শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


গণতন্ত্র, ভোট, আগের বুজুর্গদের ‘পাপ’ এবং কিছু বিনীত কথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| শরীফ মুহাম্মদ ||

গণতন্ত্রের মতো একটি বাতিল তত্ত্বের সাফাই গাওয়ার প্রয়োজন নাই। কিন্তু গণতন্ত্রের সূত্র ধরে নির্বাচন এবং নির্বাচনে গত ৫০-৬০ বছর আগের উপমহাদেশের সবচেয়ে বরিত আলেমদের অংশগ্রহণ, এর সব কিছুকেই নিষিদ্ধ এবং অত্যন্ত অপছন্দনীয় হিসেবে দেখা ও উপস্থাপন করা-এটা সম্ভবত ৩০/৩৫ অনূর্ধ্ব বয়সের চিন্তাবিদ তরুণেরাই নির্দ্বিধায় করে ফেলছে।

প্রেক্ষাপট, পটভূমি এবং 'সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা', 'প্রচলিত ও অনুমোদিত সিস্টেমের মধ্যেই' দ্বীন প্রতিষ্ঠা কিংবা 'দ্বীন প্রতিষ্ঠার নামে দ্বীনের বিরুদ্ধের শক্তির সামনে কিছুটা প্রতিরোধ দাঁড় করানোর সংগ্রাম'-এইসব বিষয় সামনে নিয়ে চিন্তা করলে এভাবে কঠোর ভাষায় কথা বলা নিঃসন্দেহে কঠিন হতো।

গণতন্ত্রের আদ্যপান্ত তত্ত্বগত অবস্থানের চেয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা একটি অনুমোদিত প্রক্রিয়া পরিবর্তনের, এটাই তাঁদের কাছে মুখ্য ছিল। তখন সরাসরি অন্য 'কোনো রকম প্রয়াস ও চর্চা'র সুযোগ ও নজির ছিলও না। তাঁরা তাঁদের মূল লক্ষ্যের অভিমুখে পথচলার জন্য এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যবহার করেছিলেন। তত্ত্বগতভাবে 'গণতন্ত্র' এবং প্রক্রিয়াগতভাবে 'নির্বাচন' তাদের সেরা পছন্দ বা বাছাই ছিল এমন কিছু তো না।

কিন্তু এ যুগে বসে দক্ষ সার্জনের মতো আমরা এখন তাদের কাটাছেঁড়া করছি। এবং আগের বড়দের কে কতটুকু ভুল বা ব্যর্থ ছিলেন আঙুল তাক করে করে দেখিয়ে দিচ্ছি! এটা ভুল প্রক্রিয়া; এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন করতে বসলে ইতিহাসের ধাপে ধাপে অনেক বরিত মহান মানুষকে বাজেভাবে কাটাছেঁড়া করতে হবে, যা সম্পূর্ণই অনুচিত এবং অন্যায্য।

[ভুল মূল্যায়নের একটি নমুনা। শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ রাজনৈতিক সংগ্রাম করলেন প্রত্যক্ষ জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়লেন না কেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে?/হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ প্রত্যক্ষ জেহাদ কিংবা রাজনৈতিক সংগ্রাম কোনটাই করলেন না কেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে?/]

আরেকটি দিক হলো, ৫০, ৬০, ৭০, ৮০ এমনকি ৯০- এর দশক পর্যন্ত উপমহাদেশীয় (হতে পারে বিশ্ব পরিসরেও) আলেম নেতৃবৃন্দ এবং ইসলামের নেতৃত্বশীল মানুষদের সামনে প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সমাজতন্ত্র, সোশালিজম, কমিউনিজম। বাম শক্তিগুলোর একটা সরব স্বপ্নপ্রবণ ও উত্থানমুখর পর্ব ছিল ওই সময়গুলোতে। এবং পুঁজিবাদের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ধর্ম ও ধর্মীয় শক্তিগুলো ছিল তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ।

এই বাস্তবতার সামনে ময়দানে আকাবির আলেমদের কাজ করতে হয়েছে। পুঁজিবাদ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সবকটির বিরুদ্ধে তাঁরা তাত্ত্বিক অবস্থান ব্যক্ত করলেও তাদের সবচেয়ে বেশি প্রতিপক্ষ ছিল সমাজতন্ত্র। এটা ছিল দু দিক থেকেই। অপরদিকে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেক সময় পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র তাঁদের পাশে থেকেছে (অবশ্যই নিজেদের স্বার্থ ও চিন্তা থেকে)।

উপমহাদেশ তো বটেই, আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচুর বইপত্র লেখা হয়েছে; এখন যেসব বাজারে সেভাবে নেই; কমে গেছে প্রাসঙ্গিকতাও। ৮০ ও ৯০-এর দশকে আ/ফ/গানি/স্তা*নে সোভিয়েত বিরোধী জেহাদে কারা কীভাবে অংশ নিয়েছিল, সাহায্য করেছিল ভেবে দেখা যেতে পারে। এখন প্রতিপক্ষ বদলে গেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তাভাবনাতেও স্বাধীনতা আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ সুযোগের মধ্যে বসে আগের সবকিছুকে এই সময়ের ফ্রেমে দেখা ঠিক না।

২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বরের পর পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলিমদের জন্য একটা অন্য সময় অন্য বাস্তবতা এসেছে। মোটা দাগে প্রতিপক্ষের চেহারা বদলে গেছে। নানা ক্ষেত্র/পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এজন্য আগের 'নিয়মতান্ত্রিক অনুমোদিত সাধ্য -সামর্থ্য অনুযায়ী পরিচালিত প্রয়াস'কে এখন ভুল আখ্যায়িত করা এবং তাদের দোষী সাব্যস্ত করা এটা একটা দোষণীয় মূল্যায়ন প্রক্রিয়া।

আমার মনে হয়, উত্তম মনে করে নয়, পছন্দনীয় কর্ম প্রক্রিয়া হিসেবে নয়, 'অনুমোদিত সাধ্য অনুযায়ী কর্ম প্রয়াসের সুযোগ হিসেবে' যারা আগে এবং এখনো ইসলামী রাজনীতি এবং প্রয়োজনীয় সময়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এটা ভালো কাজ এবং আমার দৃষ্টিতে জাতীয় জিম্মাদারির অংশ পালন। যদিও অতীত না-জানা, প্রেক্ষাপট-অসচেতন এবং বেহিসেবী স্বপ্নপ্রবণ কিছু তরুণের মূল্যায়নের দোষারোপ থামবে না। তারা যখন তেমন কিছু পারবেন, সফল হবেন, করবেন; নতুন নজির স্থাপিত হবে। এবং অনুসরণীয় হবে।

অনেক কিছুর ভালো-মন্দ সাব্যস্ত করার সঙ্গে আপেক্ষিকতা/'অনুমোদিত সাধ্য সামর্থ' গভীরভাবে যুক্ত। শুধু নির্বাচন নিয়ে এত গালমন্দের আগে একটু ভেবে দেখতে পারি, আপনারা যে বলেন: 'দেশে আইনের শাসন নাই' এটা কোন আইন? তাহলে কেন বলি? (অধিক মন্দ কমানোর জন্যই কথাটা বলা হয়) কেউ গ্রেফতার হলে জামিন চেষ্টা কোন আদালতে করেন?

আদালত ইসলামী/তাগুত? তাহলে কেন করেন?(আপাতত জুলুম থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এটা করা হয়) ভ্যাট ট্যাক্স নানা রকম ফি কোন রাষ্ট্রকে দেন? ইসলামী রাষ্ট্র/গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র? তাহলে কেন দেন? (সাধ্যের স্তর এতটুকুই যে এখন দিতে হবে) গণতন্ত্র ও ভোটের বিরুদ্ধে ঢালাও বলেন, ভোটার আইডি বা এনআইডি করেন না-এমন কে আছেন? (ভোট না দিলেও ভোটের আইডি না করলে অনেক সমস্যা এজন্য করতে হয়) তো এরকম অনেক ক্ষেত্র পাবেন আপেক্ষিকতা, সাধ্য সামর্থ্যের সীমানা এবং ওজরের বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে এবং সেগুলো সবাই মানছেন।

সুতরাং অনুমোদিত পন্থায় ইসলামের পক্ষে আওয়াজ উঠিয়ে রাখার জন্য এবং ইসলামবিরোধীদের বিরুদ্ধে ময়দান ও চেয়ার হাতে রাখার জন্য ইসলামী রাজনীতি ও নির্বাচন সেরকমই এক- একটি চেষ্টা।

[এবং একইসঙ্গে এটাও বলা দরকার, প্রকাশ্য বাস্তবতায়/রাজনীতির ময়দানে অনেক শব্দ স্লোগান বাক্য পূর্ণ রূপক অথবা অর্ধ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ'/ 'অশ্লীলতার বিরুদ্ধে জেহাদ' এ কথাগুলো প্রকৃত সশস্ত্র জিহাদের অর্থে ব্যবহার করা হয় না, কঠিন প্রতিরোধ প্রয়াস অর্থে ব্যবহার করা হয়। তবে অতি ব্যবহারে রূপক অর্থের কারণে প্রকৃত অর্থ মগলুব হয়ে গেলে এবং চাপা পড়ে যেতে থাকলে অবশ্যই আবার সংশোধন দরকার।]

আবারো বলছি, গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের অনুষঙ্গ ভোট বা নির্বাচনকে মহান করে দেখার কিছু নেই। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মৌলিকভাবে এ বিষয়গুলোর উচ্চকিত প্রশংসা খারাপ। কিন্তু রাজনৈতিক/রাষ্ট্রনৈতিক ময়দানে ইসলামী শক্তিগুলোকে/ব্যক্তিত্বকে ভোটে অংশগ্রহণের কারণে দোষনীয়/দায়ী করে দেখা এটা খুবই ভুল জিনিস। অনেকের কথায় এখন মনে হয়, বাংলা পাক ভারত উপমহাদেশে গত ৭০ বছরে যেসব কিংবদন্তি বরিত আলেম বুযুর্গ নির্বাচন করেছেন তারা যেন মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। এখন তাদের 'পাপ' আমরা আর গোপন করতে পারছি না! গত কয়েকদিন আগে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ-এর রাজনীতি এবং 'তওবা' নিয়ে একটি ছোট্ট পোস্ট দিয়েছিলাম। সেখানে এক তরুণ আলেম কী বিশাল মূল্যায়ন- মন্তব্য করেছে, ছবি হিসেবে দিয়ে দিলাম।

[নোট: এই পোস্ট পাতানো/একদলীয় কোনো নির্বাচনের সাফাই গাওয়ার জন্য না এবং ইসলামের নামে রাজনীতিতে যুক্ত কোনো দল বা ব্যক্তির অনৈতিকতা/অনৈতিক অবস্থানকে সমর্থন দেওয়ার জন্যও না।] -লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া।

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ