|| মুফতি আবু বকর সিদ্দিক হাবিবী ||
শরীয়তের সকল ইবাদত চারটি মূলসূত্রের উপর ভিত্তি করে সাব্যস্ত হয়: কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াস। যেসব ইবাদত এই চারটি সূত্রের মাধ্যমে প্রমাণিত, সেগুলোই শরীয়তে ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। তবে, যেসব ইবাদত এই চারটির মধ্যে কোন একটি দ্বারা প্রমাণিত নয়, সেগুলোকে শরীয়ত অনুযায়ী ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।
সম্প্রতি, আমরা লক্ষ্য করেছি যে, রমজানের রোজা, ঈদ, আরাফার রোজা এবং কোরবানিসহ চন্দ্র তারিখ নির্ভর ইবাদতগুলোতে বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলের মুসলিমরা সৌদি আরব বা বিশ্বের অন্য কোন অঞ্চলের চাঁদকে অনুসরণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করছেন।
কিছু লোক মনে করেন, সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে রোজা ও ঈদ পালন করতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেন, চাঁদ দেখার প্রয়োজন নেই, বরং লুনার ক্যালেন্ডার বা হিজরী ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে রোজা ঈদ পালন করা উচিত। অন্যদিকে, কিছু মানুষ মনে করেন, পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলেই, সেই অঞ্চলের সংবাদ অনুযায়ী পৃথিবীর সকল মুসলমানকে রোজা বা ঈদ পালন করতে হবে।
তবে, তাদের মধ্যে এই বিষয়ে বৈপরীত্যও দেখা যায়। তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো, সৌদি আরবের চাঁদ বা পৃথিবীর অন্য কোন অঞ্চলের চাঁদ বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য অনুসরণীয় কি না, এবং এটি শরীয়ত সম্মত কি না। এই বিষয়ে আমি কুরআন, সুন্নাহ এবং বিজ্ঞানের আলোকে একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করতে চাই।
আল্লাহ তাআলা চাঁদ এবং সূর্যকে আমাদের সময় নির্ধারণের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যাতে আমরা ইবাদত এবং অন্যান্য কাজ সঠিকভাবে সময়ে করতে পারি। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجَّ
অর্থাৎ, "মুসলিমরা আপনাকে চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, বলুন, এটি মানুষের জন্য এবং হজ্জের সময় নির্ধারণের উপায়।" (সূরা আল-বাকারাহ ২:১৮৯)
কিছু ইবাদত সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেমন নামাজ, যাকাত ইত্যাদি, এবং কিছু ইবাদত চাঁদের সাথে সম্পর্কিত, যেমন রোজা, ঈদ, হজ্জ, কোরবানি ইত্যাদি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ فَإِنْ غُبْيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلَاثِينَ
অর্থাৎ, "তোমরা চাঁদ দেখে রোজা শুরু করবে এবং চাঁদ দেখে রোজা ছেড়ো। যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে শাবান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে।" (সহীহ বুখারি, হাদীস নং ১৯০৯)
এই হাদীসে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, রোজা শুরু এবং শেষ করার জন্য চাঁদ দেখা জরুরি। তবে, চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে একই দিনে সারা বিশ্বের মুসলিমদের রোজা বা ঈদ পালন করার বাধ্যবাধকতা নেই। এটি স্পষ্ট করে যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোজা বা ঈদ পালনের কোন শরীয়তি প্রয়োজনীয়তা নেই।
অনেকে বলেন, "বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা যদি একসাথে রোজা রাখে এবং ঈদ পালন করে, তাহলে এটি সওয়াবের কাজ, এবং এটি ফরজ।" তবে, এই ধরনের মতামত কোন হাদীস বা শরীয়তের মূলসূত্রে প্রমাণিত নয়। এটি একটি নব উদ্ভাবিত ধারণা মাত্র।
এখন, চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোজা ঈদ পালনের বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়:
প্রথম বক্তব্য: দূর-দূরান্তের কোন অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অনুসরণীয়। তবে, এই ফতোয়ার ভিত্তিতে সারা বিশ্বের মুসলিমরা কখনও একমত হননি, কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন এত উন্নত ছিল না এবং পৃথিবীজুড়ে চাঁদ দেখা একই সময়ে সম্ভব ছিল না।
দ্বিতীয় বক্তব্য: কোন অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অনুসরণীয় নয়। এই ফতোয়া বেশিরভাগ সময়ই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনুসৃত হয়েছে।
সাহাবাদের কর্মপন্থা:
একটি হাদীসে হযরত কুরাইব রাহ. বলেন:
خبرني كريب ان ام فضل بنت الحارث بَعَثَهُ إِلى مُعَاوِيَةَ بِالشَّامِ فَقَالَ قَدِمْتُ الشَّامَ فَقَضَيْتُ حَاجَتَهَا وَاسْتَهَلَّ عَلَى رَمَضَانَ وَأَنَا بِالشَّامِ - فَرَأَيْتُ الْهِلَالَ لَيْلَةَ الْجُمْعَةِ - ثُمَّ قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ فِي آخِرِ الشَّهْرِ فَسَأَلَنِي عَبْدُ اللَّهِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ ثُمَّ ذَكَرَ الهِلَالَ فَقَالَ مَتى رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ؟ قُلْتُ رَأَيْنَاهُ لَيْلَةَ الْجُمْعَةِ فَقَالَ أَنْتَ رَأَيْتَهُ ؟ فَقُلْتُ نَعَمْ - وَرَاهُ النَّاسُ وَصَامُوْا وَصَامَ مُعَاوِيَةُ – فَقَالَ لَكِنَّاهُ رَأَيْنَاهُ لَيْلَةَ السَّبْتِ - فَلَا نَزَالُ نَصُوْمُ حَتَّى نُكَمِّلَ ثَلَاثِينَ أَوْ نَرَاهُ -فَقُلْتُ الَّا تَكْتَفِي بِرُؤْيَةِ مُعَاوِيَةَ وَصِيَامِهِ ؟ فَقَالَ لَا هَكَذَا أَمَرْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - ) صحيح مسلم ۲۵۲۸ - ۱۰۸۷ ابوداؤد - ۲۳۳۲)
অর্থাৎ, আমি সিরিয়াতে গিয়ে চাঁদ দেখলাম। পরে মদীনায় ফিরে এসে ইবনে আব্বাস রা. আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমরা কবে চাঁদ দেখেছ?' আমি বললাম, 'আমরা শুক্রবার রাতে চাঁদ দেখেছি।' তিনি বললেন, 'আমরা শনিবার রাতে চাঁদ দেখেছি।' এবং এরপর তিনি বললেন, 'আমরা ৩০ দিন পূর্ণ করবো অথবা চাঁদ দেখবো। (সহীহ মুসলিম ২৫২৮, আবু দাউদ ২৩৩২)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর সাথে কথা প্রসঙ্গে চাঁদের বিষয়টি আলোচনা হল। তখন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন ‘তোমরা কবে চাঁদ দেখেছ?’ হযরত কুরাইব: আমরা শুক্রবার রাত্রে চাঁদ দেখেছি। ইবনে আব্বাস রা.: তুমি নিজে কি চাঁদ দেখেছ? হযরত কুরাইব: হ্যাঁ, আমি দেখেছি এবং লোকেরা দেখেছে। লোকেরা রোজা রেখেছে। হযরত মুআবিয়া রা. রোজা রেখেছেন। ইবনে আব্বাস রা.: আমরা (মদীনাতে) শনিবার রাতে চাঁদ দেখেছি। আমরা রোজা রেখে ত্রিশ দিন পূর্ণ করব অথবা চাঁদ দেখব। হযরত কুরাইব: হযরত মুআবিয়া রা. এর চাঁদ দেখা এবং রোজা রাখা কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? ইবনে আব্বাস রা.: না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমনি নির্দেশ করেছেন।
[সহীহ মুসলিম, (১০৮৭) ২৫২৮, আবু দাউদ, ২৩৩২]
উক্ত হাদিসের দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, সাহাবাগনও দূরবর্তী ভূখণ্ডের চাঁদ অন্য অঞ্চলের জন্য অনুসরণীয় মনে করতেন না। কেননা সময়ের ব্যবধানজনিত সমস্যার কারণে এক অঞ্চলের চাঁদ অন্য অঞ্চলের জন্য অনুসরণীয় অসম্ভব।
বিজ্ঞানগত দিক থেকে: পৃথিবী গোল হওয়ার কারণে একসাথে দিন বা রাত হওয়া সম্ভব নয়। সৌদি আরবের চাঁদ যখন দেখা যায়, তখন পৃথিবীর অন্য অঞ্চলে রাত হতে পারে। তাই, সৌদি আরবের চাঁদকে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের জন্য অনুসরণ করা অসম্ভব।
অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সৌদি আরবের চাঁদ অনুসরণ করা বাস্তবিকভাবে সম্ভব নয় এবং এটি শরীয়ত সম্মতও নয়। আমাদের নিজ নিজ অঞ্চলে চাঁদ দেখে রোজা, ঈদ এবং কোরবানি পালন করা উচিত, না হলে মুসলিমরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া কোরানিয়া আরাবিয়া, লালবাগ, ঢাকা
ইমাম ও খতিব, ইসলামবাগ কেন্দ্রীয় ছাতা মসজিদ
এমএইচ/