মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে উস্তাদ নুমান আলী খানের অসাধারণ খুৎবা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মোস্তফা ওয়াদুদ
নিউজরুম এডিটর

উস্তাদ নুমান আলী খান। আপাদমস্তক কুরআনের আলোকে সাজানো বিশ্বখ্যাত আমেরিকান দায়ী। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত একজন ইসলামি বক্তা। নুমান আলী খান ধর্মীয় যুক্তিতর্কের জন্য মুসলিমদের নিকট বেশ জনপ্রিয়। আজ থাকছে আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ নিয়ে সুরা আরাফের আলোকে তার অসাধারণ খুৎবার বাংলা অনুবাদ।

তিনি বলেন, আজকের খুৎবায় আমার নিয়ত হল, ইনশাআল্লাহ, কুরআনের ৭ম সূরার কয়েকটি আয়াতের উপর কিছু ভাবনা শেয়ার করা। সূরাটি হলো, সূরাতুল আ'রাফ। সুরাতুল আ’রাফের শুরুর দিকে আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া জাল্লা আদম আলাইহিস সালামের ঘটনা তুলে ধরেন। এই ঘটনার কিছু কিছু বিবরণ কুরআনের মোট সাত জায়গায় পাওয়া যায়। প্রতিবার ঘটনার নতুন কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং এটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়। বরং একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। তাই সুরাতুল আরাফে ঘটনার নির্দিষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করা হয়েছে। এখান থেকে যে শিক্ষা আমরা লাভ করবো তা একেবারেই অনন্য। আপনি এ শিক্ষা বাকারায় পাবেন না, পরের দিকের সূরা সাফফাত বা অন্য সকল স্থানে ঘটনার যে বিবরণ দেয়া হয়েছে সেখানেও এই শিক্ষা পাবেন না।

এটা কুরআন অধ্যয়নের মূলনীতির অংশ। কেউ হয়তো বলতে পারে, আমি তো নবীদের ঘটনা জানি। আমি ইতোমধ্যে আদম আলাইহিস সালামের ঘটনা জানি বা মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা প্রভৃতি জানি। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিবার আল্লাহ যখন কোনো ঘটনা বর্ণনা করেন তিনি আসলে আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন কিছু পাঠ শিক্ষা দিচ্ছেন এবং পৃথক পৃথক প্রজ্ঞা শিক্ষা দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, আজ আপনাদের জন্য সে প্রজ্ঞাগুলোর একটির উপর গুরুত্ব দিবো। আর তা হলো, শুরু থেকে আল্লাহ কীভাবে মানব জাতির সৃষ্টি নিয়ে কথা বলেছেন। খুৎবার শুরুতে আমি আয়াতটি তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেন, وَلَقَدْ خَلَقْنَاكُمْ - আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, ثُمَّ صَوَّرْنَاكُمْ - (অধিকন্তু, আমি শুধু তোমাদের সৃষ্টি করিনি) আমি তোমাদের রূপও দান করেছি। আল্লাহ আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পর্বত সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণাধারা। আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন সম্প্রসারিত মহাবিশ্ব। আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন ঝিকমিক করা তুষার কণা, বরফ কণা। আল্লাহর সৃষ্টি সবকিছুতেই আছে মনকাড়া সৌন্দর্য।

আল্লাহ স্বাভাবিক বর্ণনাভঙ্গির বাহিরে গিয়ে কোনো কিছুর সৌন্দর্য বর্ণনা করেন না। শুধু এটা বলেন যে, তিনি অমুক জিনিস সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু যখন আমাদের (মানুষের) কথা আসে, তিনি বলেন, তিনি শুধু আমাদের সৃষ্টি করেননি; অধিকন্তু তিনি আমাদের রূপ দান করেছেন। আমাদের তিনি শৈল্পিক নিপুণতায় তৈরি করেছেন।

‘রূপ দান’ করার ব্যাপারটা হলো, আরবি ভাষায় تصوير … উর্দুতেও শব্দটি আছে। অর্থ হলো, ছবি। আরবিতে অবশ্য এর জন্য ব্যবহৃত শব্দ হল, صوره কিন্তু تصوير মানে, আকৃতি দান করা, শৈল্পিক সৌন্দর্য দিয়ে কোনো কিছুর রূপ দান করা। এখানে যে ব্যাপারটা বোঝানো হচ্ছে- এটা করা হয়েছে এক ধরণের শৈল্পিক চেতনা থেকে। প্রয়োজন থেকে করা হয়নি। যদি প্রয়োজন থেকে কিছু তৈরি করতে হয়, বাল খালাকতাহু। কিন্তু কোনো কিছু তৈরি করার পর যদি আপনি একে সাজাতে চান, সৌন্দর্য মণ্ডিত করতে চান, নিখুঁত করতে চান- তখন পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আপনি এর তাসউইর করেন। আপনি এর সুন্দর রূপ দান করেন, শৈল্পিক নৈপুণ্য দান করেন। আল্লাহ্‌ আজ্জা ওয়া জাল্লা বর্ণনা করেন- মানুষকে সুন্দর আকৃতি দান করা হয়েছে, শৈল্পিক নৈপুণ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

কুরআনে অন্য স্থানে আল্লাহ এর মূল শব্দ ‘হুসন’ ব্যবহার করেছেন। অতএব, আল্লাহ্‌ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেন, لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡۤ اَحۡسَنِ تَقۡوِیۡمٍ - সুরা তীনের বিখ্যাত আয়াত। ‘অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে, সুন্দরতম আকার আকৃতি দিয়ে।’

আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা সূরা গাফিরে বলেন, وَّ صَوَّرَکُمۡ فَاَحۡسَنَ صُوَرَکُمۡ - ‘আর তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দিয়েছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতিকে সুন্দর করেছেন’। তিনি এখানে পরবর্তী পদক্ষেপর কথা বলেছেন। শুধু আকৃতি দান নয়, যা নিজেই সুন্দর। তিনি এর সাথে আরেক ধাপ সৌন্দর্য যোগ করলেন।

এটা জানা জরুরী। কারণ, আল্লাহ্‌ আজ্জা ওয়া জাল্লা কুরআনে বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করছেন মানুষের সৌন্দর্য এবং আকর্ষণীয়তার প্রতি। মানুষ আকর্ষণীয় এক সৃষ্টি। মানুষ আল্লাহর অনিন্দ্য সুন্দর এক সৃষ্টি। আর এটি মানব জাতির খুবই শক্তিশালী একটি দিক।

বস্তুত, আজকের বিশ্বে মানুষের সৌন্দর্য ঘিরে যে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে, তা সবচেয়ে বেশি লাভজনক ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মাঝে অন্যতম। কস্মেটিক শিল্প থেকে শুরু করে, ফ্যাশন শিল্প, পোশাক শিল্প, ফিল্ম শিল্প সবকিছুতে সৌন্দর্যকে পুঁজি করে তারা ব্যবসা করে। কীসের ভিত্তিতে তারা অভিনেতা, অভিনেত্রী, মডেল ইত্যাদি নির্বাচন করে। এমনকি কিছু কিছু নোংরা শিল্পেও তারা এই ধারণাকে কাজে লাগায় যে, মানুষ সহজাতভাবে সুন্দর এবং নিজেরা অন্য মানুষের সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষিত। তারা এটাকে পুঁজি করে ব্যবসা করে। অগণিত টাকা-পয়সা উপার্জন করে। অতএব, এটি খুবই শক্তিশালী একটি জিনিস, যা আল্লাহ মানবজাতিকে দিয়ে অলঙ্কৃত করেছেন, নারী পুরুষ সবাইকে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, এখন এটা বলার পর...আমি আপনাদের বলেছিলাম এই খুতবা আদম আ. এর ঘটনা নিয়ে। আমি মনে করি, এখানে উপস্থিত সবাই ঘটনাটি কমবেশি জানেন। জান্নাতে আমাদের পিতামাতাকে একমাত্র যে নির্দেশনাটি প্রদান হয় তা ছিল, এই গাছের নিকটে যেও না। ‘লা তাকরাবা হা-জিহিস সাজার’। তোমরা দুজনে এই গাছ থেকে দূরে থাকো। এই গাছের ধারে কাছেও যেও না। এটাই ছিল একমাত্র নির্দেশ।

যদি কুরআনের টেক্সট ভালভাবে খেয়াল না করেন, তাহলে আপনার মনে হবে, শয়তানের লক্ষ্য ছিল আমাদের পিতামাতাকে ঐ গাছের ফল আহার করানো। এটাই ছিল তার লক্ষ্য। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এটাকে শয়তানের লক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করেননি। এটা আমার আশা ছিল। আমি আশা করেছিলাম শয়তানের উদ্দেশ্য ছিল...।

আল্লাহ্‌ বলেছেন, এই গাছের নিকটে যেও না। আর শয়তানের লক্ষ্য হবে তাদের গাছের নিকটবর্তী করা ও গাছ থেকে আহার করানো। সূরা বাকারায় আল্লাহ বলেছেন, আজাল্লাহুমাশ শাইতান। ‘শয়তান তাদের পদস্খলন ঘটালো।’ শয়তান তাদের উভয়ের দ্বারা সামান্য ভুল করাল। আমরা এখনো জানি না, সে পদস্খলনটি আসলে কী। কিন্তু সুরা আ’রাফে আল্লাহ শুধু আমাদের বলেননি শয়তান কী করেছে, আল্লাহ্‌ আমাদের তার উদ্দেশ্যের কথাও বলেছেন। তো কেন সে তাদের গাছের নিকটবর্তী করতে চেয়েছিল। গাছ থেকে নিষিদ্ধ ফল আহার করানোই কি তার লক্ষ্য ছিল? নাকি তার মাথায় অন্য আরও উদ্দেশ্য ছিল যা মানবজাতিকে ধ্বংস করে ছাড়বে।

আমাদের একটি ব্যাপার বুঝতে হবে। এমনকি দিনশেষে, আদম আলাইহিস সালামকে একটি নির্দিষ্ট গাছ সম্পর্কে বলা হলো, এই গাছের ফল তোমার জন্য হারাম, এই গাছের ফল খাওয়া তোমার জন্য নিষিদ্ধ। তিনি ও আমাদের মা সে ঐতিহাসিক ভুলটি করলো এবং আমরা সেই গাছের ফল আহার করলাম।

কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে যদি যৌক্তিক দৃষ্টিতে চিন্তা করেন। আমরা জীবনে অসংখ্য ভুল করে থাকি। আর মানুষ এই দুনিয়াতে আসার পর মারাত্মক সব অপরাধ করে থাকে। মানুষ খুন করে, ধর্ষণ করে, লুটতরাজ চালায়, ডাকাতি করে, চুরি করে, অন্য দেশে আক্রমণ চালায়, অন্য মানুষের সম্পদ দখল করে নেয়, অন্যদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। আমরা সবধরনের ভয়ংকর সব অপরাধ করে থাকি।

এখন যদি এই সমস্ত অপরাধকে একটি গাছের ফল ভক্ষণ করার অপরাধের সাথে তুলনা করেন; এটাকে তেমন বড় অপরাধ বলে মনে হয় না। এমনকি কুরআনেও আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘আজাল্লাহুমা- সে তাদের পদস্খলন ঘটাল’। সে তাদের দ্বারা সামান্য ভুল করালো। আপনাদের মনে হতে পারে, এটা তো মানব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভুল। আর আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এর মাত্রা কমিয়ে একে সামান্য ভুল বলে আখ্যায়িত করলেন!

কিন্তু শয়তান এখানে শুধু ফল খাওয়ার চেয়েও বড় কিছু দেখল। শুধু গাছটির নিকটবর্তী হওয়ার চেয়েও সে এখানে বড় কিছু দেখল। তার ছিল খুবই সুনির্দিষ্ট একটি উদ্দেশ্য। এ ব্যাপারটার উপরেই আজকে গুরুত্ব দিতে চাই। খুৎবার দ্বিতীয় অংশ দেখুন পরবর্তী পর্বে। দ্বিতীয় পর্ব

মূল ইংরেজি খুৎবা থেকে অনুবাদ।

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ