মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ.: বিদগ্ধ আলেম, বহুমুখী খেদমত
প্রকাশ:
৩১ জুলাই, ২০২৫, ১১:৫৩ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
ড. মাওলানা ওয়ালীয়ুর রহমান খান হজরতুল আল্লাম মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ.-এর মাগফেরাত ও রফয়ে দারাজাতের জন্য সবার নিকট দুআ চাই। ১৭ বছর আগে আমাদের পিতা আমাদের ছেড়ে মাওলায়ে কারিমের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। মহান আল্লাহ তাঁকে মাগফেরাত ও নিজ রহমতের বারিধারায় স্নাত করুন। আমিন। বিগত শতকে বাংলাদেশের দীনি খেদমতের ময়দানে যে কয়েকজন বিদগ্ধ ও প্রাজ্ঞ আলেম বিশেষ অবদান রেখেছেন, তিনি তাদের মধ্যে একজন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি শায়খুল ইসলাম আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর একান্ত শাগরেদ ও সফরসঙ্গী ছিলেন। এরপর জামিয়া ইমদাদিয়ার উসতায নিযুক্ত হন। প্রথম বছরই তিনি তাফসিরে জালালাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় পাঠদান করেন। এরপর মুহাদ্দিস ও নায়েবে মুহতামিম হিসেবে খেদমত করেন। হজরত আতহার আলী রহ রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তিনি উপমহাদেশের সব খ্যাতিমান ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও অন্যান্য সব দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাহচর্য লাভ করেন। ৬০ থেকে ৮০’র দশকে বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকজন ভালো বক্তা বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় দেশব্যাপী ওয়াজ করতেন, তন্মধ্যে হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ অন্যতম। তাঁর সিয়াসি জিন্দেগির চেয়েও তালিমি ও দাওয়াতি জীবন সমৃদ্ধ। আলহামদুলিল্লাহ, তাদের মত আলেম ও মাশায়েখগণের বয়ান ও মেহনতে গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার মানুষ দীন ঈমান আমল আখলাক ও তাহজিব তামাদ্দুন শিখেছে। হিন্দুপ্রধান কয়েকটি জেলায় শত শত মাদরাসা মক্তব এবং হাজার হাজার আলেম হাফেজ দাঈ তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে বিশুদ্ধভাষী জনপ্রিয় ওয়ায়েজ ছিলেন মুফতী দ্বীন মুহাম্মদ খান রহ., মাওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী রহ., আল্লামা আজিজুল হক রহ., আল্লামা আব্দুল গাফফার রহ., মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ, মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিসবাহ রহ, মাওলানা আব্দুর রহমান জামী, মাওলানা আব্দুল কাদের খুলনা, মাওলানা সুলতান যওক নদভী, মাওলানা জুনায়েদ শওক ও মাওলানা কামালুদ্দীন জাফরী প্রমূখ। শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ -এর পর হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ টানা ৯ বছর বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের নির্বাচিত মহাসচিব ছিলেন। এরপর এমপি হওয়ার কারণে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে মাওলানা আব্দুল জাব্বার রহকে দায়িত্ব প্রদান করেন। তখন রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তিকে বেফাকের কার্যকরী কমিটির কোনো পদে বরণ করা হতো না। পরে এ বিধানটি শিথিল করা এবং অনেকেই সুযোগটি গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁকে তাঁর অধীনস্থ আলেমরা দায়িত্ব দিতে এগিয়ে আসেননি। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে তিলে তিলে এ পর্যায়ে আনার পেছনে প্রথম যুগের আলেমদের মধ্যে তাঁর সাধনা ও শ্রম অনেক। তখন বেফাকের স্বতন্ত্র কোনো অফিস ভবন বা প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা খাদেম কেরানি ছিল না। ফরিদাবাদ মাদরাসার একটি রুমে সভাপতি হাজী মোহাম্মদ ইউনুস, মহাসচিব মাওলানা আতাউর রহমান খান, যুগ্ম সম্পাদকগণ ও দপ্তর সম্পাদক মাওলানা আব্দুল জাব্বার সাহেবসহ সবাই বসে কাজ করতেন। বেতন ভাতা বলতে তেমন কিছু ছিল না। পকেটের টাকা ভেঙে খানা নাস্তা ও যাতায়াত চলতো। আল্লাহ তাদের ত্যাগ ও মেহনতের বিনিময়ে আজ এত কিছু হয়েছে। এরপর প্রায় দশ বছর বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি ছিলেন। জামিয়া আরাবিয়া ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত। ১৯৮৬ সনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রিকশা প্রতীক নিয়ে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে নির্বাচন করেন। বিপুল ভোট পাওয়া সত্ত্বেও স্বৈরাচারী এরশাদ-হাসিনার পাতানো ছকে তাঁকে জাতীয় পার্টিতে যোগদানের শর্তে হারিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে জনগণ আবারও নির্বাচন করার জন্য দাবি করে। তিনি ৯১ এর নির্বাচনে বিএনপি ও ইসলামি দলসমূহের জোট করার জন্য শায়খুল হাদিস রহ., খতিব উবায়দুল হক রহ ও চরমোনাই পীর হজরত ফজলুল করীম রহ. এবং নেযামে ইসলাম পার্টির নেতৃবৃন্দের সাথে বহু বৈঠক ও যোগাযোগ করেন। তিনি তখন বাংলাদেশ নেযামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। কয়েক বছর সহসভাপতি ছিলেন। আলেমদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম হিসেবে আশির দশকে ইত্তেহাদুল উম্মাহ গঠিত হওয়ার সময় শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, বায়তুশ শরফের পীর মাওলানা আবদুল জব্বার, মাওলানা সাঈদী রহ.- এর সঙ্গে তিনিও প্রেসিডিয়াম মেম্বার ছিলেন। হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর নেতৃত্বে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদেরও তিনি কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। দুই মেয়াদে ঐক্যবদ্ধ খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের সদস্য ছিলেন। খতিব উবায়দুল হক রহ.-এর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় শরিয়া কাউন্সিলের তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ.-এর নেতৃত্বে গঠিত ইসলামি আইন বাস্তবায়ন কমিটির তিনি সহসভাপতি ছিলেন। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনের পর দেশ ও জাতির কল্যাণের লক্ষ্যে নির্বাচনটি কী পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা রাজনৈতিক সচেতন মানুষ ব্যতীত বোঝা কঠিন। কিন্তু লীগ তথা ভারতীয় আধিপত্য ফেরানোর জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ ঐক্যের ব্যাপারে কার্যকর কিছু না হওয়ায় তিনি একাই বিএনপির সাথে সমঝোতা করে প্রার্থী হন এবং ডাকসুর জিএস বক্তৃতায় দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু খ্যাত সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর ইমেজ এবং ছাত্র ভক্তদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে ৯১ র নির্বাচনে কিশোরগঞ্জের ৭টি সিটের মধ্যে ৫টিতেই বিএনপি জয়লাভ করে। কিন্তু বিএনপির বাম অংশের মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। এরপর ৯৬, ২০০১, ২০০৮ এর নির্বাচনে ৫টি সিটেই আওয়ামী লিগের প্রার্থী জয়ী হয়। শারীরিক অসুস্থতা ও দুশমনদের সেহেরের কারণে কিছু দিন তিনি রাজনীতি থেকে একটু দূরে অবস্থান করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সময়ে খতিব উবায়দুল হক রহ ও সম্মানিত ইমাম মুআযযিগণের বেতন ভাতা তিনগুণ বৃদ্ধি করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য সরকার হজরত মাওলানা আতাউর রহমান খান, বিচারপতি রুহুল ইসলাম ও ডিজি মোহাম্মদ দাউদুজ্জামান চৌধুরীর সমন্বয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করে। তখন গবেষণা বিভাগ , প্রকাশনা বিভাগ, অনুবাদ সংকলন বিভাগ ও ইসলামি বিশ্বকোষ বিভাগ পূর্ণ যৌবন লাভ করে। হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়। ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি সুচনা করে। কয়েক বছর মিরপুর-৬ দারুল উলূম-এর মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। তিনি বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিজি মিশকাত, জালালাইন ইত্যাদি কিতাবের দরস দিয়েছেন প্রায় ৪০ বছর। ঐতিহাসিক শহীদি মসজিদে তিনি পবিত্র কুরআনের তাফসির পেশ করেছেন একটানা প্রায় ২০ বছর। ঢাকা ও মফস্বলের কিছু মসজিদে সিরাত পাঠ করে শোনাতেন। আল্লাহ ও নবী সা.-এর মহব্বতে তাঁর অন্তর সজীব ছিল। সব সময় জিকির ও দরুদের আমল করতেন। এমপি অবস্থায় মসজিদে এতেকাফ করতেন। মাসিক মুনাদী, নেযামে ইসলাম বার্তা, তাওহীদ সংগঠন বার্তা মাসিক তানজিম বার্তা নামের পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করতেন। বৃহত্তর মোমেনশাহীর আঞ্চলিক মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড তানজিমুল মাদারিসের তিনি প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। ২৪ বছর কিশোরগনজস্থ জামিয়া ইমদাদিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস, নাযিমে তালিমাত ও নায়েবে মুহতামিম ও শহীদী মসজিদের ইমাম ছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামি বিশ্বকোষ ও আল কুরআনুল কারীম সম্পাদনা পরিষদের সদস্য হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ অনেক কাজ করেছেন। বিভিন্ন ময়দানে তাঁর কাজগুলো মহান আল্লাহ কবুল করুন। উত্তম জাযা দিন। আমিন। লেখক: মুহাদ্দিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন; মেজো ছেলে, মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ. এনএইচ/ |