বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ ।। ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১ জিলকদ ১৪৪৫


কালের কিংবদন্তি আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরি রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আল আমীন আজহার ।।

আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরি ছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত পন্ডিত এক বিস্ময়পুরুষ। তার জ্ঞানের গভীরতা ছিল প্রবাদতুল্য।

আল্লামা কাশগরী ছিলেন মধ্য এশিয় মুসলিম জনপদের করুন ও মর্মান্তিক ইতিহাসের একজন জীবন্ত সাক্ষী। হৃদয়ের গহীনে দুঃখ-বেদনার এক মহাসাগর বয়ে বেড়াতেন। বেদনার সেই তপ্ত লাভা সব সময় তিনি আড়াল করে রাখতেন।

আল্লামা কাশগরী ছিলেন চিরকুমার। তার আত্মীয়-স্বজন পরিবার-পরিজন সম্পর্কে সেভাবে কিছুই বলা যায় না। কেবল এতোটুকুই জানা যায়- ১৯১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তুর্কিস্তানের কাশগর নগরে তার জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সামন্ত শাসক।কমিউনিস্টরা যখন বিপ্লবের নামে সে দেশে গণহত্যা নির্যাতন শুরু করে আত্মরক্ষার জন্য তখন দলে দলে মানুষ দেশত্যাগ করে। সেই দেশত্যাগী মানুষের কাফেলায় শরিক হয়েই তিনি হিন্দুস্তানে এসেছিলেন।

আল্লামা কাশগরীর অতীত ছিল খুবই দুঃখজাগানিয়া। কখনো যদি তিনি তার কোনো ছাত্রের সামনে অতীতের স্মৃতিচারণ করতেন তখন সেই শ্রোতার হৃদয়ও হু হু করে কেঁদে উঠতো। দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঢল নেমে আসতে অঝোরধারায়। অতীতের সেসব কথা মনে করে মাঝেমধ্যে তিনি উদাস হয়ে যেতেন। একাকী বসে ছোট বাচ্চার মত ডুকরে কেঁদে ফেলতেন।

আল্লামা কাশগরী বাবা ছিলেন কাশগরের সবচাইতে ধনী ব্যক্তি এবং সকলের শ্রদ্ধাভাজন আলেম। বিপ্লবের নামে কমিউনিস্ট জালেমরা যখন সারা দেশের নেত্রীস্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যায় তখন তারা আল্লামা কাশগরী আব্বা বড় ভাই ও বড় দুই বোনকেউ তুলে নিয়ে যায়। আর কমিউনিস্টরা একবার যাকে তুলে নিয়ে যেত তার কোন হদিস পাওয়া যেত না।

কাশগরীর আব্বা বড় ভাই এবং দুই বোনের ক্ষেত্রেও এমনই ঘটেছিল। তাদের কোথায় নেওয়া হয়েছে এখন তারা কেমন আছে কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা কোন সংবাদ কখনোই আসেনি। তাদের যেসব ফলের বাগান খামার পশু পাল ও সম্পত্তি ছিল সবকিছুই কমিউনিস্টরা দখল করে নেয়। আব্দুর রহমান কাশগরী আর তার আম্মাকে থাকার জন্য ছোট্ট একটা খামারবাড়ি দেওয়া হয়েছিল মাত্র। কাশগরীর আম্মা স্বামী এবং সন্তান হারানোর শোকে ততদিনে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। ওই সময় কাশগরীর বয়স ১৪ কিংবা ১৫।

ভালো-মন্দ বিবেচনা বোধ তৈরি হয়েছিল তার। কমিউনিস্ট জালেমদের আঘাতে তারা যে একেবারে নিঃস্ব ও ধ্বংস হয়ে গেছে এতোটুকু বুঝতে আপাতত অসুবিধা হয়নি।

এমন ভয়ার্ত সময়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে একদল মুসলিম যুবক লুকিয়ে লুকিয়ে গেরিলা হামলা করছিল। তাদের সফলতার খবরা-খবর ও আসছিল। এতে কমিউনিস্ট জালেমরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে এবং শিশু-কিশোর নির্বিবাদে পাকড়াও শুরু করে।

এসময় আব্দুর রহমান কাশগরীর আম্মা তার একমাত্র ছেলের জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। অবশেষে নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে তিনি একমাত্র সন্তান কাশগরীকে হিন্দুস্তানগামী এক মুহাজের কাফেলার সাথে পাঠিয়ে দিতে মনস্থির করেন।ভাবেন- চোখের আড়াল হোক;তবু আমার কলিজার টুকরা বেঁচে থাকুক।

আব্দুর রহমান কাশগরী মুহাজের কাফেলার সাথে হিন্দুস্তানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় আম্মাকে খুব অনুরোধ করেছিলেন তার সাথে বেরিয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু তিনি তার স্বামী ও অন্য সন্তানদের আশা তখনও ছাড়েননি। যদি তারা ফিরে আসে! বাড়ি ফিরে যদি তারা তাকে না পায়! এই আশায় এবং আশঙ্কায় আল্লামা কাশগরীর আম্মা সেদিন মুহাজের কাফেলার সাথে হিন্দুস্তানগামী হতে পারেননি।

এক সন্ধ্যা রাত। চারপাশে আবছা অন্ধকার। আকাশে তখনও চাঁদ ওঠেনি। কিশোর আব্দুর রহমান বেরিয়ে পড়েছেন হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে মোহাজের কাফেলার সাথে।
অনেকটা পথ পেরোনোর পরও তিনি পেছনে ফিরে দেখতে পেলেন দূরে টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আম্মা করুন চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর পথের দিকে। কাফেলা পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হওয়ার আগ মুহূর্তে আব্দুর রহমানের কানে আসে তার আম্মার চিৎকার। আম্মা আব্দুর রহমানের নাম ধরে ডাকছেন- আব্দুর রহমান! আব্দুর রহমান!

তারপর থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত যখনই তিনি আনমনা হয়ে উঠতেন কানে এসে আঘাত করতো আম্মার সেদিনকার চিৎকার। আব্দুর রহমান, আব্দুর রহমান, আব্দুর রহমান বলে তিনি ডেকে চলেছেন।

হিন্দুস্তানে পৌঁছার পর ভাগ্যক্রমে লখনৌর নদওয়াতুল উলামার এতিমখানায় আশ্রয় হয় আব্দুর রহমান কাশগরীর। দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামা থেকে তিনি ১৯৩১ সালে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে সর্বোচ্চ ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এবং নদওয়াতুল উলামাতেই তিনি আরবি সাহিত্যের শিক্ষক পদে নিয়োজিত হন।

শেরেবাংলা একে ফজলুল হক বাংলার শিক্ষামন্ত্রী হলে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একবার এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে নদওয়াতুল উলামায় যান এবং সেখানে আল্লামা কাশগরীর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।

কাশগরীর অসাধারণ পাণ্ডিত্যে তিনি যারপরনাই মুগ্ধ হন। তখন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক আল্লামা কাশগরীকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারের উদ্দেশ্যে বড় লার্ট ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় যে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই কলিকাতা মাদ্রাসা-ই-আলিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ করলে আল্লামা কাশগরী রাজি হন। এবং উসুলে ফিকহের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।

কালক্রমে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসাটি ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়, তখন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাকে লাইব্রেরির বইপত্র তদারকি করার জন্য নিযুক্ত করেন। তখন আল্লামা কাশগরী (রহ) কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং লাইব্রেরী তদারকি করেন।
এখানে দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ১৯৫৬ সালে তিনি সহকারী হেড মাওলানা পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে আল্লামা কাশগরী রহ. ১৯৬৯ সালে হেড মাওলানা পদে উন্নীত হন। তিনি ছিলেন শিক্ষক মন্ডলীর শিক্ষক। তার উপাধি ছিল উস্তাযুল আসাতিযা

আল্লামা কাশগরী আরবি সাহিত্যের একজন নামকরা লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ আজ জাহরাত কায়রোর একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তার রচিত অনেক গ্রন্থ মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। কিতাবুল হাদিকা, কিতাবুল মুফীদ,আল ইবরাত,আযযাহরাত আশ শাযারাত, মুহিককুননাকদ, আল মাহবাব ফিল মুযাককার ইত্যাদি।তার রচিত অনেক বই দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসার পাঠ্য ছিল। তিনি'আল মুফিদ' নামে একটি অভিধানও সংকলন করেছিলেন।

মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ঢাকা আলিয়াতেই কর্মরত ছিলেন। এমন দুঃখ নদী হৃদয়ে বয়ে বেঁচে ছিলেন আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরী। এই চিরদুখী মানুষটার আপন বলতে কেউ ছিলনা। হোস্টেলের ছেলেগুলোকেই তিনি আপন মনে করতেন। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা শহরেই ইন্তেকাল করেছেন। আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লামা কাশগরী সাহেবের খোঁজখবর রেখেছেন। ভুলে যাননি। তাকে তিনি আন্তরিকভাবেই ভালোবাসতেন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ