ইসলামি ভাবধারার বদরুদ্দীন উমর কীভাবে বামপন্থী হয়ে উঠলেন?
প্রকাশ:
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:৩৬ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
লেখক, গবেষক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর মারা গেছেন। রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। গত দুই মাসে দুই দফায় শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তাকে হাসাপতালে ভর্তি করা হয়েছিল বলে তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সুস্থ হওয়ার পর তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। আগস্ট মাসের শেষ দিকে তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আরেক দফা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। ‘কয়েক দিন আগে তিনি বাসায় ফিরেছিলেন। এরমধ্যেই রোববার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সকাল ১০টার কিছু পরে তিনি মারা যান।’ ২০০৩ সালে তার নিজের হাতে গড়া জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে রাজনৈতিক দলটির সভাপতি ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। ইসলামি ভাবধারা থেকে বামপন্থী রাজনীতি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী ছিলেন তিনি। এক সময় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, লেখক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। তার বাবা আবুল হাশিম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন ছিলেন। ১৯৫০ সালে তারা সপরিবারে ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি অর্জন করেন। বদরুদ্দীন উমরের রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে চিন্তা, আগ্রহ বা দায়বোধ তৈরি হয় মূলত পারিববারিক সূত্রে। তার বাবা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত। বদরুদ্দীন উমর তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শুরুর দিকে তার চিন্তা-ভাবনায় ইসলামি প্রভাব থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সে সময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা এবং জানাশোনা বাড়তে থাকে। তবে, অক্সফোর্ডে পড়তে যাওয়ার পর তার মার্ক্সপন্থী চিন্তা-ভাবনা পূর্ণতা পায়। বদরুদ্দীন উমরের বাবা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। পঞ্চাশের দশকে তার বাবা ঢাকায় 'খেলাফত-ই-রব্বানী পার্টি' নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ইসলামি আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করাই ছিল এ দলের আদর্শ। ২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, জীবনের শুরুর দিকে বাবার প্রভাবে তার মধ্যে 'এক ধরনের ইসলামি চিন্তার আচ্ছন্নতা ছিল'। যে কারণে ভারত থেকে ঢাকায় আসার পরও তিনি তমুদ্দিন মজলিসের সঙ্গে বেশ কিছুদিন সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনীতি ও চিন্তা দেশে ফেরার পর প্রথমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ত্যাগ করে সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যোগ দেন। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, অক্সফোর্ডে আন্তর্জাতিক বামধারার ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পড়াশোনা তার মধ্যে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বোধ তৈরি করে। ‘অক্সফোর্ডে তিনি সেরকম (বামপন্থী) মানুষজনের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, কাজ করেছেন, কথা বলেছেন, গবেষণা করেছেন। তার বিষয় যেহেতু ছিলো রাজনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি -এই বিষয়গুলো নিয়েই তিনি পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে।’ ‘দেশে ফেরার পর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক বোধ বা বুদ্ধিবৃত্তিক যে দায়বোধ সেটা তার মধ্যে শক্তিশালী ছিল।’ বদরুদ্দিন উমর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন কিছুকাল। সেখানে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। এসময় দেশে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বহু লেখা লেখেন। সে লেখাগুলো বাঙালির লড়াই, উপলব্ধি ও আত্ম অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলেই গবেষকরা মনে করেন। তবে শেষপর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বদরুদ্দীন উমর। শিক্ষকতার চাকরি ছাড়েন। বলা যায়, ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি বামধারার রাজনীতিতে চীনাপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হন। চীনাপন্থী বলে পরিচিত সুখেন্দু দস্তিদার, তোয়াহা, আব্দুল হকদের সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরে তিনি আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতায় ফেরেননি। লেখালেখি ও বামপন্থী রাজনীতির চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় একশ এবং সেগুলো উভয় বাংলাতেই সমাদৃত। সংবাদপত্রে দীর্ঘদিন নিয়মিত কলাম লিখেছেন। তিনি শতাধিক বই লিখেছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখা তার তিন খণ্ডের বই 'পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টাকে একটা বিশ্লেষণী কাঠামোর মধ্যে তিনি নিয়ে এসেছিলেন। সে কারণে তার এই গ্রন্থটা ইতিহাসের কারণেও গুরুত্বপূর্ণ, আবার অন্য দিক দিয়ে বিশ্লেষণ পদ্ধতি দেখার জন্য, কীভাবে একটা সময়কে, একটা ঘটনাকে সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষতে বিচার করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে, সেটা পদ্ধতিগতভাবে বোঝার জন্য তার বইটা। মানে শুধু ভাষা আন্দোলন বোঝার জন্য না, গবেষণার ক্ষেত্রে দর্শনগত দিক থেকে কীভাবে একটা ঘটনা দেখা উচিত সেটা বোঝার জন্যও এই বইটা গুরুত্বপূর্ণ।’ বদরুদ্দীন উমর ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটা সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সভাপতির দায়িত্ব নেন। বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে সাংবাদিকতা সূত্রে স্বাধীনতার পর পরিচয় হয় লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের। ১৯৭২ সালে গণকণ্ঠ পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে বদরুদ্দীন উমরের কাছাকাছি এসেছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, গণমানুষের সমসাময়িক আন্দোলনে বদরুদ্দীন উমর অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তার মূল ভূমিকাটি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক। ‘ইউরোপীয় কনসেপ্টে যেটা বলা হয় বা লাতিন আমেরিকায়ও এই জিনিসটা আছে সেটা হচ্ছে, 'অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল'। অর্থাৎ তিনি বুদ্ধিজীবী কিন্তু গণআন্দোলন বিবর্জিত না। তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এবং রাজনীতির যে টানাপোড়েন আছে বা কন্টেম্পোরারি যে মুভমেন্টগুলো আছে সেটাতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তার মূল কাজটি হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ।’ বলেন মহিউদ্দীন আহমদ। বদরুদ্দীন উমরের লেখা তিনটি বই 'সাংস্কৃতিক সংকট', 'সাম্প্রদায়িকতা' এবং 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা' -এই বইগুলো পাক-ভারত উপমহাদেশ বিশেষত: বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বুঝতে পথিকৃৎ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকেই মনে করেন। ‘আমাদের দেশে সেক্যুলার রাজনীতির যে দার্শনিক ভিত্তি বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং ইতিহাস বিষয়ের যে গবেষণা এটা আমি মনে করি সাতচল্লিশ পরবর্তী আমাদের সমাজে তিনি হচ্ছেন পথিকৃৎ। এবং এভাবেই আমরা তাকে মনে রাখবো। তার ওই ধরনের কাজ এরপরে আর কেউ ওই লেভেলে করতে পারেনি।’ বলেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে 'সংস্কৃতি' নামে একটি রাজনৈতিক সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। এছাড়া গণকণ্ঠ ও হলিডে নামে পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। ১৯৭৩ সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের সঙ্গে নীতিগত বিরোধ থাকার কারণে তিনি সেই পুরস্কার গ্রহণ করেননি। চলতি বছর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষিত হলেও তিনি সেটা গ্রহণ করেননি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়ে দেন, ‘এই পুরস্কার গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’ ‘১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটি গ্রহণ করিনি। এখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। এজন্য তাদেরকে ধন্যবাদ। কিন্তু তাদের দেওয়া এই পুরস্কারও গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে লিখেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। সূত্র: বিবিসি বাংলা এমএইচ/ |