রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩২ ।। ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
যেসব দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে  ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলো যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া জাগো হে কওমি তারুণ‍্য! রাতেই ঢাকাসহ তিন অঞ্চলে ঝড়ের আভাস অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হতে হবে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি: বাণিজ্য উপদেষ্টা চবির আরবি বিভাগের নতুন সভাপতি অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন তালুকদার ডেঙ্গুতে একদিনে ১২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৭৪০ সিরাতকে ধারণের মাধ্যমেই সত্যিকার পরিবর্তন সম্ভব: ধর্ম উপদেষ্টা সিরাতুন্নবী (সা.) সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতার লাইভ ড্র অনুষ্ঠান ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট

ইরাকযুদ্ধের পনেরো বছর; কিছু শিক্ষা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

[লেখক- বিশিষ্ট পদার্থবিদ, ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতি ও নিরাপত্তা-বিষয়ক সব্বোর্চ্চ কর্মকর্তা জাভির সোলানা]

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে হয়ে যাওয়া অশুভ ঘটনাবলীর একটি ইরাকযুদ্ধ, যার ১৫ বছর গত হলো। ৯/১১ এর পরে ‘আমরা সবাই আমেরিকান’ শিরোনামে ফ্রান্সের লুমেন পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এমনকি রাশিয়া পর্যন্ত আমেরিকার মিত্র হওয়ার আশা করেছিলো।

কিন্তু ২০০৩ সালে জুনিয়র বুশ কর্তৃক ইরাকের সাথে যুদ্ধের পর সকল সমীকরণ মৌলিকভাবে পাল্টে যায়। আমরা জানি মধ্যপ্রাচ্যকে ছিন্নভিন্নকারী এই যুদ্ধ ছিল শীতল যুদ্ধের পরে আমেরিকান প্রভাব-প্রতিপত্তি সমাপ্তির সূচনা।

যদিও ইরাক যুদ্ধটা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অধীনেই হয়েছে, কিন্তু এ যুদ্ধের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ৯/১১ এর পূর্বেই। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে ‘নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’ রুপকল্পের জন্য নব্য রক্ষণশীলরা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণের আহ্বান জানায়।

২০০২ সালে বুশ ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই ঘোষণা দেয়, ইরাক হলো তার নিরাপত্তা বিষয়ক অগ্রাধিকারমূলক অন্যতম ইস্যূ। এটা হঠাৎ করেই হয়নি, ‘নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’ প্রতিষ্ঠা-ডকুমেন্টে স্বাক্ষরকারী ২৫ জন ব্যক্তি আমেরিকান বুশপ্রশাসনের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে যাদের মধ্যে ছিল তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল রামফিল্ডস।

কোনো ধরনের অকাট্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই বুশ প্রশাসন ইরাকের ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের কথিত দাবিতে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। ২০০২ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল রামফিল্ডসের কাছে একটি প্রতিবেদন আসে, যেখানে ইরাকের ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রপ্রকল্পের বিষয়ে একটি ভয়ানক তথ্য আসে, ‘ আমরা কতটুকু জানিনা তাও আমাদের জানা নেই।’

কিন্তু এটা কোনো পরিবর্তন আনেনি। আমেরিকা যদি আরো সতর্কতা ও সূক্ষ্মতার সাথে আচরণ করতো, তবে মধ্যপ্রাচ্য অনেক দুঃখ-দূর্দশা থেকে দূরে বাঁচতে পারতো। যেমনটি জাতিসংঘের মনিটরিং টিমের প্রধান হেন্স বিলিক্স বলেছিলেন।

২০০৩ সালে আমেরিকান রণতরী আব্রাহাম লিংকন থেকে বুশ ঘোষণা দেন, ‘সব কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই কাজের লক্ষ্য হলো, ইরাককে সন্ত্রাসমুক্ত করা, পূণঃনির্মাণ করা এবং সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’

কিন্তু এটা তো স্পষ্ট, এই কাজ ব্যর্থ হয়েছে। অধিকাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধারণা করে, ইরাক যুদ্ধের কারণে অনেক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৩ সালে ইরাকযুদ্ধ সমর্থনকারী আমেরিকান উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবিদ এখন বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।

তাছাড়া ২০০৩ সালের যুদ্ধ-রাজনীতি ছিল পুরোটাই সত্য বিবর্জিত। ইরাক ও তদসংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া বিশৃঙ্খলার কারণ ছিল সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণের পর আমেরিকার নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত; সাদ্দামপ্রশাসনে থাকা সকল ব্যক্তিদের শেষ করে দেওয়ার জন্য বুশ প্রশাসনের বাথ পার্টিনির্মূল-রাজনীতি।

যেখানে ইরাক একটি শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আর সাদ্দামপ্রশাসনে ছিল সুন্নীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি। ইরাক অভিযানের পরে ইরাক পূণঃনির্মাণ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার কারণেই তাদের অনেকেই কট্টোরপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বাথ পার্টি নির্মূলঅভিযানের কারণে ইরাকি সেনাবাহিনী ভেঙ্গে পড়ে।

হাজার হাজার সৈন্য ও অফিসার তাদের জীবন-জীবিকা ও পদ হারা হয়, যা তাদের অনেককে আইএসের পূর্বসূরী আলকায়েদার নেতৃত্বাধীন সুন্নি-সালাফিদের দিকে ঠেলে দেয়। এই বিদ্রোহীরা কেবলমাত্র ইরাকি দখলদারিত্বের বিরোধিতা করেনি; বরং তারা এর বেনিফিস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদেরও বিরোধিতা করেছে।

আমেরিকার রাজনীতিবিদদের ভুলের আরোও এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, আমেরিকার পরিচালনাধীন ইরাকি আটক কেন্দ্রগুলো। যেখানে তাদের আচরণ ছিল খুবই বাজে, বাথপার্টির নেতৃবর্গদের ক্যালবুকা ক্যাম্পে আটক করা এবং তারা সেখানে সালাফিদের সংস্পর্শে আসে।

যেখানে ইরাকের এসব সামরিক কর্মকর্তার লব্ধ সামরিক জ্ঞান সালাফিদের মতাদর্শের সাথে মিলিত হয়। আইএস যখন ২০১৪ সালে খেলাফতের ঘোষণা দেয়, তখন তাদের নেতা আবু বকর বাগদাদিসহ এ দলের ২৫ জনের ১৭ জনই কোনো না কোনো সময় ২০০৪ থেকে ২০১১ এর মধ্যে ইরাকে আমেরিকার আটক কেন্দ্রগুলোতে সময় কাটিয়েছে।

একই সময় শিয়া নেতৃত্বাধীন ইরাকের সরকারের সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপক গোলযোগ সৃষ্টি করে। ২০১০ সালে ইয়াদ আলাভির নেতৃত্বাধীন সর্বাধিক মধ্যপন্থী দল থেকে কম আসন পেয়েও নূরি আল মালিকি ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী পূণঃনির্বাচিত হন।

বারাক ওবামার প্রশাসন ইয়াদ আলাদির সরকার গঠনে সহযোগিতা করতে পারতো, কিন্তু তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়,যেটা ইরানের প্রিয়ভাজন নূরি আল মালিকিকে সরকারে থেকে যেতে সহযোগিতা করেছে। আর মালিকির রাজনীতি সালাফিদের সামনে অগ্রসর হয়ে যাওয়ার সহযোগিতা করেছে।

ইয়াদ আলাভির সরকারকে সমর্থন না জানানো এবং ২০১১ সালের শেষ দিকে ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার, এটা ইরাকের জিহাদিদের পাশ্ববর্তী সিরিয়াতে ঔদ্ধত্যতা প্রকাশের পথকে সুগম করে দিয়েছে। মাত্র ৩ বছরের মধ্যে আমেরিকা ইরাকে ফিরে আসতে বাধ্য হয় এবং সিরিয়াতেও হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।

এখন দীর্ঘ ও জটিল অপারেশনের পরে আইএস যদিও সিরিয়ায় ইরাকে তাদের অধিকাংশ ভূমি হারিয়েছে, কিন্তু গত ১০ বছর এটা প্রকাশ করেছে, পরিস্থিতির প্রতি আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। কারণ আইএস তার ভূমি হারালেও তাদের আদর্শকে পরাজিত করা যায়নি।

আমরা আশা করি, মে মাসে ইরাকে হতে যাওয়া সাধারণ নির্বাচন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আইন প্রয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি সরকার গঠন হবে, যারা দেশের সকল প্রতিষ্ঠান রক্ষা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষায় কাজ করবে।

অধিকন্তু আগামী সরকারের কাজ হবে- ইরাকের কুর্দীদের যৌক্তিক স্বাধীনতা দেওয়া এবং মূলধারার রাজনীতিতে তাদের নিয়ে আসার জন্য কোনো পথ খুঁজে বের করা।

আর বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্র গত ১৫ বছরে যে পাঠ গ্রহণ করেছে তার উল্লেখযোগ্য হলো- প্রশাসন পরিবর্তনের জন্য যেকোন ধরণের সামরিক হস্তক্ষেপ অধিকাংশ সময়ে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে।

বিশেষত যদি সামরিক হস্তক্ষেপের পরে যৌক্তিক কোন পরিকল্পনা না থাকে, ইরাকযুদ্ধ আরোও প্রকাশ করেছে- কূটনৈতিক চ্যানেল পরিত্যাগ করার মূল্য অনেক উঁচু হয়ে থাকে। আমরা আশা করবো, ডোনাল ট্রাম্পের প্রশাসন বিশেষভাবে আগামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক বোম্বে এই পাঠ হতে শিক্ষাগ্রহণ করবে। বিশেষত ইরানের সাথে যখন উত্তেজনা বেড়ে চলেছে, তাছাড়া এ অঞ্চলে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তি ইরাকে আমেরিকার ভুলের কাছে অনেকটাই ঋণী।

যার সূচনা হয়েছে কূটনীতিকে পাশকাটিয়ে চলার শুরু থেকেই। ইরানের প্রতি আমেরিকার অনুরূপ কোনো কর্মপদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্যে সামনের প্রজন্ম অথবা তার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।

আল-জাজিরা আরবি থেকে মুজাহিদুল ইসলামের অনুবাদ

আরআর


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ