুসলমানদের সহযোগিতা ও তাদের তথ্য প্রদানের ব্যবস্থা করা।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমন সব সেক্টরে বর্তমানে মুসলমানদের প্রবেশ করাও দায়। ফলে মুসলমানগণ তাদের যথাযথ অধিকার গ্রহণ থেকেও বঞ্চিতই থেকে যায়। যদিও আজকাল এমন অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয়েছে যে, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর ব্যক্তিরাও তাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় পরিমাণ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারে এবং দারিদ্র্য তাদের সংকল্প ও ইচ্ছার পথে বাধাও হতে পারে না।

আমরা যদি আমাদের জাতিকে শক্তিশালী মুমিন ও দৃঢ় ঈমানদার বানাতে চাই, তাদের দুর্বলতা, পিছুটান ও অপমান থেকে বের করে আনতে চাই, একটি মর্যাদা ও গাম্বীর্যপূর্ণ জীবন যাপনের ব্যবস্থা করতে চাই, তাহলে আমাদের এই অজ্ঞতা ও জ্ঞানের অভাবের ব্যাধি দূর করা প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়োজন উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের রুখে দাঁড়ানো, যেমন একটি মানুষকে বাঁচাতে ছুটে চলে হাজারো বিবেকবান মানুষ।

আহ, কতইনা ভালো হতো, যদি এ দাওয়াত পৌঁছে যেতো চোখ ও কান ভেদ করে প্রতিটি হৃদয়ের গভীরে!

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ