২০২২ সালের জানুয়ারিতে জার্মানভিত্তিক একটি রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান ও চীনের রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় পক্ষগুলোর চিন্তাধারা বিষয়ে জরিপ চালায়। সেই জরিপে তরুণ আলেমদের পক্ষে কথা বলেন জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মুফতি মাহমুদ হাসান মাসরুর। এই কথাগুলো আড়াই বছর আগের হলেও তা আজকের ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের বাস্তবতায়ও প্রাসঙ্গিক।
মুফতি মাসরুর বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ঘটনা হলো— আফগানিস্তানে ইসলামপ্রিয় তালেবানদের বিজয়, যা শুধু ইসলামের নয়, প্রাচ্যের বিজয়ও বটে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানকেন্দ্রিক তুর্কি জনগণের ইসলামের পক্ষে সাহসী অগ্রগতি এবং বিশ্বজুড়ে ইসলামের প্রতি আগ্রহ ও ইসলাম গ্রহণের হার বৃদ্ধিও ইতিবাচক ঘটনা।
তার মতে, নেতিবাচক দিকগুলোও রয়েছে। যেমন: সৌদি সরকারের কিছু ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী কর্মসূচি, মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলোতে ইসলামবিদ্বেষ বৃদ্ধি, ফিলিস্তিন সংকট, লিবিয়া-ইরাক-সিরিয়া-ইয়ামানের যুদ্ধাবস্থা এবং আসাম, কাশ্মীর, উইঘুর ও রোহিঙ্গা সমস্যার তীব্রতা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের ভূমিকা নিয়ে আলেম সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ভারসাম্যপূর্ণ। তারা মনে করে, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে যেসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়া দরকার, সেসব দেশের সঙ্গে আগে বেড়ে সম্পর্ক গড়া উচিত। চীনের সঙ্গে জোরদার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ করবে বলে তারা মনে করে।
ভবিষ্যতে চীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে কি না, এমন প্রশ্নে এই তরুণ আলেম বলেন— যদি কেউ কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, তা জাতি মেনে নেবে না। বাংলাদেশের মানুষ চায়, অভ্যন্তরীণ শক্তি বাড়িয়ে পররাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা হোক।
চীন একদিকে আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করছে, অন্যদিকে উইঘুর মুসলিমদের ওপর তাদের নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে তরুণ আলেমরা মনে করে, চীনের বিনিয়োগটা মানবিক নয়, বরং রাজনৈতিক স্বার্থপ্রসূত। এরপরও আফগানিস্তানের পাশে দাঁড়ানো ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চায় তরুণ আলেম সমাজ।
উইঘুর ইস্যুতে চীনের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ— ভবিষ্যতে আফগানরা সুসংগঠিত হলে এ বিষয়ে তাদের প্রতিবাদ শোনা যাবে বলেও মনে করেন এই আলেম।
তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে মুফতি মাসরুর বলেন, বিশ্বের কোনো জাতি যেন অপর জাতিকে ছোট না ভাবে, কেউ যেন অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন না করে--বিশ্বশক্তিগুলোকে এই শিক্ষা নিতে হবে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকা আফগানিস্তানের পক্ষ নিয়ে ছিল। তখন আফগান তালেবান ছিল হিরো। কিন্তু আফগানরা যখন আমেরিকার বিরুদ্ধে গেল, তখন তারা হয়ে গেল সন্ত্রাসী। আমরা সন্ত্রাসের এমন সংজ্ঞায় বিশ্বাসী না।ইসলামি রাজনীতিতে আমরা আফগান তালেবানের সফলতা কামনা করি। বিশ্ববাসীকেও তাদের মেনে নেওয়ার আহ্বান জানাই।
তার মতে, এই ঘটনাগুলো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন গতিপ্রবাহ তৈরি করেছে। পুরো অঞ্চলের ইসলামপ্রিয় রাজনীতিবিদদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। আগামীতে ভারত-পাকিস্তানের ওপর কাশ্মীর সমস্যার চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতি স্বাভাবিক গতিতেই আগে বাড়বে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভুলে গেলে হবে না, ভারত প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র। তাদের সাথে আমাদের অভিন্ন স্বার্থ অনেক। উভয় দেশের সমতাপূর্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য দুই দিক থেকে সমান সহযোগিতা থাকতে হবে। ভারত পক্ষের কিছু আচরণের কারণে বাংলাদেশে গণঅসন্তোষের বিষয়টি উপেক্ষা করার মতো নয়। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপ এখন আর গোপন নেই। এক্ষেত্রে ভারতকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিষয়ে আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে তিনি সীমান্ত হত্যা, নদী সমস্যা, বাণিজ্য বৈষম্য এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের কথাও বলেন। তিনি মনে করেন, কাশ্মীর ও আসাম সমস্যার সমাধান, শিল্পায়ন, কৃষি উন্নয়ন, মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ দমন— এসব ক্ষেত্রেও উভয় দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে।
ভারতের মুসলমানদের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় ইন্ডিয়া ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে বলে মুসলমানদের বিরাট অংশ ভারতে থেকে যেতে রাজি হয়, এর ফলে ভারতের মানচিত্র বড় হয়। এখন যদি মুসলমানদের ওপর আঘাত আসে, তাহলে ভারতে বর্তমান বিশালতা হুমকির মুখে পড়বে। বাস্তবতা হলো, ভারতের সংলঘুদের চেয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা অনেক ভালো আছে।
এমএম/