রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১১ জিলকদ ১৪৪৫


আব্বাসি শাসনামলে লাইব্রেরি ব্যবস্থা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবু সাঈদ।। উমাইয়া শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৩২ হিজরীতে। ক্ষমতার পালাবদলে খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ যায় আব্বাসীদের অধিকারে। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাইরে মুসলমানদের অবাধ বিচরণ শুরু হয়।

হেকমত-ফালসাফা ও অন্যান্য শাখা মুসলমানদের পদচারণায় মুখরিত হয়। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হাজী খলিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি কাশফুয যুনুন গ্রন্থে বলেন, ‘শোনো, উমাইয়াদের শাসনামলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার চর্চা ছিল সীমিত পরিসরে। খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ যখন আব্বাসীদের হাতে যায়, বিশেষ করে আব্বাসী দ্বিতীয় খলিফা মনসুর এর যুগে পুরোদমে সেসবের চর্চা শুরু হয়।

তিনি যেমন ফিকাহ শাস্ত্রের মহীরুহ ছিলেন, দর্শনশাস্ত্রের‌ও ছিলেন মহাদিকপাল। তিনি দার্শনিকদের খুব মূল্যায়ন করতেন।’ ইমাম ইবনুল আরাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তারিখু মুখতাসারিদ দুয়াল গ্রন্থে কাজী সায়েদ আন্দালুসী থেকে আব্বাসীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্রমবিকাশ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ যখন আব্বাসীদের হাতে আসে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও তার ব্যাপক প্রচার প্রসারের প্রতি তারা বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন। পুরোদমে এর চর্চা শুরু করেন দ্বিতীয় খলিফা মনসুর। পরে তার নাতি খলিফা মামুনুর রশিদের খেলাফতকালে তা পূর্ণতা লাভ করে। খলিফা মামুন বিশ্বের যেখানে যে ইলম ছিল, সংশ্লিষ্টদের কাছে তা তলব করেন। তিনি রোমানদের কাছে দর্শনশাস্ত্রের কিতাবাদি চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন। তারা কিতাবাদি প্রেরণ করলে মামুন দক্ষ ও অভিজ্ঞ অনুবাদকদের মাধ্যমে তার অনুবাদ করিয়ে নেন। মানুষকে তা পড়া ও শেখার প্রতি জোর তাগিদ দেন।’

এ বিন্দুতে অবশ্য ইবনে খালদুনের দ্বিমত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘খলিফা মনসুর‌ই প্রথম রোমানদের থেকে দর্শনের কিতাবাদি সরবরাহ করেন। রোমানরা মামুনের অনুরোধে বিজ্ঞ অনুবাদকদের মাধ্যমে দর্শন ও পদার্থ বিজ্ঞানের নানা কিতাব অনুবাদ করে প্রেরণ করেছিল। কথিত আছে, সেসবের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ বিখ্যাত গ্রন্থ উকলিদাস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি ছিল। এসব কিতাব পড়ে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে।’

এখান থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে, ইসলামি ইলমের ময়দানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার প্রবেশ মুসলিম খলিফা ও তার দরবারের বিজ্ঞ আলেমদের মাধ্যমে হয়েছে। তবে তা কোন ধরনের অন্যায়ের শিকার হয়নি। সংশ্লিষ্টদের অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু মধ্যযুগে ইউরোপীয়রা যখন ইসলামি শিক্ষা লাভ করেছে, এক্ষেত্রে তারা মুসলমানদের অবদান সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। গোপন করেছে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ অনেক বাস্তবতা।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক খতিবে বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তারিখে বাগদাদ গ্রন্থে বলেন, খলিফা মনসুর উলামায়ে কেরামকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কিতাব রচনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। তার অনুরোধেই ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি আল মুআত্তা গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। তিনি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রহমতুল্লাহি আলাইহিকে মানব সভ্যতার ইতিহাস রচনা করতে বলেছিলেন।

খলিফা মনসুর উলামায়ে কেরামকে যেভাবে কিতাব রচনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন, ইলম সংরক্ষণের জন্য তদ্রুপ কাগজে লেখার প্রতিও উৎসাহ দিতেন। তখন মানুষ চামড়া-হাড্ডি ইত্যাদিতে লিখে ইলমের সংরক্ষণ করতো।

তিনি উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কাগজ তৈরির ব্যবস্থা করেন। চামড়া ইত্যাদিতে লেখা হলে মুছে যেতো। সুবিধাবাদীদের তা মুছে নিজেদের মনগড়া কিছু যোগ করারও সুযোগ থাকতো। কাগজে সে সুযোগ নেই। কাগজের লেখা ঘষে তোলা হলে বোঝা যায়। তখন জালিয়াতিও স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কালকাসান্দি সুবহুল আ’শা গ্রন্থে বলেন, পরবর্তীতে হারুনুর রশিদ রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করে কাগজে লেখাকে বাধ্যতামূলক করে দেন।

রচনা ও অনুবাদের ধারা খলিফা হারুনুর রশিদের যুগেও অব্যাহত ছিল। বরং হারুনুর রশিদের খেলাফতকালকে রচনা ও অনুবাদের সোনালী যুগ বলা চলে। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থাগার দারুল হিকমাহ। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক কালকাসান্দি ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারগুলোর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ইসলামী ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার তিনটি।

প্রথমটি আব্বাসীয় খলিফারা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাতে এ পরিমাণ কিতাব ছিল যা গণনা করে শেষ করার মত নয়। গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কিতাবাদিতে পৃথিবীর অন্য কোথাও তার তুলনা মেলা ভার। দ্বিতীয়টি ফাতেমী খলিফারা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাতেও গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির প্রচুর মজুদ ছিল। তৃতীয়টি বনী উমাইয়ার শাসকবৃন্দ প্রতিষ্ঠা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদিতে তাও কোন অংশে কম ছিল না।

ঐতিহাসিক আন-নাদিম আল-ফিহরিস্ত গ্রন্থে দারুল হিকমাহ প্রসঙ্গে বলেন, দারুল হিকমাহর সর্বপ্রথম পরিচালক ছিলেন আবু সাহাল ইবনে নওবখ্ত। তিনি ব্যক্তি হিসেবে অভিজ্ঞ অনুবাদক ছিলেন। তার তত্ত্বাবধানেই দারুল হিকমাহর অনুবাদকরা অনুবাদ-কার্য সম্পাদন করতেন। ইসলামি ইতিহাসের প্রসিদ্ধ এই মাকতাবার প্রথম পরিচালক হিসেবে আজও তিনি অমর হয়ে আছেন।

তখন মাকতাবা হয়ে উঠেছিল সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ফলে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মত মাকতাবার কার্যক্রমের জন্য‌ও লোক নিয়োগ দেওয়া হতো। মাকতাবায় কাজ করার প্রতি তখন মানুষের প্রবল আগ্রহ ছিল। মানুষ প্রতিযোগিতামূলকভাবে এতে অংশগ্রহণ করতো। তিনটি বড় বড় সালতানাতে এ প্রতিষ্ঠান বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।

এক. বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসী সালতানাত ও তাদের অধীনস্থ অঞ্চলগুলোতে। এ সালতানাতের অধীনে পরিচালিত হতো বায়তুল হিকমাহ। এর পরিচালক ছিলেন সাহল ইবনে হারুন।

দুই. মিশর শাম ও পশ্চিমা কিছু ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত ছিল ফাতেমী সালতানাত। এর অধীনে পরিচালিত হতো দারুল ইলম। এর পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত লেখক শাবিশাতি। আদ-দিরায়া তার অমর কীর্তি।

তিন. আন্দালুস ও পাশ্চাত্যের আরো কিছু অঞ্চল জুড়ে ছিল উমাইয়া সালতানাত। তাদের অধীনে পরিচালিত হতো খিযানিতুল উলুমি ওয়াল কুতুব। এর পরিচালক ছিলেন তালিব কুসাই সাকলাবী। তিনি ছিলেন উমাইয়া শাসক খলিফা মুস্তানসির বিল্লার আযাদকৃত গোলাম।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মাকরী নাফহুত তীব গ্রন্থে খিযানাতুল উলুমি ওয়াল কুতুব সম্পর্কে বলেন, এ মাকতাবা প্রতিষ্ঠা করেন উমাইয়া শাসক খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ। ইলমের প্রতি তিনি ছিলেন যারপরনাই অনুরক্ত। আলেমদের খুব শ্রদ্ধা করতেন। কিতাব সংগ্রহ করা ছিলো তার অদম্য নেশা। ফলে এ মাকতাবায় তিনি এত বিপুলসংখ্যক গ্রন্থমালার সমাবেশ ঘটান যে, এরপূর্বে এত কিতাবের পসরা কেউ বসাতে পারেনি।

ইমাম ইবনে হাযম জাহিরি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, খিযানাতুল উলুমের পরিচালক তালিদ কুসাই আমাকে বলেন, মাকতাবার কিতাবাদির মোট চুয়াল্লিশটি তালিকা রয়েছে। প্রত্যেকটি তালিকা বিশ পৃষ্ঠা জুড়ে। কিতাবের এই বিপুল সমাহারের কারণে তা উলামায়ে কেরামের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে খলিফা লোক পাঠাতেন। যেখানে যে কিতাব পাওয়া যেত, সংগ্রহ করে আনাতেন। ফলে গ্রন্থাগারটি এতটাই সমৃদ্ধ হয়েছিল যে, তার পূর্বের ও পরের কেউ এত সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ