বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ ।। ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১ জিলকদ ১৪৪৫


‘একটি বই যেভাবে স্পর্শ করে আমাদের জীবন ও সমাজ’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| সাবের চৌধুরী ||

গত সপ্তাহে খুব সুন্দর একটি বই সংগ্রহে এলো। বইটি আগেও দেখেছি। কিন্তু পড়ব পড়ব করেও শেষ পর্যন্ত সুযোগ হয়ে উঠেনি। এবার মনোযোগ দিয়ে পড়া হলো। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল বেশ আগে, ঢাকার নামি প্রকাশনী মাকতাবাতুল আযহার থেকে। এবার মেশক প্রকাশনি থেকে বের হয়েছে এর নতুন সংস্করণ, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত আকারে, নতুন প্রচ্ছদে। আগের প্রচ্ছদটিও ‍সুন্দর ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু এবারের প্রচ্ছদটি আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। প্রচ্ছদের গায়ে নিরংকুশভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গাঢ় মায়াবি নীল রং। তার উপরে ক্যালিগ্রাফির শিল্পিত ভঙ্গিতে হরফের কারোকাজ। হরফগুলো বিন্যস্ত হয়েছে হালকা কালোছায়ার উপরে গভীর হলুদ রংয়ের শরীর নিয়ে। একদম নীচের দিকে বইয়ের নাম ও লেখকের নাম। সব মিলিয়ে প্রচ্ছদটি পরিমিত, পরিমার্জিত ও পরিচ্ছন্ন। শীতল ও মায়াবি একটা আবহ দৃষ্টিকে আনন্দিত করে। নজর পড়লেই হাতে নিতে ইচ্ছে করে। কাজটা করেছেন এই সময়কার প্রচ্ছদবোদ্ধা মননশীল শিল্পকারিগর কাজী যুবাইর মাহমুদ। এ মানুষটা আমাদের শিল্প অঙ্গনে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিভা। অনেক বছর যাবত কাজ করছেন, কিন্তু সতত প্রকাশিত হচ্ছেন নতুন রূপ ও বিভা নিয়ে। এ বইটিতে তার সে শিল্পমগ্নতা ও শিল্পরুচির সযত্ন ছাপ লক্ষ করা যায়।

প্রচ্ছদে নামের জায়গাটিতে উপরের লাইনে ছোট ছোট হরফে লেখা: ইমাম আবু হানীফা রহ.। সৌন্দর্যের দায় থেকে প্রতিটি হরফের মাঝে একটু করে খালি জায়গা ছেড়ে রাখা হয়েছে। এর নীচে বড় করে লেখা হয়েছে ‘আকাশে অঙ্কিত নাম’। উভয় অংশ মিলে পূর্ণ একটি বাক্যের ধারণা পাওয়া গেলেও দুটো অংশেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব। উপরের অংশটি বইয়ের বিষয় ও প্রকৃতিকে নির্দেশ করছে এবং বড় হরফে লেখা তিন শব্দের বাক্যাংশটি বইয়ের মূল নামকে প্রকাশ করার পাশাপাশি বিশেষ একটি সংবাদও বহন করছে। সেই সংবাদটি কী? প্রথম দর্শনে মনে হবে ইমামে আ’জম আবু হানীফা রহ. এর জীবন ও ব্যক্তিত্বের উচ্চতা বুঝানোর জন্য সাধারণ শিল্পবিবেচনা থেকে শব্দতিনটিকে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু একটু দূর দর্শন থেকে আমার মনে পড়েছে অন্য একটি বিষয়। এক হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছিলেন: শরীয়তের ইলম দূর আকাশে সুরাইয়া  নক্ষত্রের কাছে চলে গেলেও পারস্যের এক মানুষ একে সেখান থেকেই ছিনিয়ে আনবে। বড় বড় আলেম, পণ্ডিত, ইমাম ও হাদীস বিশারদগণ বলেছেন—এই মানুষটা হলেন ইমাম আবু হানীফা। তার কথাই নবীজি হাদীসের মধ্যে এমন সাংকেতিক ভাষায় বলে গেছেন। হাদীসটি যখন প্রথম পড়ি এবং সাথে এই ব্যাখ্যা শুনি, তখন আমার তরুণ মনে অদ্ভুত সুন্দর একটি চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে বহু দূর দিগন্তে ধূসর আকাশের পাড়ে শুভ্র উজ্জ্বল একজন মানুষ হাত বাড়িয়ে ছিনিয়ে আনছেন ঝলমলে একটি নক্ষত্র, আর সেই সাথে আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। হুবহু এ চিত্রকল্পটি প্রতীকি, সন্দেহ নেই; কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইমামে আজম রহ.-কে যখন নানাভাবে জানবার সুযোগ পাই তখন আমি রীতিমতো দ্বিধায় পড়ে গেছি। এ চিত্রকল্পের গভীর যে ব্যঞ্জনা, তা তো সত্যিই; এমনকি আমার কাছে মনে হয়েছে স্বয়ং চিত্রকল্পটিও বুঝি জীবন্ত ও বাস্তব। এ বইয়ের নাম দেখে আবারো সেই অনুভূতি জাগ্রত হলো। এই বোধ থেকে প্রথম দর্শনে বইয়ের নামটিকে যেমন প্রতীকি ও বিষয় প্রকাশে শিল্পের দায় মেটানো শব্দ-সৌন্দর্য মনে হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত আর এরকমটি মনে হয়নি। মনে হয়েছে শিল্প নয়; এ নাম জীবন্ত এক বাস্তবতাকে প্রকাশ করেছে এবং বইয়ের নাম হিসেবে পেয়েছে চমৎকার স্বার্থকতা। বইটি লিখেছেন মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন।

মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন নিজের ভিতরে একইসাথে অনেকগুলো পরিচয়কে ধারণ করেন গভীরভাবে। আলেম, মুহাদ্দিস, আদর্শ শিক্ষক, শিক্ষাবীদ, চিন্তক, গবেষক, আলোচক, সাহিত্যিক, লেখক এমনতরো আরো অনেক কিছু। এসবের ভিতরে বিশেষ একটি দিক হলো তিনি অক্লান্ত এক পাঠক। সমস্ত কাজের ভীড়ে তার অনুসন্ধানী পাঠ সবসময় আপন গতিতে বহমান এবং সে পাঠ বহুগামী ও বিচিত্র। আল্লাহ প্রদত্ত স্বভাবশক্তি, নিরন্তর জ্ঞান সাধনা, উপলব্ধির গভীরতা, অনুসন্ধানী পাঠ, অষ্টপ্রহর চিন্তার সক্রিয়তা, পরিমিতিবোধ, হৃদয়ের সংবেদনশীলতা, আত্মার নিষ্কলুষতা, উম্মাহর দরদ, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি সীমাহীন ভালবাসা, আকাবির ও আসলাফের প্রতি ভক্তির প্রাবল্য সব মিলিয়ে তার ভিতরে অসম্ভব সুন্দর ও সমৃদ্ধ যে মনীষার জন্ম দিয়েছে, তার সমস্ত লেখাজোকায় আমরা তারই স্ফুরন ও প্লাবন দেখে উঠি সবসময়। মনীষার এ বিচিত্র রং থেকেই তাঁর হাত থেকে একদিকে যেমন আমরা পেয়েছি বক্তৃতার ক্লাস, সাহিত্যের ক্লাস, শব্দের সৌরভ শব্দের সানাই, লেখালেখির শিকড় শিখর ইত্যাদির মতো সুন্দর সাহিত্যনির্দেশক বই; পেয়েছি নারীর শত্রু মিত্র, ইসলামে জীবিকার নিরাপত্তা, মানুষ হত্যার দলীল এর মতো গবেষেণাধর্মী রচনা; তেমনি রচনা করেছেন ভয় স্বপ্ন সংগ্রাম, সাহসের গল্প, বড় যদি হতে চাও ইত্যাদির মতো চেতনা ও উদ্দীপনা জাগানিয়া গ্রন্থ। হাত খুলে লিখেছেন ঈমান ইসলাম কুরআন হাদীস সীরাত জীবন সমাজ দেশ আদর্শ মানুষ ইত্যকার বহু বিচিত্র বিষয়ে। লেখালেখি তার স্বভাব ও আত্মার অংশ, এর সাথে গিয়ে যুক্ত হয়েছে একজন আলেম হিসেবে দীনি দায়বোধ। এই দুইদিক থেকে সৃষ্টি হওয়া লেখক চেতনা ও দীনি প্রেরণাকে তিনি বড় নিবিড়ভাবে ধারণ করেছেন তার জীবনে, চিন্তায় ও কর্মে। ফলে তার লেখায় একদিকে যেমন আমরা পাই সাহিত্যের সুন্দর সুবাস, চিন্তার শেকড়সন্ধানী প্রবণতা, আদর্শিক চেতনা ও লক্ষভেদী বিশ্লেষণের ঐশ্বর্য, অপরদিকে দেখি তার ভাষা সহজ, সুবোধ্য ও পরিমিত। বক্তব্য ও বিষয় নির্মাণে তিনি সবসময় চেয়েছেন পণ্ডিত মহলের পাশাপাশি তা গণমানুষকেও  স্পর্শ করুক সমানভাবে। এমন একজন যাইনুল আবিদীন যখন ইমাম আবু হানীফা রহ. কে নিয়ে কথা বলতে বসেন, তখন নড়েচড়ে না বসে উপায় নেই।

আকাশে অঙ্কিত নাম বইটির কলেবর খুব বেশি নয়। সাকুল্যে ২০৮ পৃষ্ঠা। এটুকু লেখতে গিয়ে তাকে মন্থন করতে হয়েছে কুরআন ও হাদীসসহ নতুন পুরনো অসংখ্য বইয়ের উঠোন। সেগুলো থেকে নির্বাচিত তথ্য ও বিশ্লেষণগুলো উঠিয়ে এনেছেন অত্যন্ত যত্নের সাথে, সুন্দর বিশ্লেষণ ও যথোচিত পর্যবেক্ষণসহ। গ্রন্থপঞ্জি ও প্রতি পৃষ্ঠায় রেফারেন্সের আধিক্য দেখলেই বিষয়টি সহজে নজরে পড়ে। আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে বইয়ের চরিত্রটি। এখানে ইমাম আবু হানীফার জীবনী পাওয়া যায়; কিন্তু লেখক শুধু জীবনটাই বলতে বসেননি। জীবনী, তথ্য, মনীষীদের মন্তব্য আলোচনা বিশ্লেষণ ও ইতিহাসের সত্যভাষণের ভিতর দিয়ে তিনি মূলত বিশেষ একটি বিষয়কে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন পাঠকের সামনে। সেই শুরুর সময় থেকেই মহান এই ইমাম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সুউচ্চ আসনে সমাসীন ছিলেন পৃথিবীর সর্বত্র, পণ্ডিত থেকে নিয়ে গণমানুষের হৃদয়জমিনে; কিন্তু তার বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার ও প্রোপাগাণ্ডাও থেমে থাকেনি। কেউ না জেনে ভুল বুঝে, কেউ সমকালীনতায় আক্রান্ত হয়ে, কেউ বা চিন্তা ও রুচিগত দূরত্বের কারণে। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে কারো কারো ভুল ভেঙ্গেছে। কেউ থেকে গেছেন আপন জায়গাতেই। এই অপপ্রচারে জোরালো হাওয়া দিয়েছে অধুনা সৃষ্ট লা মাযহাবী মতবাদের অপরিণামদর্শী লোকদের অবিবেচনাপ্রসুত কর্মকাণ্ড ও মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা। তার ব্যাপারে কথা ছড়ানো  হয়েছে তিনি হাদীস জানতেন না, কিয়াস দিয়ে হাদীসের বিরোধিতা করতেন, হাদীস বিষয়ে তার লিখিত কোন গ্রন্থ নেই, অমুক তমুক বড় মানুষেরা তার বিরুদ্ধে বলে গেছেন ইত্যাদি নানা কিছু। পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে—অবচেতনে অনেকেই ধরে নিয়েছেন—‘আবু হানীফা অনেক বড় ব্যক্তিত্ব সন্দেহ নেই, অনেক মেধাবী ও জ্ঞানী মানুষ, আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গ ব্যক্তিও; তবে হাদীস বিষয়ে তিনি আসলেই দুর্বল ছিলেন। ফলে তার অনেক মাসআলাই ভুল ও পরিত্যাজ্য।’ কিন্তু সত্য কী? ইতিহাস ও বাস্তবতা আমাদেরকে কী জানান দেয়? লা মাযহাবীদের এই অপপ্রচারের  উৎস কোথায়? কেন তাদের ছড়ানো এইসব আলোচনা কেবলই প্রোপাগাণ্ডা ও ইতিহাসের বিকৃতি—এই ব্যাপারগুলো তিনি স্পষ্ট করতে চেয়েছেন এ বইতে। এবং তা করতে গিয়ে লেখক নিজে কথা বলেছেন কম। এর পরিবর্তে কথক ও সাক্ষী হিসেবে হাজির করেছেন বিপুল মনীষীকে, স্বয়ং ইতিহাসকে, আবু হানীফার রহ. এর জীবন ও কর্মকে। এবং বইটি পাঠ করা শেষ হলে নির্মোহ পাঠকমাত্রই প্রশান্ত চিত্তে মাথা নাড়াবেন—হ্যাঁ, আমি সত্যকে লাভ করতে পেরেছি।’ টের পাবেন মহান এই ইমামের প্রতি শ্রদ্ধায় ভক্তিতে তার হৃদয় উপচে উঠেছে। পাঠ শেষে আমার অনুভূতিও এই—লেখক যা বলতে চেয়েছিলেন, সে কাজে তিনি দারুণভাবে সফল হয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা রহ.কে নিয়ে বাংলা ভাষায় মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে; কিন্তু বিশেষ এই দিকটি সামনে নিয়ে বিপুল তথ্যের সমাহার ঘটিয়ে সুখদ রচনায় তৈরী হওয়া বই সম্ভবত এই প্রথম।

বইয়ের শুরুতে প্রকাশকের কথা, লেখকের ভূমিকা, একজন পাঠকের অনুভূতি এরপর সূচিপত্র এবং তারপরই মূল বইয়ের সূচনা। পুরো বইটি তিনি সাজিয়েছেন মোট ১০টি অধ্যায়ে। প্রথম অধ্যায়ে লেখক ইমাম আবু হানীফা রহ.কে নিয়ে প্রোপাগাণ্ডার মূল উৎসটিতে হাত দিয়েছেন এবং বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কেন তাদের এই দর্শনটি বিভ্রান্তিমূলক ও শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক। আলোচনা করেছেন শয়তান কীভাবে মানুষকে সরলপথের নামে ধোঁকা দিয়ে ভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়; আবু হানীফা রহ. এর বিরুদ্ধে যারা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ায় তারা কারা, নামে ভিন্ন হলেও তারা সবাই মিলে কেন এক ও অভিন্ন, তাদের বৈশিষ্ট কী। শুনিয়েছেন অসাধারণ রসালো একটি গল্পও, যা এতো চমৎকারভাবে বিষয়ের সাথে ম্যাচ করেছে! গল্পটি মাথায় রাখলে আবু হানীফা রহ. এর বিরুদ্ধে পরিচালিত পুরো প্রোপাগাণ্ডা প্রকল্পটির পিনপয়েন্ট ধরে ফেলা যাবে অনায়াসে। এভাবে লেখক প্রথম অধ্যায়েই মূল আলোচনার পরিবেশ তৈরী করে ফেলেছেন এবং সেই সাথে জাগ্রত করতে পেরেছেন পাঠকের ভিতরে একটি বিপুল পিপাসা।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন ইমাম আবু হানীফা রহ. এর জন্ম ও তার জন্মের শহর কূফা নিয়ে বিস্তারিতভাবে। এ অধ্যায়টি বিস্ময়কর এবং অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম আবু হানীফা রহ. এর চিন্তা দর্শন ফিকহ ও ব্যক্তিত্বকে বুঝার জন্য কূফা নগরীর এই ঐতিহাসিক অবস্থানটি ভালোভাবে জেনে রাখার বিকল্প নেই। পাঠক তখন সহজেই বুঝতে পারবেন ইমাম আবু হানীফা রহ. কী কারণে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ইমাম হয়ে উঠেছেন এবং এটাও বুঝতে পারবেন যে, তা না হয়ে তার আসলে উপায় ছিল না। সমকালীন ইসলামমনা আধুনিক মানসের যে জ্ঞানভাবনা, শরীয়তের বিধানাবলীকে যে থট প্রসেস ও একাডেমিক মেথড থেকে ভাবেন ও সে থেকে নানান সিদ্ধান্ত তৈরী করেন, কূফার এই অবস্থান ও সেখানে ইমাম আবু হানীফা রহ. এর উপস্থিতির ধরণ জানতে না পারলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্যই। আমি নিশ্চিত এখানের আলোচনাটি এমন চিন্তার মানুষকে আবু হানীফা ও ফিকহে হানাফি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।

তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন তার শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে। পঞ্চম অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন তাঁর হাদীসগ্রন্থ কিতাবুল আসার নিয়ে এবং বিস্তারিতভাবে অপনোদন করেছেন ফকীগণের হাদীস রচনা নিয়ে একটি ভুল ধারণার। ষষ্ঠ অধ্যায়ে দেখিয়েছেন তার জীবনছবি, তাঁর ইবাদাতের আধিক্য ও নিষ্ঠতা, এঁকেছেন অনুপম চরিত্র মাধুরীর জীবন্ত দৃশ্যাবলী। সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়টি রচিত হয়েছে তাঁর সমকালীন ও হাদীসের সম্রাটদের চোখে ইমামে আজম রহ. এর মূল্যায়ন, উচ্চ প্রশংসা, বিশ্লেষণ ও অবাক করা ঘটনাবলী নিয়ে।

এই আটটি অধ্যায় আলোচনা শেষে ইতিমধ্যে তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য, সত্য ও বিশ্লেষণ হাজির করে ফেলেছেন পাঠকের সামনে। এবার ফসল তোলবার পালা। তাই নবম ও দশম অধ্যায়ে তিনি পুরো আলোচনার উপসংহার টেনেছেন অনেকগুলো উপশিরোনামের অধীনে। সেই সাথে দেখিয়েছেন ফিকহে হানাফি কী, এর উৎস কোথায়, এর অনন্য বৈশিষ্টগুলো কী কী? এবং এসব আলোচনায়ও লেখক যথারীতি হাজির করেছেন ইতিহাস ও ঐতিহাসিক মনীষীদেরকে। এ বই পাঠ শেষে যে অপরীসীম তৃপ্তিতে বুক ভরে যায়, এ অভুতপূর্ব ও অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা।

লেখকের ভাষার সরলতা, সহজতা ও সরসতার কথাটি আগেই বলেছি। এ বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে, এটি একদিকে যেমন গবেষণাধর্মী, জ্ঞানমূলক, তাত্ত্বিক, অপরদিকে শব্দ চয়ন বাক্য গঠন ও উপস্থাপনায় সরস  সতেজ ও গতিশীল। ফলে এটি সব শ্রেণির পাঠককে আকর্ষণ করবে সমাভাবে, করবে উদ্দীপ্ত ও আলোকময়।

এটি নিছক পড়ার মতো ভালো একটি বই নয় শুধু; বিশেষত সমকালীন প্রেক্ষাপটে এ বই সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য—যারা ইমাম আজমকে ভালোবাসেন তাদের জন্যও, যারা শত্রু ভাবেন তাদের জন্যও। কারণ এখানে যা আছে তা সত্য এবং সত্যের সাথে সত্যনিষ্ঠ কোন মানুষের বিরোধ থাকতে পারে না।

পাশাপাশি এখানে আরো একটি ব্যাপার রয়েছে। সেই ছোট থেকে বড় হয়েছি, এর ভিতরে কখনো মনে হয়নি আবু হানীফা দূরবর্তী ঐতিহাসিক এক চরিত্র কেবল; বরং সবসময় মনে হয়েছে তিনি আমাদের ঘরেরই একজন মানুষ। সঙ্গত কারণেই ধারণা করি আমার মতো এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সকল মানুষ ও সবগুলো পরিবারের ক্ষেত্রেই সত্য। ইমাম আবু হানীফা এমনই একজন বিস্তৃত মানুষ। দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের পরিবার ও সমাজ কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে। এমনকি ইসলাম ও ইসলামি ফিকহের সূত্রে তিনি বিদ্যমান আছেন রাষ্ট্রিয় নানান আইন ও সিদ্ধান্তের পরিসরেও। আমাদের জন্য কুরআন ও হাদীসের গণভাষ্যকার তিনি। তাঁর সম্পর্কে সঠিক উৎস থেকে জানা, তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করা, এবং সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এজেন্ডা আকারে তার মর্যাদাহানির যে নব্য মিশন বর্তমানে আমাদের দেশে চলমান, সে সম্পর্কে সজাগ থাকা আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এমনকি সামাজিক শৃঙ্ক্ষলা ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য একান্ত জরুরী কাজ। সে জায়গা থেকে এ বই সব ঘরে, সবগুলো পাঠাগার ও শিক্ষায়তনে হাজির থাকা আমি মনে করি অত্যাবশ্যক। এমন সুন্দর ও দরকারী একটি বই রচনা করে লেখক নিঃসন্দেহে আমাদেরকে ঋনী করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে এর উত্তম বিনিময় দান করুন। আমিন।

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ