রকিব মুহাম্মদ: ধর্মের নামে অত্যাচারিত হয়েছেন এমন বিভিন্ন দেশের মানুষদের নিয়ে তৈরি একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বুধবার নিজের ওভাল অফিসে দেখা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে বিভিন্ন দেশে নিপীড়নের শিকার হওয়া লোকজনের পক্ষে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেন ওই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। সেখানে বাংলাদেশি পরিচয়ে প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের কাছে দেশের মুসলিম সমাজ ও সরকারের নামে নালিশ করে।
ওই সাক্ষাতে প্রিয়া সাহা ট্রাম্পকে বলেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশেই থাকতে চাই।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই নারী ট্রাম্পকে বলছেন, এখনও সেখানে (বাংলাদেশে) ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশ ছাড়তে চাই না। সেখানে আমি আমার ঘরবাড়ি হারিয়েছি। তারা আমার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারা আমার জমিজমাও দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এর কোন বিচার হয়নি।
ওই নারীর এমন বক্তব্যের পর ট্রাম্প বলেন, কারা জমি দখল করেছে, কারা ঘরবাড়ি দখল করেছে? তখন ওই নারী মুসলিমদের নামে বিষদগার করে বলেন, মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন। তারা সবসময় রাজনৈতিক আশ্রয় পায়। সবসময়।
কেন এই নালিশ?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিরোজপুরের এক এনজিও কর্মী গণমাধ্যমকে বলেন, হয়তো নিজের মেয়েদেরকে গ্রিনকার্ড পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রিয়া সাহা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে এ সব ভিত্তিহীন অভিযোগ করছেন।
অন্য একটি সূত্র বলছে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নিজেদের অসহায় প্রমাণ করাই ছিল প্রিয়ার টার্গেট।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই তার অভিযোগ বলেও ধারণা অনেকের। কেউ কেউ এই ঘটনার পেছনে বড় কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
কে এই প্রিয়া সাহা?
প্রিয়া সাহা বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক। রানা দাস গুপ্ত ওই ঐক্য পরিষদের সভাপতি। প্রিয়া সাহার বাড়ি চরবানিরী মাটিভাঙ্গা, নাজিরপুর, পিরোজপুর।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, রোকেয়া হলে থাকতেন। এখন একটি এনজিও আছে ওনার। ‘শারি’ নামে বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায় নিয়ে একটি এনজিওর পরিচালক হলেন প্রিয়া সাহা ওরফে প্রিয়া বালা বিশ্বাস। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক।
তার বাবার বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চরবানিয়ারী গ্রামে। শ্বশুর বাড়ি বৃহত্তর যশোরে। প্রিয়ার স্বামী মলয় কুমার সাহা দুদকের সদর দফতরে উপপরিচালক পদে কর্মরত রয়েছেন। তার দুই মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা সাহা ও ঐশ্বর্য লক্ষ্মী সাহা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করেন।
বিতর্কিত প্রিয়া!
জানা গেছে, বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য গতবছর তাকে মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়, বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার নাটক করে প্রচুর বিদেশি ফান্ড কালেক্ট করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে চরবানিয়ারীতে প্রিয়ার ভাই জগদীশ চন্দ্র বিশ্বাসের একটি অব্যবহৃত ঘরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
তখন অভিযোগ ওঠে, পাশের বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান শামীম ঘরটি রাতের আঁধারে পুড়িয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে একটি মন্দিরে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
সেখানে শামীমের একটি মাছের ঘের রয়েছে। তখন পাল্টা অভিযোগ ওঠেছিল শামীমেরও তিনটি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় চিতলমারী এলাকায়।
এছাড়াও তিনি তার এলাকার দলিত সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করেন এবং নানা রকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে এই এনজিওর জন্য বিদেশ থেকে টাকা আনেন। এই যে তার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ করেছে সেটাও বিদেশ থেকে টাকা আনার ফন্দি করেন বলে জানা গেছে।
কিছুদিন আগে বাগের হাটের চিতলমারি এবং চরবানিরী সীমান্ত এলাকায় ধান কাটা নিয়ে দুই এলাকার মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে উভয় এলাকার কিছু লোকের ক্ষতি সাধিত হয়। তিনি সুবিধামত বাড়িতে আগুন দেয়ার সেই ছবি ব্যবহার করে বলেছেন তার নিজের বাড়ী পুড়েছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।
প্রিয়ার পরিচিত শফিকুল ইসলাম রাসেল যা বললেন
ফেসবুকে শফিকুল ইসলাম রাসেল প্রিয়া সাহা নামে একটি কবিতার চরণ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘নিজ দেশ ত্যাগী যেন বিদেশ ন যাই’। এরপর তিনি একটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, প্রিয়া সাহা এনজিও সেক্টরের পরিচিত মুখ। দারুণ মিশুক স্বভাবের। তার সঙ্গে আমারও ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি তাকে প্রিয়া দি বলেই ডাকতাম। তারপর অনেক দিন ধরে যোগাযোগ নেই। তার এক বোন (কাজিন) আমার ফ্রেন্ড। প্রিয়া সাহা পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি ‘শাড়ি’ নামে একটি এনজিও’র নির্বাহী প্রধান।
তার বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারীতে। থাকেন ঢাকার জিগাতলায়। তার স্বামী দুদকের কর্মকর্তা। তাদের পরিবার সিপিবির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আগে কোনও দিন শুনিনি তাদের পরিবারের ওপরে এমন হামলা হয়েছে।
ঘর দুয়োর পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে এখন খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওই এলাকায় তার পরিবারসহ আরও একাধিক পরিবার সম্প্রতি একটি চিহ্নিত প্রভাবশালী মহলের আক্রোশের শিকার হয়েছে। এর সঙ্গে মৌলবাদীদের কোনও সম্পর্ক নেই।
তবে তার বক্তব্য শুনে আমি বিস্মিত। তিনি কি ট্রাম্পকে সামনে পেয়ে খুব বেশি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন! নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন? এমন তো হওয়ার কথা নয়।
প্রিয়া সাহার বক্তব্যের পর...
প্রিয়া সাহার বক্তব্য ‘বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও ভাবমূর্তি নষ্টের কারণ’ বলে মনে করছেন সচেতন মহল। সামাজিক মাধ্যমে এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, এটা দেখি ঘষেটি বেগম। অপর একজন লিখেছেন, এটা কাদের চাল হতে পারে বুঝলাম না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহা যে নালিশ করেছে তা চক্রান্তের অংশ ছাড়া আর কিছু নয়।
বাংলাদেশ নিয়ে প্রিয়া সাহার ‘মিথ্যা অভিযোগে’র তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি জানান, প্রিয়া সাহা কেন এমনটি করলেন তা খতিয়ে দেখা হবে। শুক্রবার নিজের ফেসবুক পেজে প্রতিমন্ত্রী এই কথা বলেন।
এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে এক বাংলাদেশি সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে যে তথ্য দিয়েছেন তা সঠিক বলে মনে করেন না ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরকে শ্রদ্ধা করে।
আরএম/