শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


নতুন শিক্ষাবর্ষে যেভাবে শুরু হতে পারে কওমি শিক্ষার্থীদের দিনগুলি: মুফতী মনসুরুল হক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাওয়ালের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে কওমি মাদরাসাগুলোতে শুরু হয় নতুন শিক্ষাবর্ষ।  করোনা মহামারী-বিধি নিষেধের কারণে এবার বন্ধ রয়েছে মাদ্রাসাগুলো। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনলাইন অফলাইনে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করছে দেশের কওমি মাদরাসাগুলো। এখন শুধু সরকারি নির্দেশনার অপেক্ষা। নির্দেশনা পেলেই শুরু হবে নতুন শিক্ষাবর্ষ, শিক্ষার্থীদের নতুন পথ চলা।

শিক্ষা বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের কোন বিষয়গুলোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নতুন পথ চলা মসৃণ করতে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কি ধরনের ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারেন, এজাতীয় নানা দিক নিয়ে জামিয়াতুল আবরার রাহমানিয়া মাদরাসার প্রধান মুফতি, শাইখুল হাদিস মুফতী মনসুরুল হকের সাথে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের সাব-এডিটর নুরুদ্দীন তাসলিম। তিন পর্বের এই ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব  আজ তুলে ধরা হল আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য।


 

বছরের শুরুতেই কোন দিকগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের বিশেষ গুরুত্ব ও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন?

শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকটি বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক।

বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরা হল;

১. নিয়ত সহীহ করা। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যে আমি দ্বীনে ইলম শিক্ষা করছি । এ কথা অন্তরে বদ্ধমূল রাখা। এতে করে সব কিতাব সমান গুরুত্বের সাথে পড়া সহজ হবে। হযরত থানবী রহ. বলতেন; আমি কুরআন-হাদীস বিষয়ক কিতাব পড়িয়ে যে রকম সাওয়াবের আশা করি, মানতেক-ফালসাফার কিতাব পড়িয়েও সে রকম সাওয়াবের আশা রাখি।

২. দেওবন্দী আকাবিরদের জীবনী পড়ে তাদের মত জীবন গড়ার সুবৃহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা। লক্ষ্য নির্ধারণ থাকলে লক্ষ্য অর্জনে মেহনত করা সহজ হয়। এতে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাও আসান হয়।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা সহজ হবে। একজন লক্ষ্য নির্ধারণ করল, সে এখান থেকে (মোহাম্মদপুর) পার্শবর্তী সুপার মার্কেট যাবে। তাহলে উক্ত ব্যক্তির বায়তুল মোকাররম যাওয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে সুপার মার্কেট গিয়েই থেমে যাবে। এমনিভাবে যে যোগ্য ছাত্রের লক্ষ্য কেবল পাশ করা সে কিভাবে পরীক্ষায় এক নম্বর হবে। বরং তার তো ফেল করার আশংকা রয়েছে।

এক আলেম তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল তুমি কার মত হতে চাও? ছেলে বলল; আপনার মত। তখন সেই আলেম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ছেলে বলল; আপনি চিন্তিত কেন, আমি কি খারাপ কিছু বলেছি? আপনি তো বড় আলেম, মানুষের মাঝে আপনার বেশ সম্মান! তখন সেই আলেম পিতা বললেন; আমি তো হযরত আলী রা: এর মত হওয়ার নিয়তে চেষ্টা-মেহনত করে পড়া-শুনা করে এ পর্যন্ত পৌঁছেছি। আর তুমি যখন আমার মত হওয়ার নিয়তে পড়া-শুনা করছো, তখন তোমার ইলমী যোগ্যতার যে কী করুণ দশা হবে তা বলাই বাহুল্য। তাই সংকীর্ণ চিন্তা পরিহার করে প্রশস্ত চিন্তার অধিকারী হতে হবে।

৩. বছরের শুরুতেই প্রত্যেকটি ছাত্র তৎসংশ্লিষ্ট জামাআতের প্রত্যেকটি কিতাব পড়ার উদ্দেশ্য কী তা আলাদা আলাদা ভাবে জেনে নিবে। এই উদ্দেশ্য কোন কোন মুসান্নিফ নিজেই কিতাবের শুরুতে লিখে দিয়ে থাকেন। যেমন; নাহবেমীরে লেখা আছে। কিতাবে লেখা না থাকলে সংশ্লিষ্ট উস্তাদ থেকে জেনে সে অনুযায়ী মেহনত করে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এবং মাঝে মাঝে নিজেকে উস্তাদের সামনে সোপর্দ করে উস্তাদের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হবে যে, আমার এই কিতাব পড়ে যে ইস্তেদাদ ও যোগ্যতা অর্জন করার কথা ছিল, সে উদ্দেশ্যে আমি সফল হয়েছি কিনা? উস্তাদ পরীক্ষা করে বলে দিবেন এক্ষেত্রে তুমি কতটুকু সফল। কোনো ত্রুটি প্রকাশ পেলে চেষ্টা মেহনত করে তাতে পূর্ণতা আনতে হবে।

৪. সারা বছর দরসে উপস্থিত থাকার দৃঢ সংকল্প বছরের শুরুতেই করতে হবে। আমাদের বুযুর্গরা বলে থাকেন;

علم سینہ بسینہ  অর্থাৎ আমাদের মাদরাসা মহলে ঐ ব্যক্তিকে আলেম বলা হয় না যে কেবল কিতাব পড়ে জ্ঞান অর্জন করেছে।

আলেম হতে হলে কোন বিজ্ঞ উস্তাদের শরণাপন্ন হয়ে ইলম অর্জন করতে হবে। কারণ, উস্তাদের দিলী তাওয়াজ্জুহ ইলমের মধ্যে বরকত হওয়ার অন্যতম কারণ। এর দ্বারাই সনদ হাসিল হয়। তাই যারা ক্লাসে উপস্থিত থাকে না তারা এই বরকত থেকে মাহরূম হয়।

৫. মুতালাআ, তাকরার, সবক ইয়াদ ও সবকে উপস্থিত নিয়মিত হতে হবে। এ ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হওয়া।
হযরত থানবী রহ. বলেছেন; কোন ছাত্র নিয়মিত তিনটি কাজ করলে আমি তার আলেম হওয়ার দ্বায়িত্ব গ্রহণ করলাম। ১. নিয়মিত সবক মুতালাআ করা ২. দরসে মনোযোগের সাথে সবক শুনা। ৩. তাকরার করা।

৬. গত বছরের আহাম কিতাবগুলো একবার দেখে নেওয়া। কারণ, ঐ সব কথাগুলো এ বছরের কিতাব বুঝার জন্য জরুরী।

৭. যারা ভাল ছাত্র, তৌফিক আছে, তারা মাঝে মাঝে মুতালাআ করার মাধ্যমে আহাম কিতাবগুলোর নির্ভরযোগ্য শরাহসমূহের সাথে পরিচিত হবে।

 

একজন শিক্ষার্থীর জীবনে তালিমি মুরব্বি, ইসলাহি মুরব্বির প্রয়োজনীয়তা ও-এর প্রাসঙ্গিক দিকগুলো নিয়ে যদি কিছু বলতেন?

একজন শিক্ষার্থীর জীবনে তালিমি মুরব্বির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতা কতটুকু এর জন্য রওযাতুল আদবের একটি বাক্যই যথেষ্টে। বাক্যটি হলো:

سل المجرب ولا تسأل الحكيم অর্থাৎ তুমি অভিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট থেকে তোমার সমস্যার সমাধানটা জেনে নাও। অনভিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট জানতে চেও না (যদিও সে জ্ঞানী হোক না কেন)।

তাই আমি বলি; একজন ছাত্র কিভাবে শিক্ষাজীবনে সফল হতে পারে এ ব্যাপারে তোমার উস্তাদরা হল অভিজ্ঞ। তাই সফল জীবন গড়তে চাইলে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে হবে। অনেক ছাত্র আছে নিজেই নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়। কখনো তারা কোন কোন ব্যক্তির কিতাব পড়ে উস্তাদের পরামর্শ না নিয়ে নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করে থাকে। ফলে তারা ব্যর্থ হয়। আমি বলি; এই কিতাব হলো হাকিম, মুর্জারাব নয়। তাই শুধু কিতাব পড়ে উস্তাদকে না জানিয়ে আমল করা যাবে না।

প্রত্যেক মুতাওয়াসসিত থেকে উপরের শিক্ষার্থীর জীবনে ইসলাহী মুরব্বির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু এর জন্য ইমাম শাফিয়ী রহ. এর শের দুটোই যথেষ্টে। শের দুটোই হলো:

شكوت إلي وكيع سوء حفظي

فاوصاني إلي ترك المعاصي

فان العلم نورمن الهي

ونور الله لا يعطي لعاص

(অর্থ:) আমি (আমার উস্তাদ) ওয়াকীর নিকট আমার স্মরণশক্তির দুর্বলতার কথা তুলে ধরলে তিনি আমাকে গুনাহ পরিত্যাগ করার অসীয়ত করলেন। কেননা, ইলম হল আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর। আর আল্লাহর নূর কোন পাপী ব্যক্তির ভাগ্যে জুটে না।

গুনাহে অভ্যস্ত ছাত্র পরীক্ষায়  রেজাল্ট হতে পারে, কিন্তু তার যেটা হাসিল হয়েছে তা ইলম নয়, বরং মা‘লুমাত। ইলম কলবে থাকে যা মানুষকে কোন গুনাহ করতে দেয় না। এটা কুরআনের কথা।

বর্তমানে ইসলাহী মুরব্বী ছাড়া গুনাহমুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব। সুতরাং ইলমের সার্বিক উন্নতির জন্যে সচেতন শিক্ষার্থীদের ইসলাহী মুরব্বী গ্রহণ করাও আবশ্যক।

 

আমাদের আকাবিররা তালিমি মুরব্বি মানার বিষয়টিকে কতটা গুরত্ব দিতেন, এক্ষেত্রে তাদের জীবনের সাফল্যের দিকগুলো নিয়ে যদি কিছু আলোচনা করতেন?

আমাদের আকাবিরদের তালিমি মুরব্বি ছিল। তালীমী মুরব্বির পরামর্শ ছাড়া তারা নতুন কোন কিতাব পড়তেন না ।

মুফতী শফী রহ. এর পিতা ইয়াসীন রহ. ছিলেন হযরত থানবী রহ. এর সহপাঠী। ইয়াসীন রহ. তার ছেলেকে (মুফতী শফী রহ.)হযরত থানবী রহ. এর নিকট নিয়ে গেলেন  মুফতী শফী রহ.-এর মানতেক-ফালসাফা না পড়ার বিষয়ে পরামর্শ করার জন্যে

তখন ইয়াসীন রহ. থানবীকে রহ. বললেন; গাঙ্গুহী রহ. মানতেক পড়তে না করেন, অপর দিকে নানুতবী রহ. এর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আপনার মন্তব্য কী?

তখন হযরত থানবী রহ. বলেন, গাঙ্গুহী রহ. নাস্তিক হওয়ার আশঙ্কায় নিষেধ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আপনার ছেলে আশঙ্কামুক্ত। তাই তার পড়া উচিত। তখন ইয়াসীন রহ. তাই করলেন। এভাবে আমাদের আকাবিররা তালীমী মুরব্বির গুরুত্ব দিয়েছেন।

এতে করে তাদের জীবন সফল হয়েছে। এক সময়ের মুহাম্মাদ শফী, মুফতী শফী হয়ে জগত আলোকিত করেছেন।
এরূপ অসংখ্য ঘটনা কিতাবে পাওয়া যায়। এখানে কিছু নমুনা দেখানো হলো। শাইখ যাকারিয়া রহ. এর তালীমী মুরুব্বী ছিলেন মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রহ.। তিনি যাকারিয়া রহ. কে বিশ্বখ্যাত শাইখুল হাদীস বানিয়েছেন।

 

গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের মাঝে আদব-কায়দার দিকগুলোতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন এ ব্যাপারে আপনার অভিমত আশা করছি?

বাস্তবেই বিষয়টি এমন। দিন দিন আদব-কায়দার অবনতি হচ্ছে। ফলে ফলাফল যা হচ্ছে তা আমাদের সামনে স্পষ্ট। অথচ আকাবিরদের বক্তব্য হলো; যারা বঞ্চিত হয়, তারা কেবল আদব না মানার কারণেই বঞ্চিত হয়। যারা কিছু অর্জন করেছে তারা আদব-আখলাকের কারণেই অর্জন করতে পেরেছে। কাজেই কথাটা চরম সত্য ও বাস্তব।   -চলবে

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ