জোনাকির আলো, প্রকৃতির রহস্যময় প্রদীপ
প্রকাশ: ২৪ জুন, ২০২৫, ১২:৪১ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

।। মুহাম্মদ মিজানুর রহমান।।

গ্রামে যারা বেড়ে উঠেছেন রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারে হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে ওঠা ক্ষুদ্র আলো অনেককেই হয়তো মোহিত করেছে অসংখ্যবার। এই আলোর উৎস জোনাকি—একটি সাধারণ পোকা, যার আলো সৃষ্টি করে এক অসাধারণ প্রাকৃতিক বিস্ময়। শহুরে কৃত্রিম আলোর জগতে জোনাকির আলো যেন নিঃশব্দে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বিজ্ঞানের বিস্ময় একসঙ্গে উপহার দেয়।

 কীভাবে জোনাকির আলো জ্বলে

জোনাকির পেটের নিচে একটি বিশেষ অঙ্গ রয়েছে, যাকে বলে ল্যান্টার্ন। এই অঙ্গে লুসিফেরিন নামের এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, লুসিফেরেজ এনজাইম, অক্সিজেন ও ATP (শক্তি উৎপাদনের উৎস) একসঙ্গে বিক্রিয়া করে আলো তৈরি করে। এই আলোকে বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্স। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই আলো প্রায় ৯৫ শতাংশই আলো, মাত্র ৫ শতাংশ তাপ উৎপন্ন করে—যাকে “ঠান্ডা আলো” বলা হয়। এর আলোর রঙ সাধারণত সবুজ বা হলদে-সবুজ।

 আলোর উদ্দেশ্য

জোনাকির এই আলো নিছক সৌন্দর্যের জন্য নয়। সাধারণত প্রজননের উদ্দেশ্যে পুরুষ জোনাকি আলো জ্বালিয়ে স্ত্রী জোনাকিকে আকৃষ্ট করে। অনেক জোনাকি আলো জ্বালে একে অন্যের উপস্থিতি জানাতে। এটাই তাদের যোগাযোগের পদ্ধতি। আত্মরক্ষায়ও অনেক সময় জোনাকি আলো জ্বালে। কিছু জোনাকি তাদের আলো ব্যবহার করে শিকারিকে ভয় দেখায়। জোনাকির প্রজাতিভেদে আলোর ধরণ, জ্বলার সময় ও গতিতে ভিন্নতা দেখা যায়।

জোনাকির অভয়ারণ্য

মেক্সিকোর নানাকামিলপা বন হচ্ছে জোনাকির অভয়ারণ্য। রাত নামলেই হাজার হাজার জোনাকির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে এই বন! জুন থেকে আগস্ট মাসে এই বনজুড়ে দেখা মেলে এক রহস্যময় প্রাকৃতিক দৃশ্য—যেখানে হাজারো জোনাকি তাদের নিজস্ব আলোয় আলোকিত করে তোলে পুরো বন। এজন্যই এই জায়গাটিকে বলা হয় জোনাকির অভয়ারণ্য।

বিজ্ঞানে জোনাকির আলো

জোনাকির আলো আজ বিজ্ঞানের গবেষণায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে। জিন প্রকৌশল, ক্যানসার গবেষণা ও জৈব সেন্সর তৈরিতে লুসিফেরিন-লুসিফেরেজ প্রতিক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে কাজ চলছে।

হুমকির মুখে জোনাকি

অতিরিক্ত কৃত্রিম আলো, কীটনাশক, বন উজাড় ও দূষণের কারণে জোনাকির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর ফলে আমরা হারাতে বসেছি একটি প্রাকৃতিক জৈব-আলোক উৎস, যা শুধুই রোমান্টিক নয়, পরিবেশের স্বাস্থ্য নির্দেশকও।

জোনাকির আলো প্রাকৃতিক জগতের এক নিঃশব্দ বিস্ময়, যা আমাদের শেখায়—ছোট কিছুর মাঝেও বিশাল বৈজ্ঞানিক রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে। এই আলোকে শুধু উপভোগ নয়, সংরক্ষণ করাও আমাদের দায়িত্ব। কারণ প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র দীপশিখা হারিয়ে গেলে অন্ধকার শুধু রাতে নয়, জ্ঞানের আলোয়ও পড়বে ছায়া।

এনএইচ/