আল্লামা আহমদ শফী রহ.: খণ্ড খণ্ড গল্প
প্রকাশ:
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১২:৫৬ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| রাকিবুল হাসান নাঈম || ১. গল্পটা তারও কয়েক বছর পরের। হযরত তখন সতেরো সুন্দর তরুণ। চেহারায় শুভ্র লাবণ্য। মাথায় সবসময় থাকতো রুমাল। দেখলেই যে কারো মনে পবিত্রতার অনুভূতি জাগতো।হেদায়াতুন্নাহু কিংবা কাফিয়া পড়েন। লজিং থাকেন রবিপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক বাড়িতে। রেল লাইন দিয়ে হেঁটে যেতে হতো লজিং বাড়িতে। প্রতিদিন হযরত এই রেল লাইন ধরে হেঁটে যান। হযরত টের পেলেন–তার যাওয়ার সময় একটি মেয়ে প্রতিদিন রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আনমনা। দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। তিনি পাত্তা দিতেন না। রুমাল মুখের উপর আরেকটু টেনে দিয়ে চলে যেতেন। একদিন মেয়েটি আচমকা পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বললো, ‘প্রতিদিন কেন এই সময় আপনার পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি বুঝেন না?’ হজরতের দৃষ্টি নির্বিকার। চোখে পাথর বিস্ময়, লজ্জারাঙা আভা। হযরত মেয়েটিকে কিছু বললেন না। পথ কাটিয়ে মাদরাসায় চলে এলেন। মাদরাসায় এসে শাহ আব্দুল ওয়াহহাব সাহেব রহ. এর রুমে গিয়ে কেঁদে দিলেন। শাহ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছো কেনো? হযরত বললেন, ‘লজিং বাড়ি যাবার পথে একটি মেয়ে আমাকে উত্যক্ত করে। আমি আর লজিং বাড়িতে যাবো না।’ এই ছেলের কথা শুনে শাহ সাহেব হতবাক। এত কম বয়সে এত বড় তাকওয়া! তার দৃষ্টি জুড়িয়ে গেলো। ভেতর থেকে তিনি দোয়া করলেন, ‘এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে, নিশ্চয়ই।’ তখন বোর্ডিং যিম্মাদার ছিলেন মাওলানা আবদুল হামেদ সাহেব রহ.। শাহ সাহেব আহমদ শফীকে বললাম, ‘আজ থেকে তুমি বোর্ডিংয়ে খাবে। লজিং বাড়ি যেতে হবে না। আমি মাওলানা হামেদ সাহেবকে বলে দিব।’ এই বলে তিনি হযরতের হাত ধরে বোর্ডিংয়ে নিয়ে গেলেন। বোর্ডিং প্রধান হামেদ সাহেবকে বললেন, ‘এই ছেলেকে চিনে রাখো। আজ থেকে যতদিন সে এই মাদরাসায় পড়বে, ততদিন বোর্ডিংয়ে তার খাবার চালু থাকবে। বন্ধ হবে না। তারপর নিয়ে গেলেন দারুল ইকামার রুমে। দারুল ইকামা প্রধানকে বললেন, এই ছেলের যে রুম পছন্দ, তাকে সে রুমেই থাকতে দেন।’ এর কিছুদিন পর দেওবন্দ চলে যান আহমদ শফী রহ.। একদিন দেওবন্দ থেকে আহমদ শফীর চিঠি আসে শাহ সাহেবের কাছে। তিনি চিঠি খুলে দেখেন আহমদ শফী লিখেছে, ‘হযরত! হুসাইন আহমদ মাদানি আমাকে খেলাফত দিয়েছেন।’ চিঠি পড়ে তার চোখে জল এসে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে দু‘হাত তুলে পরম করুণাময়কে তিনি বললেন, আমি সুদৃষ্টিতে যা কামনা করেছিলাম, তুমি তা-ই পূর্ণ করে দিলে মালিক। লাজ রাখলে তোমার বান্দার শুভদৃষ্টির!’ মাওলানা আবদুল ওহহাব সাহেব ছাত্রদের তরবিয়তি মজলিশে বলতেন, ‘এটা আমার আহমদ শফী। দেখো যেখানে যায় প্রধান বক্তা, নয়তো সভাপতি, কোথাও সদরুল মুদাররিসিন। আল্লাহ তাকে বড় করেছেন। আমি যে শুভদৃষ্টি দিয়েছিলাম, হুসাইন আহমদ মাদানি তা সত্যায়ন করেছেন।’ হযরত মাওলানা আমিনুল হক রহ. বলতেন, শাহ আব্দুল ওয়াহহাব সাহেব রহ. খুবই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মানুষ ছিলেন। ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. এর খলীফা। আহমদ শফী রহ. সেদিনই শাহ সাহেবের দূরদর্শী ও বিচক্ষণ দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিলেন। এবং সেদিনের সুদৃষ্টি ও সুনজরই আহমদ শফীকে আজকের শাইখুল ইসলাম বানিয়ে দিয়েছে। ২. হযরত রাওজান এলাকায় গিয়েছিলেন বয়ান করতে। বয়ান শেষে ফিরবার সময় সত্বর ঘাটে একদল বেদআতী হযরতের পথ আটকায়। যারা পথ আটকালো, তাদের মূর্তি ভয়ংকর। হাতে অস্ত্রশস্ত্র। কেউ বলে মেরে ফেল। কেউ বলে মেরে ফেলতেই হবে। খুব বেড়ে গেছে! হযরত বললেন, আমাকে তো মেরে ফেলবেই। শেষ ইচ্ছে হিসেবে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়তে চাই। খুব সংক্ষিপ্ত করে। দীর্ঘ করবো না। তারা রাজি হয়ে নামাজের অনুমতি দিলো। নামাজ শেষ করে হযরত দেখলেন হত্যা করতে আসা দলের লোকজন পরস্পরে ঝগড়া লেগে গেছে। তারা কেউ বলছে হুজুরকে মেরে ফেল। কেউ বলছে হুজুরকে মারা যাবে না। মতানৈক্যের কারণে শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। সহি‘ সালামতে হযরত মাদরাসায় ফিরে এলেন। ৩. ছাত্ররা ক্লাসে দেরি করে এলেও হযরত রেগে যেতেন। রাগের একটা গল্প শুনিয়েছেন মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ আযহারী। তিনি বলেন, একদিন হযরত ক্লাসে ঢুকে দেখেন অনেকে নেই, অনেকে মাত্র আসছে। আমি ক্লাসেই ছিলাম। তিনি এই এলোমেলো দৃশ্য দেখে রাগত স্বরে বললেন, আজ পড়াব না। ছাত্ররা সবাই ক্ষমা চাইলে হযরত বললেন, এক শর্তে ক্ষমা করতে পারি। আগামীকাল সবাই মাথা মুণ্ডন করে আসবে। ক্লাসে ৮০০ ছাত্র। সবাই মনে করলো এমনিতেই মাথা মুণ্ডাতে বলেছেন। তাই কেউ মাথা মুণ্ডায়নি। একমাত্র আমি মাথা মুণ্ডিয়েছি। পরদিন ক্লাসে এসে হযরত বললেন, তোমাদেরকে মাথা মুণ্ডাতে বলেছিলাম। একজন ছাড়া আর কেউ মুণ্ডায়নি। আমার সব দোয়া এই একজনই নিয়ে যাবে। ছাত্ররা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলে তিনি বললেন, যা হবার, তাতো হয়েই গেছে। এখন কান্না করলে লাভ হবে না। ৪. একদিন কাসেম সাহেব দা.বা. হযরতের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি ছাত্রদের খুব যত্ন করে পড়িয়েছি। যাকে যেখান থেকেই জিজ্ঞেস করেন, উত্তর দিতে পারবে। কেউ বাঁধবে না।’ ৫. ৬. প্রবেশপত্রে বেফাকের ছবি লাগানোর আলোচনাটি অনেক দিনের। বেফাকের এক মিটিংয়ে কেউ বললো, হাটহাজারি হযরত ছবি পছন্দ করেন না। কেউ বললো, হযরতকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হোক। হযরতকে জিজ্ঞেস করা হলে হযরত বললেন, প্রথমে মুফতি আবদুস সালাম সাহেব রাজি ছিলেন না। পরে পরীক্ষামূলকভাবে ছবি যুক্ত করা হলে উপকারই হয়েছে। ৭. শুক্রবারে এসে সম্পর্ক পাকাপোক্ত করে গেলো। তারপর একদিন আমার কাছে এসে বলল, ‘হযরতের কাছে সম্পর্ক করার পর অন্তরে যে প্রশান্তি অনুভব করছি, তার তুলনা হয় না।’ অথচ আমার মুসল্লি বন্ধুটি ছিলো বেদআতী। হযরতের সঙ্গে সম্পর্ক করার পর এমন আলোকিত পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে। বিদআতের সামান্য ছোঁয়াও তার জীবনে নেই। খ. আমরা পড়তাম বাবুনগরে। হাটহাজারী মাদরাসার দশ সালা অনুষ্ঠানে আমাদের দিয়ে কাজ করাতেন। আমরা হাটহাজারির ছাত্র না হওয়া সত্বেও। আমার মনে পড়ে–দশ সালা অনুষ্ঠানে একটি স্মারক বের হয়। স্মারকের জন্য ৮০ পৃষ্ঠার আকাবীরদের জীবনী লিখি। হযরত বলতেন, আমি অনুলিখন করতাম। আমার সঙ্গে কাজ করতো হারূন আাযিযী। হযরতের নির্দেশনায় কাজটি করতে পেরে আমিও দারুণ আনন্দিত ছিলাম। হযরত বলতেন, এত কষ্ট করে আকাবীরদের জীবনী লিখছো, আল্লাহ বরকত দেবেন তোমাদের। দশ সালা অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরী হয়ে গেছে। এমন এক সকালে হযরত মঞ্চে উঠলেন। তার পেছনে পেছনে উঠলেন জুনায়েদ বাবুনগরী এবং খিলগাঁও মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা নুরুল ইসলাম। মঞ্চে উঠেই হযরতের চোখে জল নেমে এলো। হয়তো হযরত অস্থির ছিলেন–এতবড় আয়োজন কিভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবেন। তখন জুনায়েদ বাবুনগরী এবং নুরুল ইসলাম সাহেব সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, হযরত! আপনার কোন চিন্তা নেই। আমরা যেহেতু আছি, ইনশাআল্লাহ! সব আয়োজন সব আপ্যায়ন সুন্দরভাবে হবে। ৮. তিনি বলেন, হযরতকে আমি শুরুতেই শাইখ বানাইনি। শুরুতে আমি ছিলাম মুফতিয়ে আযম হযরত মাওলানা ফয়জুল্লাহ সাহেবের কাছে। তিনি ইনতেকাল করার পর যাই হযরত আবদুল কাইয়ুম সাহেবের কাছে। তারপর যাই আবদুল ওয়াহহাব সাহেবের কাছে। তিনি আমাকে বায়াত করেননি। বলেছেন, যিনি মুফতিয়ে আযমের কাছে ছিলেন, তাকে আমার বায়াত করানোর দরকার নেই। তিনি ইনতেকালের পর যাই হযরত মাওলানা হামেদ সাহেব এর কাছে। তিনি যখন অসুস্থ, আমি জিজ্ঞেস করলাম এখন কার কাছে যাবো। হামেদ সাহেব বললেন, আহমদ শফী সাহেব হুজুরের কাছে। আমি আহমদ শফী সাহেব হুজুরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বললাম, হামেদ সাহেব রহ. আমাকে আপনার হাতে বায়াত হতে বলে গিয়েছেন। তখন আহমদ শফী সাহেব হুজুরও আমাকে বায়য়াত করাননি। বরং ছয়টি কাজ দিয়েছেন। ৯. আমি বুখারির সবকে বসে গেলাম। হযরত যখন বুখারির সবক পড়াতে এলেন, আমাকে বললেন, একটি হাদিস পড়ো। আমি হাদিস পড়ার পর তিনি ক্লাসের দেড় হাজার ছাত্রকে সাক্ষী রেখে বললেন, তোমরা সাক্ষী থাকো। আমি তাকে সিহাহ সিত্তা পড়ানোর সনদ দিলাম। আর পাশাপাশি আমি তাকে আমার খেলাফতও দিলাম। হযরতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার কোনো যোগ্যতা বা গুণ আমার ছিলো না। হযরত নিজেই নিজের উদ্যোগে আমাকে তার ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছিলেন। তার বিশেষ কারণ মনে হয় এটা–হজরত বাতিলের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, আমিও কথা বলতাম। এটাই তার দৃষ্টি কেড়েছিল। ১০. আমি ভাবছি, হাটহাজারির সবক ফেলে হযরত আসবেন না হয়তো। আমাকে অবাক করে দিয়ে হযরত এলেন। হাটহাজারীর ১০ টার সবক পড়িয়ে দিলেন ফজরের পর। তারপর ছুটে এলেন আমার মাদরাসায়। মক্তবে সবকের ইফতিতাহ করে যোহরের পর বয়ান করলেন ব্যবসায়ীদের। সেদিন বয়ানে উপস্থিত ছিলে ২৫০ জন ব্যবসায়ী। হযরত খুশি হয়ে বললেন, এত ব্যবসায়ীর মজলিসে আগে কখনো কথা বলিনি। ১১. হেফাজত ট্রাজেডির দু’বছর পর হযরত প্রথম যখন ঢাকায় এলেন, হযরতের সঙ্গে দেখা করার জন্য ফরিদাবাদ মাদরাসায় গেলাম। সঙ্গে মাওলানা মনিরুজ্জামান সাহেব। আমি মাওলানাকে বললাম, হযরত বেফাকের চেয়ারম্যান। এতদিন পর ঢাকায় এলেন আর বেফাকে আসবেন না, তা হতে পারে না। আমি তাকে বেফাকে আসতে দাওয়াত দিব। মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব দেওবন্দ সফরে থাকায় আমি তখন বেফাকের ইনচার্জ মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলাম। ফরিদাবাদ যখন পৌঁছি, আসর হয় হয়। নামাজ পড়ে রুমে এসে দেখি হযরত সাদা গেঞ্জি পড়ে বসে নাস্তা করছেন। তার সামনে দূরত্বে বসে আছে বড় বড় আলেমগণ। কেউ হযরতের সঙ্গে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। নাস্তা শেষ হলে আমি এগিয়ে গিয়ে মুসাফাহা করে বললাম, ‘আমি অমুক, বেফাকের অমুক দায়িত্বে আছি। আপনি তো বেফাকের বাপ। ঢাকা এলেন আর বেফাকে আপনার সন্তানরা কী কাজ করছে, না দেখেই চলে যাবেন? অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও বেফাকে যেতে হবে।’ আমার এমন কথা শুনে সবাই তো কেমন কেমন করছে। না জানি হযরত কী বলবেন। হযরত আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, আমি হযরতের দিকে। এরপর তিনি তার খাদেম শফীকে ডেকে বললেন, ডায়রিতে লিখো আমি বেফাকে যাব। সত্যিই হযরত বেফাকে এলেন, এক ঘণ্টা সময় কাটালেন। একবার বেফাকের একজন দায়িত্বশীল আমাকে দিয়ে হযরতের কাছে কিছু বলাতে চাচ্ছিলেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, তাই। আমি বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম। হযরতকে বললাম, ‘আগের তুলনায় বেফাক ভালো চলছে এখন। আবদুল জব্বার সাহেবের সময় বেফাক পিছিয়ে পড়েছিল।’ এতটুকুই। হযরত কিভাবে যেন বুঝে ফেললেন কথাটা আমার না, পাশে বসে থাকা মাওলানার। হযরত তখন শুধু বললেন, ‘আবদুল জব্বার সাহেব যা করে গেছেন, তার জাযা আল্লাহর নিকট পাবেন। আপনারা তার শুকরিয়া আদায় করুন। গীবত করা জায়েয নেই। আপনাদের কাজটুকু আপনারা করুন।’ [তথ্যঋণ: এহসান সিরাজ ভাইয়ের ধারণকৃত রেকর্ড] লেখক: তরুণ চিন্তক ও লেখক এমএম/ |