সোমবার, ০২ জুন ২০২৫ ।। ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ৬ জিলহজ ১৪৪৬

শিরোনাম :

কোরবানির চামড়া: কওমি মাদরাসার অস্তিত্ব রক্ষার শেষ ভরসা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

 আহমাদ আবু দাউদ

বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো কওমী মাদরাসা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এসব প্রতিষ্ঠান ইসলামী জ্ঞান, আখলাক ও নৈতিকতার চর্চা করে আসছে নিরলসভাবে। কিন্তু অব্যাহতভাবে আর্থিক সংকটে থাকা এসব প্রতিষ্ঠানের একটি প্রধান অবলম্বন হলো ঈদ-উল-আযহার সময় সংগৃহীত কোরবানির পশুর চামড়া।

এক সময় এই চামড়া বিক্রির অর্থে মাদরাসা পরিচালনা, শিক্ষক বেতন, ছাত্রদের খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হতো। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই বাস্তবতা বহু দিক থেকে পরিবর্তিত হয়েছে। চামড়া সংগ্রহ ও বিক্রি আজ আর আগের মতো সহজসাধ্য নয়—বরং হয়ে উঠেছে সামাজিক অবমূল্যায়ন ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এক প্রতিচ্ছবি।

কোরবানির চামড়ায় নির্ভরশীলতা: এক ঐতিহাসিক পটভূমি

ঐতিহ্যগতভাবে কোরবানির সময় মুসলমানগণ পশু জবাইয়ের পর তার চামড়া স্থানীয় কওমী মাদরাসায় দান করতেন। এটি শুধু অর্থনৈতিক লেনদেন ছিল না; বরং আত্মিক তৃপ্তি ও ধর্মীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই বিবেচিত হতো। অনেকে তো ঈদের আগেই বলে রাখতেন—“চামড়া কিন্তু মাদরাসাতেই যাবে।” এই চর্চা দীর্ঘদিন মাদরাসার জন্য ছিলো আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

 

চামড়া বিক্রির মাধ্যমে যে অর্থ আসতো, তা দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও ভবন নির্মাণ, বিদ্যুৎ বিল, পানি সরবরাহ, ক্যান্টিন ব্যয় ইত্যাদি চালানো হতো। এই নির্ভরতা মাদরাসার খরচ কমাত এবং দান-সাহায্যের চাপ কিছুটা হলেও হ্রাস করত।

সমসাময়িক সংকট ও বাস্তবতা

১. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক পরিবর্তন

এক সময়ের সওয়াবের কাজ আজ অনেকের চোখে পরিণত হয়েছে তাচ্ছিল্যের বস্তুতে। চামড়া সংগ্রহ করতে আসা কওমী ছাত্রদের অনেক জায়গায় উপহাস ও অবমাননার শিকার হতে হয়। যা শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদায় আঘাত হানে।

২. চামড়া ব্যবসায় সিন্ডিকেটের আধিপত্য

বর্তমান চামড়া বাজার কার্যত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। তারা কৃত্রিমভাবে দাম কমিয়ে দেয়, ফলে চামড়া বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। কোনো কোনো বছর চামড়ার দাম এতটাই পড়ে যায় যে, মাদরাসাগুলো তা বিক্রি না করে ফেলে দিতে বাধ্য হয়।

৩. দাতাদের আগ্রহ হ্রাস

দানের প্রতি আস্থা কমে যাওয়ায় এবং সচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় অনেকেই এখন চামড়া মাদরাসায় না দিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে বিক্রি করে ফেলেন। অনেক দাতা মনে করেন, তারা যদি সরাসরি আর্থিকভাবে কাউকে সাহায্য করেন তবে তা বেশি কার্যকর হবে।

৪. আর্থিক দুরবস্থা ও নির্ভরতার বেড়াজাল

চামড়ার বাজারে ধস, দাতার আগ্রহ কমে যাওয়া এবং বিকল্প আয়ের পথ না থাকায় মাদরাসাগুলো অর্থনৈতিকভাবে প্রায় অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। শিক্ষক বেতন অনিয়মিত, আবাসিক ছাত্রদের খাবারের মান নিম্নমুখী, কখনো কখনো পাঠদান ব্যাহত—এসব এখন বেশিরভাগ কওমী মাদরাসার বাস্তবতা।

উপকারিতা: যা এখনও রয়ে গেছে

চামড়া সংগ্রহ ব্যবস্থা একদম অকার্যকর হয়ে পড়েনি। এখনও অনেক মাদরাসা ঈদের সময় কিছু অর্থ পায়, যা অন্তত কয়েক মাসের খরচ মেটাতে সহায়তা করে। দান ও সমাজসেবার মানসিকতা অনেক জায়গাতেই এখনও দৃশ্যমান। তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এই পদ্ধতি টেকসই কি না?

সম্ভাব্য উত্তরণ ও সমাধানের পথ

১. অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (SME) গড়ে তোলা যেমন: কৃষিকাজ, হস্তশিল্প, খামার।

মাদরাসার নিজস্ব ব্র্যান্ডের বই, খাদ্যপণ্য বা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম চালু করা।

কারিগরি শিক্ষা দিয়ে টিউশন ফি আদায়ের ব্যবস্থা।

২. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ

দানের টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা।

অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু করে নগদ, বিকাশ, রকেটের মাধ্যমে দান নেওয়া।

দাতাদের জন্য বার্ষিক প্রতিবেদন ও ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রকাশ।

৩. মিডিয়ায় সচেতনতামূলক প্রচার

সামাজিক মাধ্যমে ইতিবাচক গল্প ও কওমী শিক্ষার্থীদের অবদান তুলে ধরা।

মাদরাসা ও ইসলামি শিক্ষার প্রতি সমাজের সম্মান ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ।

৪. সরকারের ভূমিকা

কোরবানির চামড়া বাজারে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ।

কওমী মাদরাসা নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করা ও সুনির্দিষ্ট সহায়তা প্যাকেজ চালু করা।

বিশেষ তহবিল গঠন করে অস্বচ্ছল মাদরাসাকে সহায়তা দেওয়া।

বাংলাদেশের কওমী মাদরাসা শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি জাতির নৈতিক ভিত্তি নির্মাণের কারখানা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক দুরবস্থা ও সামাজিক অবমূল্যায়নের মধ্যে দিয়েও জাতিকে দ্বীনি শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। কিন্তু কেবল চামড়ার মতো অনির্ভরযোগ্য একটি উৎসের উপর নির্ভর করে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকা সম্ভব নয়।

মাদরাসাগুলোর উচিত বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, দান সংগ্রহে স্বচ্ছতা আনা, আর সমাজের উচিত এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মানের চোখে দেখা। সরকার, সমাজ ও মাদরাসা কর্তৃপক্ষ—এই তিন পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে একটি আত্মনির্ভর, মর্যাদাসম্পন্ন কওমী শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে।

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ