ইফতিখার জামিল
বাংলাদেশে শুধু স্থলপথেই নয়, সমুদ্রপথেও ইসলামের প্রসার ঘটেছিল—এই বক্তব্যের বিপরীত যুক্তি হলো, যদি বাংলাদেশে সমুদ্রপথে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারিত হতো, তবে কেরালা-মালদ্বীপ-মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশেও শাফেয়ি মাজহাব প্রতিষ্ঠিত হতো। তবে এই যুক্তিটি যথেষ্ট দুর্বল।
ক) মনে রাখা ভালো, প্রধানত বৃহত্তর ইয়েমেনের লোকেরা সমুদ্রপথে ইসলাম প্রচার করেছেন এবং ইয়েমেন অঞ্চলটা ইসলামের প্রাথমিক যুগে হানাফি অধ্যুষিত ছিল। অর্থাৎ ঈসায়ি নবম শতক পর্যন্ত ইয়েমেনের লোকজন প্রধানত হানাফি মাজহাবের অনুসারী ছিল—ইয়েমেনে এগারো শো/বারোশো শতক পর্যন্ত হানাফিদের তাৎপর্যপূর্ণ উপস্থিতি জারি ছিল।
এগুলো ফিকাহের ইতিহাসের প্রাথমিক স্তরের কথা—কাজেই, বৃহত্তর ইয়েমেন থেকে এই কালপর্বে যারা বাংলা এলাকায় এসেছিলেন, তারা প্রধানত হানাফি হবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
খ) ঈসায়ি বারোশো শতকের দিকে মঙ্গলদের আক্রমণে মধ্যএশিয়ার হানাফি অধ্যুষিত সালতানাতগুলো বিরানভূমিতে পরিণত হয়। আলেম-ওলামা-উমারাগণ দক্ষিণ এশিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য হন। মনে রাখা ভালো, হানাফি মাজহাবের বিকাশ ঘটেছিল প্রধানত মধ্যএশিয়ান অঞ্চলে। কাজেই, মঙ্গলদের আক্রমণের প্রেক্ষিতে ব্যাপকভাবে ব্রেইন-ড্রেইনের ঘটনা ঘটে। মধ্যএশিয়ান হানাফি স্কলারশিপ দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসে।
আপনারা কি এই ঘটনার তাৎপর্যটা ধরতে পারছেন? মুসলিম ইন্টালেকচুয়াল হিস্ট্রি না জানলে এর গুরুত্ব বোঝা খুবই কঠিন। ইয়েস—'দক্ষিণ এশিয়ান মুসলমানরা সহি ইসলাম জানত না, এই অঞ্চলে আলেম-ওলামাদের উপস্থিতি খুব কম ছিল'—এই কথাগুলো কেবল ভুলই নয়, মারাত্মকভাবে আত্মঘাতী।
গ) বারোশো-তেরোশো শতকের ব্রেইন-ড্রেইনের প্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ীভাবে হানাফিরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ঠিক একইসময়ে ইয়েমেনে শাফেয়িরা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কাজেই, বারোশো-তেরোশো শতকের পরে যারা বৃহত্তর ইয়েমেন থেকে বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের পক্ষে মধ্যএশিয়ান হানাফি স্কলারশিপকে আউটনাম্বার করা অসম্ভব ছিল। মালয়েশিয়া-মালদ্বীপ-কেরালায় হানাফি স্কলারশিপের বিস্তার ঘটেনি, কাজেই সেখানে ইয়েমেনিরা শাফেয়ী মাজহাব প্রচার করতে সক্ষম হয়।
ঘ) তবে এসব কিছু সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ও ভারতে শাফেয়ি স্কলারশিপের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল। আব্দুল হাই হাসানি হিন্দুস্থানে প্রচারিত শাফেয়ি স্কলারশিপের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছেন, প্রচুর গবেষণাকর্ম সামনে এনেছেন। যদি কেবল স্থলপথেই ইসলাম প্রচারিত হত, তবে ভারতবর্ষে এত শক্তিশালী শাফেয়ি স্কলারশিপ কীভাবে আসলো? সর্বোপরি, ভারতবর্ষে আহলে হাদিস মাজহাবের লোকজনের সংখ্যা মোটামুটি অনেক—মালয়েশিয়া-মালদ্বীপ-কেরালায় কখনোই আহলে হাদিসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। আমার হাইপোথিসিস হল, ভারতবর্ষের শাফেঈদের একটা বড় অংশ পরবর্তীতে আহলে হাদিসে কনভারট হয়ে যান। এর স্বপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হল, ভারতবর্ষের বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের অনেকে শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। মোটকথা, বাংলাদেশ যেহেতু হানাফি অধ্যুষিত দেশ, কাজেই এই দেশে সমুদ্রপথে ইসলাম প্রচারিত হয়নি বলে যে যুক্তি চালু আছে, সেটা কেবল ভুলই নয়, বরং স্পষ্টভাবে ইতিহাসতত্ত্ববিরোধী। অবশ্য এই যুক্তি ভুল হলেও সমুদ্রপথে ইসলাম প্রসারের বিষয়টি এখনো ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়।
লেখক: গবেষক, চিন্তক অ্যাকটিভিস্ট
এসএকে/