ড. মো. ইব্রাহীম খলিল
নিজ ঘরানার ভেতর মোটামুটি বিখ্যাত একজন তরুণ ওয়ায়েজ সম্পর্কে শুনলাম। এবার তিনি হজ করেছেন। প্রায় প্রতি বছরই করেন। ভক্ত-অনুরক্তরা তার হজের ব্যয় বহন করেন। হজের সফরে তিনি ক্লক টাওয়ারে ছিলেন। তার প্যাকেজটি ছিল পাঁচ তারকা মানের। মোট খরচ হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা।
শুনে খুশি হয়েছি। যাক, আলেমদের পেছনে এতো এতো টাকা খরচ করার লোক রয়েছেন। আলেমরা তাদের বয়ান ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে এমন অবস্থান তৈরি করেছেন।
শুনে দুঃখও পেয়েছি খুব। একই হজ তো ১০ লাখ টাকার মধ্যেও করা সম্ভব ছিল। তাতে ৩৫ লাখ টাকা সেইভ হতো। এই টাকায় কমপক্ষে ৩৫টি নিম্নবিত্ত পরিবারের এক বছরের খাবার হতো। ৩৫ জন তালিবে এলেমের এক বছরের পড়ার খরচ হতো। ৩৫ বা ৭০ জন চিকিৎসাগ্রহণে অপরাগ রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যেতো। করা যেতো এমন অনেক কিছু। তাতে হজের মর্তবা কিছু কম হতো বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে প্রতি বছর হজ করা অনেকের ফ্যাশন ও প্যাশনে পরিণত হয়েছে। অথচ হজ জীবনে ফরজ একবারই। আর সবসময়ের ফরজ হলো গরীব নিকটাত্মীয় থেকে পর্যায়ক্রমে দূরের আত্মীয়দের হক আদায় করা। প্রতিবেশীর হক আদায় করা। যারা বারবার হজ করছি বা এমন আলেমদের মাধ্যমে হজ করাচ্ছি তারা কি হক আদায় করার মতো প্রতিবেশি বা আত্মীয়-স্বজন পাচ্ছেন না?
অথচ আমাদের চারপাশে ১৬ ঘণ্টা টিউশনি করে পড়ালেখা ও পরিবার চালানো শিক্ষার্থী আছে। টাকার অভাবে তিনবেলা না খাওয়া শিক্ষার্থী তো আছে অসংখ্য। চিকিৎসা নিতে পারছেন না, বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, আত্মসম্মানে বাধে বলে হাতও পাততে পারছেন না, চারপাশে এমন মানুষের সংখ্যাও তো কম নয়। দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করা প্রায় ৩০ ভাগ লোক তো আপনার আমার আশেপাশেই আছেন। আমার এক সমাজ সেবক শিক্ষার্থী সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে কতদিন আগে একটি টিউবওয়েলের সাহায্য চেয়েছেন, পারিনি। নিজ গ্রামে তরুণদের মাদকমুক্ত জীবন গড়তে সাহায্য চেয়েছেন আরেকজন। পারিনি। এ রকম অসংখ্য না পারার বেদনা আমাদেরকে গ্লানিমায় ঢেকে দেয়। চুপ করিয়ে রাখে।
প্রতিদিন অনলাইনে, অফলাইনে বাকরুদ্ধ হওয়ার মতো অসংখ্য মানবিক গল্প আমরা পড়ি, শুনি। আহ উহ করি, কিন্তু ব্যয় করার সময় কীভাবে কীভাবে যেনো সেগুলো আর আমাদের হিসেবে আসে না।
আমার জ্ঞান কম, বোধবুদ্ধিও কম। তারপরও আমার বারবার মনে হয়, অপচয়, অপব্যয়ের হিসাব আল্লাহ সর্বত্রই নেবেন। বিশেষত ‘আমলে সালেহের নামে অপব্যয়-অপচয় তো বিশেষভাবে হিসাবযোগ্য, কেননা এদেরতো দীনের জ্ঞান ছিল।
আমার বুঝতে ভুল হতে পারে, কিন্তু আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি, আত্মীয়ের হক অনাদায়ী রেখে, প্রতিবেশীর হক অনাদায়ী রেখে, আশেপাশের লোককে নিরন্ন বা বিপদগ্রস্ত রেখে অথবা সম্ভাবনাময় মেধাবীদের মেধাবিকাশের পথ রুদ্ধ দেখার পর সাধ্য থাকা সত্ত্বেও তা দূর না করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নিজে বারবার বা কোনো যুগশ্রেষ্ঠ আলেমকে দিয়ে একবার বা বহুবার হজ করালেও তা কবুল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
প্রতি বছর ২০-২৫ লাখ লোক হজ করেন। চোখের অশ্রুতে কালো গেলাফ ভিজিয়ে, আরাফাহকে ভাসিয়ে এতো এতো দোয়া যে তারা করেন এবং তারপরও যে আমাদের অবস্থা একই রকম থেকে যায়, তা থেকেও আমাদের বোঝা উচিত, কোন কাজে আল্লাহ বেশি খুশি আর কোন কাজে কম!
আমাদের কী হলো? আমরা গোপন উত্তম কাজগুলোর চেয়ে প্রচার ও প্রকাশের আলোতে আসা কাজগুলোর ব্যাপারে এতো মনোযোগী হয়ে গেলাম কেনো? অথচ আমরাই বারবার মানুষকে শোনালাম, “আল্লাহর কাছে তোমাদের কুরবানী পশুর গোশত-রক্ত পৌঁছায় না। পৌঁছায় তাকওয়া।”
আমাদের জীবনে কি তাকওয়ার কোনো ছাপ বা ছোঁয়া আসলেই প্রতিফলিত হচ্ছে? আমরা কি আসলেই আমাদের রবের সামনে নিয়ে দাঁড়ানোর মতো কোনো কিছু সঞ্চয় করতে পারছি?
রাব্বানা জলামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাছিরীন....
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; বহুগ্রন্থ প্রণেতা
এমএইচ/