হাসান মুরাদ।। জীবন থেকে আরো একটি বছর গত হলো। এলো নতুন বছর।স্বাগতম ১৪৪৩ হিজরি। হিজরি সনের আগমন প্রস্থান ঘটে নিবরে নি:শব্দে।
মুফতি তাকি উসমানি হাফি. এর সফরনামা পড়ে জেনেছি, পৃথিবীতে শুধু ব্রণাইতে রাষ্ট্রীয় ভাবে হিজরি সন উপলক্ষে ভিন্ন কিছুর আয়োজন করা হয়। আরব দেশগুলোতেও হয়। তবে আমাদের এ অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না।
মুসলিম হিসেবে হিজরি নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলিমদের গৌরবের দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি।
আমরা অনেকেই জানি না যে, মুসলিমদের নববর্ষ কোন মাসে হয়? আবার কেউ হয়ত বা হিজরিবর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাসও জানিনা। হিজরি সনের তারিখের খবরও রাখেন না, এর প্রতি মানুষ আকর্ষণও অনুভব করেন না, তা খুবই দুঃখজনক।
হিজরি সনের মাসের প্রথম দিনে বাংলাদেশের কোন পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখেনা এবং অধিকাংশ পত্র-পত্রিকায় কোন নিউজও আসেনা, এমনকি কোন টিভি চ্যানেল এ সম্পর্কে বিশেষ কোন অনুষ্ঠান রাখেনা। এতেই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের মুসলমানগণ ইসলামী সংস্কৃতি স¤পর্কে কতটা উদাসীন। যেমন পালিত হতে দেখি ঈসায়ী ও বাংলা নববর্ষ। অবশ্য এগুলো শরিয়তের কোন পালনীয় বিধান নয়।
মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে যে কোন সন তারিখ নির্ধারণ করতে পারে। তবে আরিব সন তারিখের আছে বিশেষ গুরুত্ব। রাসুল সা. এর তিরোধানের পর বিভিন্ন প্রয়োজনে বয়োজেষ্ঠ সাহাবাদের পরামর্শে হিজরি সনের প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু আরবি মাসসমূহের প্রবর্তন পৃথিবীর সূচনা থেকে।
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহর নিকট গণনার মাস বারোটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। কাজেই এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। (সূরা তাওবাহ; আয়াত-৩৬) অনুরুপ বক্তব্য রাসুল সা. থেকেও প্রমানিত। যা সহিহ বুখারীতে বণিত হয়েছে।
এ আয়াতে চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করীম সা. বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম এবং অপরটি হলো রজব। (তাফসীর ইবনে কাসির)
এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী র. তার বিখ্যাত গ্রন্থ তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনে লিখেছেন- উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাসের যে ধারাবাহিকতা ইসলামী শরিয়তে প্রচলিত রয়েছে, তা মানব রচিত নয়; বরং মহান রাব্বুল আলামীন যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিনই মাসের তারতিব ও বিশেষ মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হুকুম-আহকাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
এ আয়াত দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে আল্লাহর দৃষ্টিতে শরিয়তের আহকামের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসই নির্ভরযোগ্য। চন্দ্র মাসের হিসাব মতেই রোজা, হজ ও জাকাত প্রভৃতি আদায় করতে হয়। তবে কুরআন মজিদ চন্দ্রকে যেমন, তেমনি সূর্যকেও সাল তারিখ ঠিক করার মানদন্ডরূপে অভিহিত করেছেন।
সুতরাং চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সাল-তারিখ নির্দিষ্ট করা জায়েজ। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর নিকট অধিকতর পছন্দনীয়। তাই শরিয়তের বিধি-বিধানকে চন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখেছেন। এজন্য চন্দ্র বছরের হিসাব সংরক্ষণ করা ফরজে কেফায়া।
সকল উম্মত একবারে ভুলে গেলে সবাই গুনাহগার হিসাবে গণ্য হবে। চাঁদের হিসাব ঠিক রেখে অন্যান্য সূত্রে হিসাব ব্যবহার করা জায়েজ আছে।তবে ইসলামী বিধি-বিধান সবগুলোই আরবি মাসের হিসাবে।যেমন: রোজা,হজ্ব, যাকাত, ঈদ, তালাকের ইদ্দত পালন, বিধবা স্ত্রীর ইদ্দত পালন,সন্তানের দুগ্ধপাণের বছর পূর্তি ইত্যাদি।এজন্য প্রতিটি মুসলিমকে আরবি মাস সম্পর্কে সাধারণ ধারণা রাখা উচিত।
ইসলামী শাসন ব্যবস্থার সময় সবকিছুর হিসাব হিজরি সন ধরে হতো। পরবর্তিতে সময়ের পরিবর্তনে এর ব্যবহার হ্রাস পায়। কিন্তু ইসলামী বিধি-বিধান আরবি মাসের হিসাবে আরপিত। তাই কিয়ামত পর্যন্ত এর ব্যবহার অব্যাহত। হাদীস শরীফে নতুন চাঁদ দেখার দোয়াও বর্ণিত হয়েছে।
সুতরাং আরবি মাসের চাঁদ দেখাও ইবাদতের অংশ বলা যায়। হিজরি সনের সূচনা-ইতিহাস আলোচিত হলে স্মরণ হয় রাসুল সা. এর হিজরত প্রসঙ্গ। হিজরতের সে ঘটনা মুসলিম হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এসব বিবেচনায় আমাদের আরবি মাস তথা হিজরি নববর্ষ সম্পর্কে সম্মক ধারনা রাখা উচিত।
প্রচলিত ধারার বাংলা,ইংরাজি নববর্ষ উদযাপনের মত হিজরি নববর্ষ পালন কাম্য নয়। তবে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চা, হিজরতের ইতিবৃত্ত এবং ইসলামী কাল-সময় চর্চার স্বরুপ হিসেবে কছিুটা হলেও হিজরি নববর্ষের প্রচার-প্রচলন,আলোচনা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন মনে করি।
-এটি