|| ইফতেখার জামিল ||
আমি কওমি মাদরাসার কোর সিলেবাস পাল্টানোর বিপক্ষে। আলিয়া মাদরাসায় তো সিলেবাস পাল্টানো হয়েছিল এবং আলিয়ার বর্তমান সিলেবাস যথেষ্ট চমৎকার। তবে এই ‘ভালো সিলেবাসটাই’ আলিয়া মাদরাসায় বিপর্যয় ঘটাল। ইউ সি—ভালো-খারাপ অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট আপেক্ষিক বিষয়। আপনি যদি নলেজ-ইকোসিস্টেম না বোঝেন, তবে আপনি আপাতত যাকে ভালো মনে করছেন, সেটাও বিপদের কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। আলিয়াতে হয়েছেও তাই—ছাত্রদের মাথায় বিরাট বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারাকেই জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। আলিয়ার ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মাদরাসার পরিচয়টা ধরে রাখতে চাচ্ছেন না/পারছেন না।
কওমির ফিকাহের সিলেবাসের কথাই ধরুন—কুদুরি-শরহে বেকায়াহ-কানয-হেদায়া। এখানে খুব বেশি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। আমার মালয়েশিয়ান শিক্ষকদের একটা বড় অংশ জর্ডানে পড়াশোনা করেছেন, এবং তাদের প্রত্যেককেই হেদায়া পড়তে হয়েছে। প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন গড়ে ওঠেছে প্রধানত হেদায়াকে কেন্দ্র করে। পাশাপাশি, দক্ষিণ এশিয়ায় এককভাবে হেদায়া নিয়ে যত কাজ হয়েছে-গবেষণা হয়েছে, অন্য কোনো পাঠ্যবই নিয়ে এর দশ ভাগের একভাগও হয়নি। এখন বলেন, কুদুরি-হেদায়া পরিবর্তন করার কি কোনো সুযোগ আছে? শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বৈশ্বিক বিচারেও হেদায়ার মতো কিতাবের প্রতিতুলনা খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।
তবে অসুবিধাটা হচ্ছে কোথায়? আমি দেশে আসলে বিভিন্ন মাদরাসায় যাই, কথা বলি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, আমার কথা বুঝতে ছাত্রদের বেগ পেতে হচ্ছে। হেদায়া পড়ার জন্য যে মাপের লিটারেসি দরকার, সেটা অনেকেরই নেই। এই সংকটকে কীভাবে মোকাবেলা করবেন? কুড়িগ্রামের একটা গ্রামীণ মহিলা মাদরাসার কথাই ভাবুন—যেখানে পনের বছর বয়সী ‘জোলেখা খাতুন’ হেদায়া পড়ছেন, তার পক্ষে কি এই কিতাব বোঝা সম্ভব? ট্র্যাডিশন বোঝার জন্য যে কমপ্লেক্স সেট অফ টুলস দরকার, সেটা তো গ্রামীণ মাদরাসার ‘জোলেখা খাতুন-জালালুদ্দিন’ আত্মস্ত করার মতো সময়-সুযোগ-রিসোর্স পান না।
এর একটা ভালো সমাধান হলো, মাদরাসাগুলোতে এইচএসসি পর্যন্ত পড়িয়ে দেওয়া—যেমন হেদায়ার লেখক ইতিহাস-ভূগোলের কোন পর্বে বাস করতেন, সেই ইতিহাস-ভূগোল তাকে ঠিক কীভাবে প্রভাবিত করেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় হেদায়া কীভাবে পঠিত হয়েছে—এসবের প্রাথমিক সেন্স না থাকলে হেদায়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিতাবও আপনার কাছে বিশেষ তাৎপর্য বহন করবে না। সমস্যাটা কিতাবের না, আপনার লেন্স ও সেন্সের।
উল্টোদিকের বিপদও আছে—সোশিউলজি অফ রিলিজিউন সাধারণত খারাপ জিনিস। যারা ট্র্যাডিশন বুঝে না, তারা জেন্ডার থিউরি-পাওয়ার ডাইনামিক্স-ক্লাস স্ট্রাগল-পাবলিক ভার্সেস প্রাইভেট-সেকুলার ভার্সেস কনজারভেটিভের মতো বাইনারিগুলো ইউজ করে ট্র্যাডিশনকে ডিকনস্ট্রাক্ট করতে চায়। প্রশ্ন হলো, মেডিকেল বা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা একই প্রক্রিয়া ইউজ করেন না কেন? মেডিকেল-বিজ্ঞানের নিজস্ব কন্টেন্ট বলে কিছু থাকবে না—শুধু থাকবে মেডিকেল-বিজ্ঞানের পাওয়ার ডাইনামিক্স—সোশিওলজি অব সাইন্স।
এনিওয়ে, ইউ সি—দুনিয়াতে কুরআন-হাদিস ছাড়া সম্পূর্ণ পবিত্র/ভালো পাঠ্যপুস্তক বলে কিছু নেই। আপনাকে কাস্টমাইজ করে নিতে হবে।
লেখক: আলেম, গবেষক, চিন্তক ও অ্যাকটিভিস্ট