বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


‘ইসলামে যৌতুক বলে কিছু নেই, মোহরের ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ির সুযোগ নেই’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নুরুদ্দীন তাসলিম।।

যৌতুক ইসলামে নিষিদ্ধ। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় ইসলামে যৌতুক প্রথার কোনো অস্তিত্বই নেই। যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলিত এই প্রথা মুসলিম সমাজকেও আক্রান্ত করে বসেছে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে যৌতুক প্রথা বলে কিছু চালু ছিল এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

যৌতুকের মাধ্যমে বরপক্ষ কনে পক্ষের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে অর্থ-সম্পদ আদায় করে। যা সম্পূর্ণরূপে কোরআন-হাদিসের পরিপন্থী। এদিকে পবিত্র কোরআনে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর শাস্তি কথা বলা হয়েছে।

ইসলামে পুরুষের জন্য নারীর মোহর আদায় ফরজ করা হয়েছে

যৌতুক আদায়ের কোন নিয়ম ইসলামে তো নেই, বিপরীতে বিয়ের সময় বরপক্ষের জন্য নারীর সতীত্বের বিনিময়ে নারীর অধিকার হিসেবে মোহর আদায় করা ফরজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

ইসলামী শরিয়ত স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করা স্বামীর ওপর ফরজ করে দিয়েছে। আর মোহর পরিশোধ করা ছাড়া বিয়েই হতে পারে না। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের থেকে যে স্বাদ গ্রহণ করো তার বিনিময়ে অপরিহার্য ফরজ হিসেবে তাদের মোহর পরিশোধ করো।’-সূরা নিসা : ২৪।

১০ দিরহামের কম কোন মোহর নেই

মোহরের সুনির্দিষ্ট কোন পরিমাণ যদিওবা নেই। তবে হানাফী মাযহাব মতে সর্বনিম্ন ১০ দিরহাম অর্থাৎ ৩০.৬১৮ গ্রাম রূপা অথবা এর সমপরিমাণ অর্থ দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে পুরুষের জন্য। এ ব্যাপারে হাদীসে এসেছে;  ১০ দিরহামের কম কোন মোহর নেই।

তবে সামর্থ্যবান স্বামী তার স্ত্রীকে ১০ দিরহামের অধিক যত বেশি পরিমাণে চান মোহর দিতে পারেন। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন পরিমাণ বা সীমা নির্ধারণ করা নেই।

মোহরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে লৌকিকতার জন্য অনেক বেশি মোহর নির্ধারণ করা কাম্য নয়; যা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে আদায় করা হবে না।

এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সর্বোত্তম মোহর হচ্ছে যা পরিশোধ করা সহজসাধ্য। তবে বর্তমান সময়ে বিপরীত চিত্র দেখা যায় মোহরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে।

স্ত্রী মারা গেলে মোহরানা কীভাবে পরিশোধ করব? | DP NEWS

লৌকিকতা কিংবা নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি  দেখাতে গিয়ে শর্ত- শারায়েত জুড়ে দিয়ে এত বেশি পরিমাণে মোহর নির্ধারণ করতে শোনা যায় মেয়ে পক্ষ থেকে- যা অনেকটা চাপিয়ে দেয়ার মত কারো কারো ভাষ্যে।

অনেকে বলেছেন ইসলামে স্বীকৃত একটি বিষয়কে যেন অনেকেই অবৈধ যৌতুকের সাথে তালগোল মিলিয়ে ফেলছেন। তাদের ভাষ্যে অস্বাভাবিক উচ্চ দেনমোহর যেন পরোক্ষভাবে মেয়ের তরফে নির্ধারিত যৌতুক।

বিবাহের মাধ্যমে দুজনের আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়, এক্ষেত্রে বোঝাপোড়া কাম্য

জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রধান মুফতি মুফতি হিফজুর রহমান আওয়ার ইসলামকে বলেছেন, মোহরানা স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতার বিনিময়ে নির্ধারিত হওয়ার বিষয়। বিবাহের মাধ্যমে দুজনের আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়। তৈরি হয় দুটি পরিবারের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক। তাই এখানে সমঝোতা ও উভয় পরিবারের বোঝাপড়া কাম্য। চাপিয়ে দেওয়া পরিমাণ কখনই কাম্য নয়; যা পরবর্তীতে আদায় করা সম্ভব হবে না, বা আদায় করা হয় না।

উচ্চ পরিমাণে মোহর দাবি, সংসার জীবনে অশান্তির কারণও হতে পারে

তিনি আরো বলেছেন, ‘বেশি পরিমাণে মোহর নির্ধারণের কারণে তা আদায় করা সম্ভব না হলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মাঝে মনোমালিন্যতা তৈরি শঙ্কাও থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে মেয়েদের। পরিবার জীবন সুন্দর ও স্বাভাবিক করতে মোহরের মাধ্যমে নারীর যে অধিকার নির্ধারণ করেছে ইসলাম, তাকে লৌকিকতা ও  প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখানোর নেশায় হেলার বস্তুতে পরিণত করা ঠিক হবে না; বলেন তিনি।

বিয়ের মাধ্যমে পবিত্র সম্পর্কে জড়িয়ে থাকেন দুজন। যতটা সহজভাবে বিষয়টি সম্পন্ন হয় ততটাই উত্তম। এখানে বেশি মোহর নির্ধারণের কারণে বিয়ের বিষয়টি জটিল হয়ে গেলে ছেলে-মেয়ে কারো জন্য তা মঙ্গলজনক নয়। বিষয়টি এভাবে কঠিন হয়ে গেলে ভিন্ন পন্থায় গুনাহে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকতে পারে। তাই সবকিছুতে সহজতা তাই কাম্য বলে মতামত দিয়েছেন মুফতি হিফজুর রহমান।

উচ্চ পরিমাণে মোহর দাবির কারণে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনা বেশি

রাজধানীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার ইফতা বিভাগের মুশরিফ মুফতি মাহমুদুল হাসান জামশেদ বলছেন, মোহরানা দুই পরিবারের বোঝা পড়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। যেহেতু সর্বোচ্চ পরিমাণের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি; তাই চাইলে অনেক বেশি পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারে মেয়েপক্ষ। কিন্তু চারদিক পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে।

‘মেয়ে পক্ষ থেকে দাবি করা অর্থ যাদের পক্ষে সম্ভব তারা আদায় করে হয়তোবা বিয়ে করবে। কিন্তু এমন পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত নয় যার কারণে অন্য কেউ প্রভাবিত হয়ে এসব বিষয়ে বাড়াবাড়ি রকমের পরিমাণ নির্ধারণ করে’- বলেছেন তিনি।

তরুণদের  বৈধ সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাওয়ার আশঙ্কা

তার মতে, ‘ইসলাম সবকিছুতেই সহজতার দিকে গুরুত্ব দিয়েছে। আর বিয়ের মাধ্যমে একটি পবিত্র সম্পর্কে জড়িয়ে থাকেন দুজন মানুষ। এখানে পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যমে যদি এমন সম্ভবনা তৈরি আশঙ্কা থাকে যে, বেশি পরিমাণে মোহর আদায় সম্ভব নয়, এমন ধারণ থেকে কেউ হয়তোবা বৈধ সম্পর্ক থেকে দূরে সরেও যেতে পারে। এতে সহজতার বদলে হিতে বিপরীত হয়ে গেল বিষয়টি’।

তিনি আরো বলেছেন, সামর্থের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে কম অথবা যতটুকু সম্ভব নির্ধারণ করবে; কিন্তু যদি কেউ অনেক সম্ভ্রান্ত এবং অনেক টাকার মালিক হয়ে থাকে, তাহলে তার জন্য সুন্নত হিসেবে শুধু মহরে ফাতেমীতে আটকে থাকা ঠিক হবে না, বরং এমন ক্ষেত্রে মেয়ে সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবংশের হলে তাকে মোহরে মিছিল এবং যত বেশি সম্ভব মোহর দিতে পারে’।

দেনমোহর নির্ধারণে রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শ

তিনি আরো বলেছেন, মোহরের ক্ষেত্রে পরিমাণ বেশি বা কম নির্ধারণ করা শরীয়তের উদ্দেশ্য নয়। ১০ দিরহামের উপর যা আদায় করা সম্ভব তাই নির্ধারণ করা উচিত।

মোহর সম্পর্কে সমাজের ভুল ধারণা দূর করতে হবে

তিনি আরো যুক্ত করেন, ‘বর্তমান সমাজে অনেকে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বোঝানোর উদ্দেশে বেশি পরিমাণে মোহর নির্ধারণ করে থাকেন, বরপক্ষও মনে করে থাকে নির্ধারণ করলেই বা-কি আদায় তো করতে হবে না। এই যে সমাজে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান নিয়ে এক ধরনের ভুল ধারণা; এসব দূর করতে হবে। এবং সামর্থের মধ্যে নির্ধারণ করে তা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

এছাড়া তিনি আরো বলেন, ‘মোহরের বিষয়ে হাদীস আছে, যদি অনেক বেশি পরিমাণ নির্ধারণের সুযোগ থাকত, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী ও মেয়েদের ক্ষেত্রেই পরিমাণ অনেক বেশি নির্ধারণ করে দেওয়া হতো’।

ইসলামী শরীয়তে মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ থাকলে সর্বোচ্চ’র কোন পরিমাণ নির্ধারণ নেই তাহলে মেয়ে পক্ষ বেশি পরিমাণ নির্ধারণ করলে এতে সমালোচনা কিংবা আপত্তির অবকাশ থাকে কি?

এ বিষয়ে হাসান আলী নামে একজন বলেছেন, শরীয়তে যেই মোহরে মিছিলের কথা রয়েছে; যেখানে মেয়ের ফুফু খালা ও আত্মীয়-স্বজনের দিকে লক্ষ করে মোহর নির্ধারণের নিয়ম রয়েছে। এমন হলে বিষয়টা ঠিক আছে। তবে বর্তমানে অধিক পরিমাণে নগদ অর্থ আদায়ের শর্তে মোহর নির্ধারণ ও আদায় করার কিছুদিন পরেই সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে। এসবের মাধ্যমে পারিবারিক বৈধ একটি সম্পর্ককে জটিলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।  তাই এমন অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ এড়িয়ে চলাই কাম্য বলে মতামত তার।

এদিকে তাসনিয়া লুবাবা  নামে এক নারী জানাচ্ছেন, ইসলাম নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছে। বিয়ের সময় স্বামীর পক্ষ থেকে তার জন্য মোহরের অধিকার দিয়েছে। এখানে সর্বোচ্চ কোন পরিমাণ নির্ধারণ নেই। তাই স্বভাবতই মেয়েদের ইচ্ছাধীকার আছে মোহরের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে।

তার মতে, ‘যারা বেশি পরিমাণে মোহর নির্ধারণ করছেন তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন হতে পারে যে, বিশ বছর আগে তার কোন আত্মীয়ের বিয়ে হয়েছে। তার বিয়ে যেই পরিমাণ মোহরের বিনিময়ে হয়েছে বর্তমান সময়ে তা ১০/১৫ লাখ- পর্যন্তও হতে পারে; তাই এটি নিয়ে সমালোচনা, আপত্তির কোন প্রশ্নই আসে না বলে মতামত তার’।

‘এছাড়া মেয়েপক্ষ মহরের যে পরিমাণ নির্ধারণ করবে তা যে ছেলের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না তারা এড়িয়ে যাবে, যাদের পক্ষে সম্ভব তারা প্রস্তাব গ্রহণ করবে’ বলছিলেন তিনি।

এদিকে সাইফুল ইসলাম নামে আরেকজন বলছেন, মোহরের যে মূল উদ্দেশ্য এটা ওলামায়ে কেরাম এবং দ্বীনদার কিছু মানুষ ছাড়াও অনেকে বুঝেন না। তারা মনে করে থাকেন বিবাহ-বিচ্ছেদ ঠেকাতেই বেশি পরিমাণে মোহর নির্ধারণ করতে হবে। এতে সাধারণ যে পরিবারগুলো আছে তারা বিবাহের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। তাই বোঝাপোড়া ও সমঝোতার মাধ্যমেই মোহরের পরিমাণ নিধারণ করতে হবে’ -বলেন  তিনি।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ