শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ ।। ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১০ জিলকদ ১৪৪৫


ইতিকাফ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মোহাম্মদ হাসিব উল্লাহ।।

রমাদ্বান মাস, মুসলিম জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক প্রত্যেক মুমিনের জন্য ক্ষমা, রহমত লাভ প্রভৃতির ঘোষণা করা হয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় এই মাসের শেষ দশক ‘নাজাতের দশ দিন’ হিসেবে স্বীকৃত। এই শেষ দশকে ফরজ ইবাদত ব্যতিত অন্যান্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত রয়েছে, তন্মধ্যে ইতিকাফ অন্যতম। ইতিকাফ আরবী ভাষার শব্দ। আরবি ‘আকফুন’ মূল ধাতু থেকে ইতিকাফ শব্দটি গঠিত হয়েছে। যার অর্থ: বিচ্ছিন্নতা, কোন স্থানে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা প্রভৃতি। শরীয়তের পরিভাষায়, “বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মসজিদে অবস্থান ও আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে ব্যস্ত রাখাই হচ্ছে ইতিকাফ।”

পবিত্র কুরআনেও ইতিকাফ শব্দটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যেমন আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
”وَعَهدۡنَاۤ اِلٰی اِبۡرٰهمَ وَاِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَهرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَالۡعٰکِفِیۡنَ وَالرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ،“

অর্থাৎ, আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলের নিকট অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী ও ইতিকাফকারী এবং রুকু ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রেখো।
(সূরা বাকারা: ১২৫)

এছাড়াও, আল্লাহ্ তা’য়ালা আরো বলেন,

”وَلَا تُبَاشِرُوۡهنَّ وَاَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ ؕ تِلۡك حُدُوۡدُ اللّٰه،“

অর্থাৎ আর তোমরা স্ত্রীদের শরীর স্পর্শ করবে না, যখন তোমরা মসজিদতে ইতিকাফরত থাকো। (সূরা বাকারা: ১৮৭)

ইতিকাফের সময়সীমা:

রমাদ্বান মাসের এই ইতিকাফের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। যা হাদীসে নববী (সাঃ) কর্তৃক স্বীকৃত। যেমন,

عَنْ عَائِشَةَ (رضى الله) زَوْجِ النَّبِيِّ (صلى الله) أَنَّ النَّبِيَّ (صلى الله) كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ،

অর্থাৎ, নবিজী (সাঃ) এর সহধর্মিণী হযরত আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবিজী (সাঃ) রমাদ্বানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। (সহিহ বুখারী: ২০২৬ নং)

এছাড়া, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক ইন্তেকালের বছরে বিশ দিন রোজা রাখার ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বলেন,

كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النَّبِيِّ (صلى الله) الْقُرْآنَ كُلَّ عَامٍ مَرَّةً فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرَّتَيْنِ فِي الْعَامِ الَّذِيْ قُبِضَ فِيْهِ وَكَانَ يَعْتَكِفُ كُلَّ عَامٍ عَشْرًا فَاعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ فِي الْعَام الَّذِيْ قُبِضَ فِيْهِ،

অর্থাৎ, প্রতি বছর নবিজী (সাঃ) রমাযানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর তিনি বিশ দিন ই’তিকাফ করেন। (সহিহ বুখারী: ৪৯৯৮নং)

অর্থাৎ ইতিকাফের বিধিসম্মত সময় হচ্ছে, বিশ রমাদ্বান তারিখে সূর্যাস্ত যাওয়ার কিছু আগে থেকে শুরু করে ২৯ অথবা ৩০ রমাদ্বান তারিখে অর্থাৎ ঈদের চাঁদ আকাশে উদিত হওয়ার সময় পর্যন্ত নির্ধারিত। এজন্য ইতিকাফকারী বিশ রমাদ্বান তারিখে সূর্যাস্তের পূর্বেই মসজিদে পৌঁছাবে এবং মসজিদের কোণে অবস্থান নেবেন। ইতিকাফকারী কুরআন তেলাওয়াত থেকে শুরু করে তাসবিহ পাঠসহ যাবতীয় যিকির-আযকার পাঠ করতে পারেন।

ইতিকাফের শর্ত:

তবে ইতিকাফে পূর্ণাঙ্গরূপে মনোনিবেশ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। তন্মধ্যে রোজা রাখা, মসজিদে অবস্থান করা প্রভৃতি অন্যতম। যা একজন ইতিকাফকারীর জন্য অবশ্যই পালনীয়। যেমন,

عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّهَا قَالَتِ السُّنَّةُ عَلَى الْمُعْتَكِفِ أَنْ لاَ يَعُودَ مَرِيضًا وَلاَ يَشْهَدَ جَنَازَةً وَلاَ يَمَسَّ امْرَأَةً وَلاَ يُبَاشِرَهَا وَلاَ يَخْرُجَ لِحَاجَةٍ إِلاَّ لِمَا لاَ بُدَّ مِنْهُ وَلاَ اعْتِكَافَ إِلاَّ بِصَوْمٍ وَلاَ اعْتِكَافَ إِلاَّ فِي مَسْجِدٍ جَامِعٍ،

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইতিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হলো, “সে কোন রোগী দেখতে যাবে না, জানাযায় অংশগ্রহণ করবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না, তার সাথে সহবাস করবে না এবং অধিক প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবে না, রোজা না রেখে ই‘তিকাফ করবে না এবং জামে মাসজিদে ই‘তিকাফ করবে।” (সুনানে আবু দাউদ: ২৪৭৩ নং)

শুধু তাই নয়, পুরুষদের পাশাপশি মহিলারাও ইতিকাফে বসতে পারবে। এক্ষেত্রে তাদের জন্য উত্তম হচ্ছে, নিজ ঘরে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানে অথবা ঘরের যেকোন পবিত্র স্থানে। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন,
’ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ‏،‘

অর্থাৎ, অতঃপর তাঁর সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন।
(সহিহ বুখারী: ৪৯৯৮ নং)

উল্লেখ্য, বিবাহিত নারীর জন্য ইতিকাফে মনোনিবেশ করতে হলে অবশ্যই স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায়, নারীর জন্য ইতিকাফ বৈধ হবে না। এক্ষেত্রে প্রত্যেক স্বামীর উচিত, তাঁর স্ত্রীকে ইতিকাফের অনুমতি প্রদান করা।

ইতিকাফের ফজিলত:

পাশাপাশি, ইতিকাফের বহুবিধ ফজিলত অর্থাৎ তাৎপর্য রয়েছে। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আল্লাহর ঘরের মেহমান হিসেবে অবস্থান এবং ইবাদতে মগ্ন থাকতে পারে। এমনকি গুনাহ্ ক্ষমা লাভের পাশাপাশি অসংখ্য নেকি অর্জনেরও সুযোগ রয়েছে। যেমন,

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ (صلى الله) قَالَ فِي الْمُعْتَكِفِ هُوَ يَعْكِفُ الذُّنُوبَ وَيُجْرَى لَهُ مِنْ الْحَسَنَاتِ كَعَامِلِ الْحَسَنَاتِ كُلِّهَا،

হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেন, “সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৭৮১ নং)

অনুরূপভাবে, ভিন্ন আরেকটি হাদীসে ইতিকাফের মাধ্যমে মহান রবের সন্তুষ্টি লাভের ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

ﻭَﻣَﻦِ ﺍﻋْﺘَﻜَﻒَ ﻳَﻮْﻣًﺎ ﺍﺑْﺘِﻐَﺎﺀَ ﻭَﺟْﻪِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺟَﻌَﻞَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺑَﻴْﻨَﻪُ ﻭَﺑَﻴْﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺭِ ﺛَﻠَﺎﺙَ ﺧَﻨَﺎﺩِﻕَ، ﻛُﻞُّ ﺧَﻨْﺪَﻕٍ ﺃَﺑَﻌْﺪُ ﻣِﻤَّﺎ ﺑَﻴْﻦَ ﺍﻟْﺨﺎﻓِﻘَﻴْﻦِ،

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় মাত্র একদিনের জন্য ই’তিকাফে থাকবে, আল্লাহ পাক তার এবং জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। এক একটি খন্দকের গভীরতা হলো আসমান ও জমিনের মধ্যকার দূরত্বের অধিক।
(সহীহ তারগিব ওয়াত তারহিব: ৪/৩৪৪)

এছাড়াও, ইতিকাফের মাধ্যমে আরেকটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদর বা শবে কদরের রাত অনুসন্ধান করা। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা:) এর হাদীস দ্বারা স্বীকৃত যে, লাইলাতুল কদরের রাত রমাদ্বান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রির যেকোন একটি হবে। যেমন নবীজি (সাঃ) বলেন,

”فَالْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ، وَالْتَمِسُوهَا فِي كُلِّ وِتْرٍ“،

অর্থাৎ, তোমরা উহা (লাইলাতুল কদর) শেষ দশকে তালাশ কর এবং প্রত্যেক বেজোড় রাতে তালাশ কর। (সহিহ বুখারী: ২০২৭ নং)

এজন্য ইতিকাফকারী রমাদ্বানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকার মাধ্যমে, সহজেই কদরের রাত লাভ করতে পারে। কেননা, এই রাতকে উত্তম রাত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,

’لَیۡلَة الۡقَدۡرِ ۬ۙ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَهرٍ،‘

অর্থাৎ, কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (সূরা কদর: ৩ নং)

ইতিকাফের হুকুম:

তবে ইতিকাফের হুকুম কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যেমন ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল প্রভৃতি। এক্ষেত্রে রমাদ্বান মাসের ইতিকাফের হুকুম হচ্ছে সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। শরীয়তের আলোকে এর বিধান হচ্ছে, এই জাতীয় বিধান এলাকাবাসী’র পক্ষ থেকে যেকোন একজনকে অবশ্যই আদায় করতে হবে। সবাই আদায় করা জরুরি নয়। তবে কেউই যদি আদায় না করে, তাহলে সবাই গুনাহগার হবে। এজন্য নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই, অন্যদের ইতিকাফে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যেন এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একজন হলেও ইতিকাফে মনোনিবেশ করেন।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, অর্থ বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতিকাফ করা জায়েজ নেই। ইসলামী শরীয়তে কঠোরভাবে ইহার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামও একমত পোষণ করেছেন। তাই, এহেন কার্যাবলী হতে সবার বিরত থাকা আবশ্যক। অন্যথায়, গুনাহগার হতে হবে।

আল্লাহ্ তা’য়ালা সবার সৎ কর্মকে কবুল করুন, আমিন।

লেখক: তরুণ গবেষক ও লেখক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ