সিলেবাসে মানতিক: দুই তরুণ শিক্ষাবিদ আলেমের মতামত
প্রকাশ: ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ০৭:৪৯ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

|| হাসান আল মাহমুদ ||

কাফিয়া জামাতকে বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভূক্ত করেছে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক।  বেফাকের ৪৮তম কেন্দ্রীয় পরীক্ষা (১৪৪৬ হি.) হতে অন্যান্য ক্লাসের সাথে সানাবিয়্যাহ-২ (কাফিয়া) জামাতের পরীক্ষাও কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হবে’।  বেফাক জানিয়েছি, আলোচনা-পর্যালোচনার পর বিগত ২৮/০৭/১৪৪৫ হি. মোতাবেক ১০/০২/২০২৪ ঈ. তারিখে অনুষ্ঠিত মজলিসে খাসে আগামী বছর ১৪৪৬ হি. হতে সানাবিয়্যাহ-২ (কাফিয়া- দশম শ্রেণি সমমান) জামাতের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়’।

বেফাকের এমন সিদ্ধন্ত নিয়ে আওয়ার ইসলাম দেশের শিক্ষাবিদ আলেম, মুহতামিমদের মতামত সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদন লিংক-১ : কাফিয়া জামাতে বোর্ড পরীক্ষা, কী বলছেন মুহতামিমগণ

প্রতিবেদন লিংক-২: কাফিয়া জামাতের সিলেবাস নিয়ে তরুণ আলেমদের ১৫ প্রস্তাবনা

প্রতিবেদন লিংক-৩: সিলেবাসে মানতিক: মাওলানা আব্দুল গাফফার-এর মতামত

এদিকে কওমি মাদরাসার নতুন শিক্ষাবর্ষ হচ্ছে। ভর্তি কার্যক্রম শেষে আর কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হবে নতুন শিক্ষা বর্ষের পথচলা। কিন্তু ‘কাফিয়া জামাতের বোর্ড পরীক্ষা ও সিলেবাস’ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা থেমে নেই।

সিলেবাসে মানতিক শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু এ নিয়ে সময়ের দুজন তরুণ শিক্ষাবিদ আলেম মতামত তুলে ধরেছেন আওয়ার ইসলামের কাছে।

গাজীপুর টঙ্গী সাতাইশ অবস্থিত  জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুমের  সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি মাহবুবুর রহমান নোমানী বলেন, ‘আমরা এক সময় শুনতাম, মানতেক খুব প্রয়োজনীয় সাবজেক্ট। মানতেকের ইলম ছাড়া ভালো আলেম হওয়া যায় না। মানতেকের কিতাবেও এ কথা লেখা আছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এর কার্যকরিতা দেখছি না। কোরআন ও হাদিস বুঝার জন্য মানতেকের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করি না। আরব দেশে মানতেক পড়ানো হয় না। তারা কি কোরআন হাদিস বুঝে না?’

‘মানতিকের চেয়ে আরবি ভাষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন’ বলে মনে করছেন এই শিক্ষাবিদ আলেম।

জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া বলিয়ারপুর, সাভার ঢাকা’র উস্তাযুল হাদীস মুফতি সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘যুক্তিবিদ্যা একটি সুশৃংখল বিজ্ঞান। এটি মিথ্যাকে বর্জন ও সত্যকে গ্রহণ করার সঠিক চিন্তা পদ্ধতির নির্দেশ করে। অর্থাৎ সত্যের সন্ধান ও ভ্রান্তি পরিহারের উদ্দেশ্যে যুক্তিপদ্ধতি ও তার সহায়ক প্রক্রিয়া যেমন সংজ্ঞা, বিভাগ, ব্যাখ্যা, শ্রেণিকরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। এর মূল আদর্শ সত্যতা। মানুষ যেহেতু চিন্তা করতে পারে৷  তাই জানা থেকে অজানাকে জানার কৌতুহল চিরন্তণ। জানার মাধ্যমে অজানাকে জানার মানসিক প্রক্রিয়াকে বলা হয় অনুমান। আর অনুমান ও তার সহায়ক প্রক্রিয়াসমূহ নিয়ে যে বিদ্যা আলোচনা করে তাকে বলা হয় যুক্তিবিদ্যা। অর্থাৎযে ব্যবহারিক বিজ্ঞান ভ্রান্তিকে পরিহার করে সত্যকে অর্জন করার উদ্দেশ্যে যুক্তিপদ্ধতি বা অনুমানএবং তার সহায়ক প্রক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রনকরে তাকে যুক্তিবিদ্যা বলে। মানুষ অজানাকে জানার অদম্য আগ্রহ নিয়েই আদিম যুগ থেকে আজ উন্নত যুগে পদার্পন করেছে৷  আর ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান। জীবন ও জগতের সব গুরত্বপূর্ন বিষয় নিয়েই ইসলাম আলোচনা করেছে৷ জীবন ও জগত সম্পর্কে এই চিন্তাই হলে দর্শন৷ দর্শনের শুদ্ধতাও নির্ভর করে যুক্তিবিদ্যার উপর৷ শুধু দর্শন নয়৷ গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাধারন বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ধর্মদর্শন সহ অন্যান্য সকল জ্ঞানের শুদ্ধতা যাচাই করা যায় যুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে৷ তাই বলা যায় মানতিক বা যুক্তিবিদ্যা একটি প্রয়োজনীয় বিদ্যা৷

এখন কওমি মাদরাসায় মানতিক পড়ানোর প্রয়োজনীয়তা কী?

১, আল্লাহ তায়ালা কুরআনীল কারীমে অসংখ্য যুক্তি দিয়েছেন৷ কুরআনের যুক্তিগুলো গভীর ভাবে অনুধাবন ও প্রকাশ করার জন্য যুক্তিবিদ্যা জানা জরুরী৷

২, হেদায়া সহ অনেক গুরুত্বপূর্ন কিতাবে আকলী দলিল ব্যাবহৃত হয়েছে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্যও মানতেক প্রয়োজন৷

৩, মানুষের মন যুক্তিবাদী৷ তাই ধর্মকে যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষন ও অনুধাবনের জন্য মানতেক প্রয়োজন৷

৪, জীবন ও জগত সম্পর্কে গভীর ধারনা অর্জন করার জন্য দর্শনের জ্ঞান দরকার৷ আর দর্শনের জন্য মানতেক প্রয়োজন৷

৫, অন্যান্য বিদ্যার জন্যও মানতেক প্রয়োজন যা আগে উল্লেখ করেছি৷

৬, বিরুদ্ধবাদীদের যৌক্তিক মোকাবেলা তাদের ভ্রান্ত নীতির মুখোশ উন্মোচন, বাহাস মুবাহাসার জন্যও যুক্তিবিদ্যা প্রয়োজনীয়৷ বিশেষ করে প্রাচীন আলেমগণ যেমন গভীর জ্ঞানী ও তুখোর বিতার্কিক হতেন৷ বর্তমানে তেমন দেখা যায় না৷ এর একটি কারন মানতেক ফালসাফা না জানা৷

৭,বর্তমান নাস্তিক্যবাদী, বস্তুবাদী সহ অন্যান্য ফিতনা মোকাবেলা ও তাদের খন্ডনের জন্য মানতেক ফালসাফার গুরুত্ব অপরিসীম৷

৮,সর্বোপরি একটি চিন্তাশীল, দার্শনিক, পন্ডিত, যুক্তিমনা প্রজন্ম তৈরি করতে হলে মানতিক ফালসাফার প্রয়োজন আছে৷

তবে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো দার্শনিক যুক্তিবাদী আলেম গড়তে চাইলে দর্শন, যুক্তিবিদ্যা পড়াতে হবে৷ কিন্তু আটশ বছর আগের যুক্তি দর্শন দিয়ে কি বর্তমান সমস্যা মোকাবেলা করা যাবে?

আটশ বছরে পৃথিবী অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ সমস্যাবলীও নতুন রুপ ধারন করেছে৷ কিন্তু পরিবর্তন হয়নি শুধু আমাদের কিতাব৷ এই আটশ বছরে কি কোন গবেষক তৈরি হয়নি? যিনি নতুন ফিৎনা মোকাবেলায় নতুন শরহে তাহযীব লিখবেন৷

বর্তমান পাশ্চাত্য দর্শন, বস্তুবাদী দর্শন, নাস্তিক্যবাদী দর্শন সহ সব নতুন ফেৎনা মোকাবেলায় নতুন যুক্তিদর্শন পাঠ করতে হবে৷

তাই মানতিক-ফালসাফা বর্তমানে চলেনা বলে নাক ছিটকানো যেমন ভূল তেমনি আটশ বছর পূর্বের কিতাব জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত ভেবে দেখা দরকার৷

এছাড়াও দেওবন্দের দরসে নিজামি সিলেবাসে গণিত (উকলিদাস), দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, জোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ ১৮৬৬ সালের বিবেচনায় এই সিলেবাসটি ছিল খুবই আধুনিক৷ কিন্তু এরপর সিলেবাস ১৮৬৬ সালে আটকে গেছে৷ গত দেরশ বছরে পৃথিবী অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ মানুষ দুনিয়া থেকে আসমানে যাত্রা করেছে৷ নতুন নতুন আবিষ্কার দ্বারা পৃথিবি পূর্ন হয়েছে৷ কিন্তু মাদরাসার নেসাব সেই ১৮৬৬ তেই আটকা পড়ে আছে৷

পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে সমন্বয় করে আমাদের সিলেবাস পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়নি৷ বরং দরসে নেজামীর দোহাই দিয়ে আমরা সমস্ত সংস্কারকে রুখে দিয়েছি। ওদিকে মানতেক ফালসাফা সহ অনেক বিষয় বাদ দিয়েছি৷।

সুতরাং সিলেবাস এখন আরো সংক্ষিপ্ত ও একপেশে হয়ে গেছে৷ কুরআন,হাদীস, ফিকাহ, ব্যাকরণ ও সামান্য ভাষা-সাহিত্য ছাড়া মাদরাসায় আর কিছুই পড়ানো হয়না। বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হলে ১৮৬৬ থেকে বর্তমান বিশ্বে ফিরতে হবে৷ এবং আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান সংযোজন ও সমন্বয় করে বিশ্বনন্দিত একটি সিলেবাস তৈরি করতে হবে৷ এটা এখন সময়ের দাবী৷

হাআমা/