।।মুহাম্মাদ শোয়াইব।।
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ এক গভীর ও অনিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছেছে, এবং প্রশ্ন উঠছে—কবে ইরানের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মিত্ররা এই সংঘাতে অংশ নেবে, বিশেষ করে যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এই প্রসঙ্গে দুই বিশ্লেষক তাঁদের মতামত দিয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকির মাত্রা ইতিহাসে নজিরবিহীন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তিনি ইরানকে শর্তহীন আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছেন এবং এমনকি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির হত্যা করার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, “আমরা জানি সে কোথায় থাকে।”
এদিকে, ট্রাম্পের সরাসরি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক ফোর্দু স্থাপনাটি ধ্বংস করার জন্য। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্ট্র্যাটেজিক সামরিক শক্তি অঞ্চলের দিকে পাঠিয়েছে বা সতর্ক অবস্থায় রেখেছে, যার মধ্যে আছে কুখ্যাত বি-৫২ বোমারু বিমান, বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম।
পর্যায়ক্রমিক বিকল্প ও প্রতিক্রিয়া
জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. লিকায় মাকি (আলজাজিরা স্টাডিজ সেন্টার) বলছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে নামে, তবে ইরান পারস্য উপসাগর ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিসমূহ এবং অন্যান্য স্বার্থকে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পারে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এসব ঘাঁটি অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতাধীন। তাই সেসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা ব্যর্থ হলে ইরান তার আঞ্চলিক “বাহু” বা মিত্র গোষ্ঠীগুলোকে সক্রিয় করে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ যেমন তেলক্ষেত্র আঘাত হানার চেষ্টা করতে পারে।
তবে মাকি মনে করেন, ইরান তার সামরিক শক্তি যথেষ্ট বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করবে, কারণ এই শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের উন্মুক্ত সমর্থন পাওয়া ইসরায়েলের তুলনায় সীমিত। তিনি বলেন, “ইতিহাস ও রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি দেশ হিসেবে ইরানকে ধ্বংস করা সহজ হবে না।”
অন্যদিকে ইরানি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. ফাতিমা সামাদী মনে করেন না, ইরান এতটাই দুর্বল যে ট্রাম্পের শর্তে আত্মসমর্পণ করবে। তিনি জানান, গত দুদিনে ইউরোপীয় ও আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে পাঠানো সব বার্তা ইরান প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ এসব বার্তার সারকথা ছিল: আত্মসমর্পণ করে আলোচনায় ফিরে যাও।
এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইরান এখনও মিত্রদের সক্রিয় না করলেও পরিস্থিতি ঘণীভূত হলে হিজবুল্লাহ, হুথি, কিংবা ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া মিলিশিয়ারা সামনে আসতে পারে, বিশেষ করে যদি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি রূপ নেয়।
আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না: ইরানের মিত্ররা প্রস্তুত, হুঁশিয়ার করলেন বিশ্লেষকরা
ড. ফাতিমা সামাদী মনে করেন, ইরানের জন্য আত্মসমর্পণের কোনো সুযোগ নেই, কারণ তারা অতীতে যে প্রস্তাবগুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং যার জন্য তারা রক্ত ও বিজ্ঞানীদের মূল্য দিয়েছিল, তা আজ মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। উপরন্তু, ইরানের রয়েছে এমন আঞ্চলিক মিত্র যারা তাকে একা ছেড়ে দেবে না।
কে এই মিত্ররা?
– ইরাকি ও আফগান শিয়া মিলিশিয়া,
– ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ গোষ্ঠী, যারা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা ইরানের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে নামবে, যেমন তারা গাজার যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে লড়েছে,
– লেবাননের হিজবুল্লাহ, যার সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সামাদী প্রত্যাখ্যান করেছেন।
হিজবুল্লাহর ক্ষয়ক্ষতি
ইসরায়েল গাজায় হামলার পর ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে সমর্থন দেওয়ায় হিজবুল্লাহকে গুরুতর হামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
ইসরায়েল "অপারেশন বেইজার" নামের অভিযানে হিজবুল্লাহর হাজারো যোদ্ধাকে টার্গেট করে, এবং সাবেক মহাসচিব হাসান নাসরুল্লাহ ও তার শীর্ষ সহযোগীদের হত্যা করতে সক্ষম হয়।
এই ক্ষয়ক্ষতি ও আন্তর্জাতিক চাপে হিজবুল্লাহ সীমান্ত অঞ্চল থেকে কিছু সেনা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। লেবানন সরকার জানিয়েছে, তারা হিজবুল্লাহর অস্ত্রভাণ্ডারের বড় একটি অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
তবে সামাদীর মতে, এই মিত্রদের ঘায়েল করা হলেও তারা ভেঙে পড়েনি। বিশেষ করে হুথিদের শক্তি এখনো পুরোপুরি নিঃশেষ হয়নি বলে তার ধারণা।
হুথিদের অবস্থা
– হুথিরা ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন থামাতে ইসরায়েল লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে,
– লোহিত সাগরে বহু জাহাজে আঘাত হেনেছে, যেগুলো ইসরায়েলি বন্দর অভিমুখে যাচ্ছিল।
– যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হুথিদের লক্ষ্য করে বহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়,
– পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হুথিদের এক সমঝোতা হয়—তারা মার্কিন জাহাজ টার্গেট না করলে আমেরিকাও তাদের উপর হামলা বন্ধ করবে।
ইরাকি মিলিশিয়া এখনো সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি, তবে সামাদী মনে করেন হিজবুল্লাহ পুরোপুরি বাদ যায়নি, এবং এ সকল শক্তিই ইরানের হাতে গুরুত্বপূর্ণ "চাপ দেওয়ার কার্ড" হিসেবে রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব
সামাদী শেষ মন্তব্যে বলেন, ইরানকে টার্গেট করার খরচ অনেক বেশি হবে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য। কারণ এতে বৈশ্বিক জ্বালানির জোগান ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে, যা চীনসহ অনেক তেলনির্ভর দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলো ইরানকে ঘিরে রেখেছে "ব্রেসলেটের মতো", এবং সেগুলো তেহরানের হাতের নাগালের বাইরে নয়। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ইরান এর আগেও ইরাকের আইন আল-আসাদ ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছিল—যা ছিল একটি স্পষ্ট বার্তা: ইরান আঘাত করতে সক্ষম।
আন্তর্জাতিক সমর্থন: অপ্রতুল ও অস্পষ্ট
ড. লিকায় মাকি মনে করেন, ইরানের আন্তর্জাতিক মিত্ররা—যেমন চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান—এখনো প্রত্যাশিত সমর্থন প্রদর্শন করেনি। তিনি বলেন, চীন এমনকি তার বিশাল অর্থনৈতিক স্বার্থ (যেমন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা "সিল্ক রোড") রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কিছু করেনি। যদি ইরান ও তার আঞ্চলিক মিত্রদের নির্মূল করা হয়, তাহলে বিকল্প পথ হিসেবে ভারতের মুম্বাই করিডোর বেইজিংয়ের "সিল্ক রোড"-এর প্রতিস্থাপন হয়ে উঠতে পারে—যা চীনের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা হবে।
রাশিয়ার ভূমিকা নিয়েও মাকি হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রাশিয়া কেবল নিন্দা জানিয়েছে ও ইরানকে সংযত থাকতে বলেছে, অথচ ইরানই তাকে ইউক্রেনে ব্যবহার করার জন্য "শাহেদ" ড্রোন সরবরাহ করেছিল। ইরানের এই সমর্থনের ফলে ইউরোপের সঙ্গে তার সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া নিয়েও তিনি বলেন, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শুরুতে বলেছিলেন—"পাকিস্তান ইরানের পাশে শক্তি অনুযায়ী দাঁড়াবে"—কিন্তু পরে সরকারি মহল থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, এই বক্তব্য কেবল কূটনৈতিক সমর্থনের কথা বোঝায়, সামরিক নয়।
পরিশেষে, ড. মাকি মনে করেন, ইরানের আসল ভরসা এখন তার আঞ্চলিক বাহুগুলোর (proxy forces) ওপর—যেমন হিজবুল্লাহ, হুথি, ইরাকি-আফগান মিলিশিয়ারা—এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের কাছ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সামরিক সহায়তা পাওয়ার আশা করা অবাস্তব।
তিনি বলেন, ইরানকে এখন পর্যন্ত কেবল বক্তব্য ও গণমাধ্যমে সমর্থন দেওয়া হয়েছে—ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা করা হয়েছে—কিন্তু বাস্তব সামরিক সহায়তা একেবারেই অনুপস্থিত।
এনএইচ/