|| মোহাম্মাদ হুজাইফা ||
বর্তমান পৃথিবী বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দক্ষতানির্ভর হয়ে ওঠছে। এই উন্নতির সময়ে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক জীবনে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে প্রয়োজন আধুনিক ও বাস্তবমুখী শিক্ষার সংমিশ্রণ। এজন্য মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরুরি ভিত্তিতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। না হলে তারা প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়বে।
একজন মানুষ মাদরাসায় পড়ে কুরআন, হাদিস, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করতে পারে। নীতি ও আদর্শে নিজেকে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে নিতে পারে। সমাজে ধর্মীয় কাজে মজবুত ভূমিকা রাখার সক্ষমতা অর্জন করে। তবে শুধু ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিক এই পৃথিবীতে কর্মসংস্থান কিছুটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মাওলানা লিয়াকত আলী আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি শিক্ষা বর্তমান যুগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কর্মজীবনে সফলতার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীদের উস্তাদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া উচিত।’
এ বিষয়ে বিশিষ্ট আলেম, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মাওলানা রুহুল আমীন সাদী (সাইমুম সাদী) বলেন, ‘সমসাময়িক যুগে দীন প্রতিষ্ঠা ও ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমকে আরও কার্যকর ও আধুনিক করতে হলে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে তোলা জরুরি।’
মাওলানা সাদী বলেন, ‘মাদরাসার ছাত্ররা অত্যন্ত পরিশ্রমী ও আন্তরিক। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো, তারা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় অধিক পরিশ্রম করেন। এই পরিশ্রমী ছাত্রদের হাতে যদি কারিগরি শিক্ষা তুলে দেওয়া যায়, তাহলে তারা এই ময়দানে আশাতীত সফলতা অর্জন করবেন।’
তিনি জানান, বিশ্বের প্রতিটি দেশে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। সার্টিফিকেট থাকাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রকৃত দক্ষতাই কর্মজীবনে সফলতার মূল চাবিকাঠি। ‘প্রতিটি থানায় একটি করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারলে, সেখান থেকে আশপাশের মাদরাসার ছাত্ররা প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের ক্যারিয়ার গঠনে অগ্রসর হতে পারবে,’— বলেন তিনি।
রুহুল আমীন সাদী মনে করেন, কওমি মাদরাসার শিক্ষা ধারার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা খুব সহজেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভাষাগত শিক্ষা যেমন আরবি, বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং ও কোডিং শিখিয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আধুনিক দক্ষতায় পারদর্শী করে তোলা সম্ভব।
তার মতে, ‘আধুনিক বিশ্বে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও কোডিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বুয়েটের শিক্ষকরা যেসব কোডিং কোর্স চার বছরে শেষ করেন, একজন আগ্রহী শিক্ষার্থী মনোযোগ দিয়ে চাইলে এক বছরেই তা আয়ত্ত করতে পারেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মাদরাসার ছাত্ররাও এই সক্ষমতা রাখেন।’
তিনি কওমি শিক্ষা বোর্ডগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বেফাক ও হাইয়াতুল উলিয়ার মুরব্বিরা যদি এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাহলে এটি সহজেই বাস্তবায়ন সম্ভব। বহু বছর ধরেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও এখনো এই বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি, যা দুঃখজনক।’
মাওলানা সাদী বলেন, ‘বর্তমান সময়ে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে বড় পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। তা না হলে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সমাজের মূলধারার পেশাজীবী ও প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় পিছিয়ে পড়বে।’
কারিগরি শিক্ষা শুরু করার উপযুক্ত সময় প্রসঙ্গে মাওলানা লিয়াকত আলী বলেন, শরহে বেকায়া জামাত সম্পন্ন করার পর থেকেই ছাত্ররা কারিগরি শিক্ষার দিকে অগ্রসর হতে পারে। এ সময় থেকে তারা মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি গড়ে তুলে বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য দক্ষতা অর্জনে মনোযোগ দিতে পারে।
তবে এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন মাওলানা রুহুল আমীন সাদী। তিনি বলেন, কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত মজবুত। এর মাঝপথে অন্য কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করলে মূলধারার ইলমে ঘাটতি আসতে পারে। তাই তার মতে, দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করার পরই কারিগরি শিক্ষার পথে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।
এমএইচ/