মুফতি সিরাজুল ইসলাম হামিদী
কোরবানি একটি মহৎ ইবাদত এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি অপূর্ব উপায়। এটি মুমিনের হৃদয়ে ভালবাসার গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্যের এক বিশাল পরীক্ষা। যুগে যুগে আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁরা কখনোই আল্লাহর নির্দেশ পালনে সংকোচ বা দ্বিধা অনুভব করেননি। আজ আমি এক মহান নবীর কোরবানি সম্পর্কিত একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে সন্তান লাভের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি একদিকে সন্তান কামনা করছিলেন, অন্যদিকে আল্লাহর হুকুমে সর্বোচ্চ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। বলছি হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের কথা।
হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম দীর্ঘ সময় ধরে সন্তান লাভের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করেছিলেন। একসময় আল্লাহ তাআলা তাঁকে এক সৎকর্মশীল পুত্র, হযরত ইসমাঈল (আ.) উপহার দেন। তিনি যখন আনন্দিত, তখন আল্লাহর নির্দেশে, তাঁর কলিজার টুকরা ছেলেকে কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে যান।
কোরবানি সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে:
“এভাবে আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। এটি ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি কোরবানির বিনিময়ে তাকে (ইসমাঈল (আ.)) পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রেখেছি।” (সুরা সাফফাত : ১০০-১০৮)
এটি ছিল একজন নবীর আল্লাহর প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ও আনুগত্যের নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা এই মহত্বপূর্ণ কোরবানিকে এতটাই পছন্দ করেছেন যে, এটি কেয়ামত পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মদির জন্য একটি আবশ্যকীয় বিধান হিসেবে পরিণত করেছেন।
কোরবানি এবং তার ফজিলত:
কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত ব্যাপক। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “কোরবানি করাটা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ। কেয়ামতের দিন কোরবানির পশুর শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে। কোরবানি দেওয়ার পর, তার রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলার কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়ে যায়।” (জামে তিরমিজি: ১৪৯৩)
কোরবানি করার সওয়াবের অফুরন্ত ফল:
কোরবানির সওয়াবের কোনো শেষ নেই। প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটী করে নেকি রয়েছে। সাহাবী হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন:
“কোরবানি করা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। কোরবানি করার প্রতিটি পশমের জন্য একটি নেকি রয়েছে। এবং পশমওয়ালা পশুর প্রতি পশমের বিনিময়ে একটী করে সওয়াব রয়েছে।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৭)
গুনাহ মাফ হওয়ার প্রমাণ:
কোরবানি গুনাহ মাফের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সাহাবী আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন:
“হে ফাতেমা! তুমি তোমার কোরবানির জন্তুর কাছে যাও। কারণ, কোরবানির পশু জবাই করার পর তার রক্ত মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই তোমার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।” (মুসতাদরাকে হাকেম: ৭৫২৪)
এটি প্রমাণিত হয় যে, কোরবানি শুধুমাত্র পশু জবাই করা নয়, এটি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য:
তবে, কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পশু জবাই করা নয়। কোরবানির মধ্যে থাকতে হয় ঈমান, তাকওয়া, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শুদ্ধতা এবং আন্তরিকতা। আল্লাহ তাআলা কেবল কোরবানির পশুর রক্ত-মাংশ গ্রহণ করেন না, বরং কোরবানি দাতার অন্তরের তাকওয়াকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাকওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে কোরবানি করার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ
এমএইচ/