দাদা হুজুর: একজন প্রচারবিমুখ নীরব সাধকের গল্প
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ০৩:২৪ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

|| মুফতি মোস্তফা ওয়াদুদ কাসেমী ||

দেশের ঐতিহ্যবাহী দীনি মারকায জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় যারা শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, বিশেষ করে আরবি ভাষার বিশুদ্ধ উচ্চারণ, মনোমুগ্ধকর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ লাহজা এবং হৃদয়গ্রাহী বাচনভঙ্গিতে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন— তাঁদের অনেকেই ঋণী এই নীরব সাধকের প্রতি। তিনি আমাদের প্রিয় ‘দাদা হুজুর’আল্লামা আবুল হাসান মুহাম্মদ আলাউদ্দীন কাসেমী (দা.বা.), যিনি নিজেই শুদ্ধতার এক জীবন্ত প্রতীক। 

তাঁর ভাষায়, চিন্তায়, জীবনযাত্রায়— প্রত্যেকটি পরতে পরতে শুদ্ধতা ও আভিজাত্যের দীপ্তি ফুটে ওঠে। যিনি এই প্রতিষ্ঠানের একজন প্রাণপুরুষ। তিনি এমন একজন গুণী আলেম, যাঁর উচ্চারণে শুদ্ধতা, কণ্ঠে আরবীয় আবেশ, বাক্যবিন্যাসে সাহিত্যিক মুন্সিয়ানা— সবমিলিয়ে তিনি যেন এক জীবন্ত অভিধান, এক চলমান আদর্শ।

জন্ম ও শৈশব

১৯৫৪ সালের ১৬ই নভেম্বর, নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার এক সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই নম্রতা, বিনয় ও আত্মসংযম ছিল তাঁর সহজাত। পরিবারে দীনদারির যে আলো বিকশিত ছিল, তারই ছায়ায় বেড়ে ওঠেন তিনি। শৈশবেই তাঁর মধ্যে ইলমে দীনের প্রতি অনুরাগ ও আদব-আখলাকের প্রতি গভীর অনুরক্তি পরিলক্ষিত হয়।

শিক্ষাজীবন

আবুল হাসান মুহাম্মদ আলাউদ্দীন ছাত্রজীবন থেকেই একজন অসামান্য মেধাবী ও দুর্দান্ত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। কঠোর পরিশ্রম ও নিরলস সাধনা যেন তাঁর স্বভাবজাত গুণ ছিল। তাঁর প্রাথমিক ইলমী সফর শুরু হয় নারায়ণগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর কাসেমিয়া বাইতুল উলূম মাদরাসা থেকে। সেখানে তিনি মাত্র আট মাসে নাজেরা এবং পাঁচ মাস বারো দিনে সম্পূর্ণ কুরআনুল কারীম হিফজ সম্পন্ন করে এক বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। কুরআনের হিফজ সম্পন্ন করার পর তিনি বিখ্যাত কাতেব ও কুরআনের প্রচলিত হিফজ নুসখার লিপিকার, মাওলানা গরীবুল্লাহ মাসরুর ইসলামাবাদী রহ.-এর নিকট হস্তলিপির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

এরপর তিনি চলে যান ফরিদপুরের গওহারডাঙ্গা মাদরাসায়, সেখানে প্রাথমিক কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। সে সময় পরীক্ষায় ৫০ নম্বরের প্রচলন ছিল। ইবতেদায়ী জামাতের একজন উস্তাদ মাওলানা শফী সাহেব, এক পরীক্ষায় তাঁকে ৫০ নম্বরে ৫৩ নম্বর দেন। এরপর মন্তব্য করেন— “এ ছাত্রকে ২০৫ নম্বর দিলেও কম হবে!”

গওহারডাঙ্গা মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি পাড়ি জমান পাকিস্তানের করাচি শহরের জামিয়া বিন্নূরী টাউন-এ, যা সে দেশের জাতীয় পর্যায়ের বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত। সেখানে তিনি উর্দু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং মাধ্যমিক স্তর (কানযুদ দাকায়েক) পর্যন্ত পাঠ শেষ করেন।

এই সময়েই পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি তখনও বিন্নূরী টাউনে অবস্থান করছিলেন। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ১৯ দিন আগে তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন।

দেশে ফিরে তিনি প্রথমে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় যান। পরে আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রহ.-এর এক ভাইয়ের মাধ্যমে তিনি চলে যান হবিগঞ্জের উমেদনগর মাদরাসায়। সেখানে ভর্তি হয়ে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং পাশাপাশি নিচের শ্রেণির ছাত্রদেরও দরস দিতেন।

হবিগঞ্জে অবস্থানকালে তিনি হবিগঞ্জ সদর কোর্ট মসজিদে পবিত্র রমজান মাসে খতমে তারাবির ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় মসজিদটির মুতাওয়াল্লী, তৎকালীন পুলিশের ডিআইজি সাহেবের বাসায় তিনি জায়গীর হিসেবে অবস্থান করতেন।

দারুল উলূম দেওবন্দে গমন

বাংলাদেশ সৃষ্টির অল্প কিছুদিন পরই উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার অভিলাষে মাওলানা আবুল হাসান মুহাম্মদ আলাউদ্দীন পাড়ি জমান উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ, মাদারে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দে। সেখানে তিনি দীর্ঘ ছয় বছর অধ্যয়ন করেন অত্যন্ত মনোযোগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে। এই সময়েই তিনি তাকমীলে হাদীস সম্পন্ন করেন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে থাকাকালেই আল্লামা কাসেমী রহ. এর তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।

দেওবন্দে অবস্থানকালে তিনি সমসাময়িক বিশ্বসেরা আদীব, প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ও যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের সাহচর্য লাভ করেন, যা তাঁর জ্ঞানের দিগন্তকে করে তোলে আরও বিস্তৃত ও আলোকোজ্জ্বল।

মদিনা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন

মাওলানা আবুল হাসান আলাউদ্দীনের জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল প্রবল ও অন্তহীন। এ তৃষ্ণা নিবারণের আকাঙ্ক্ষায় তিনি প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র ভূমি মদীনাতুল মুনাওরায় যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। কীভাবে মদিনা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া যায়, কী প্রক্রিয়ায় আবেদন করতে হয়— সকল নিয়ম-বিধি অনুসন্ধান করে মদিনা ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করেন।

আবেদনের কিছুদিন পরই তিনি উমরার সফরে মক্কায় যান। সেখানে অবস্থানকালে তাঁর পিতা এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন, মদিনা ইউনিভার্সিটিতে তাঁর আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দেখা করেন তৎকালীন প্রিন্সিপাল সাহেবের সঙ্গে।

তবে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। প্রিন্সিপাল জানান, “তুমি যে ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে এসেছো, সেটা দিয়ে মদিনা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়। তোমাকে অন্য কোনো দেশে গিয়ে ভিসা নবায়ন করতে হবে এবং মদিনা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে একটি দরখাস্ত লিখতে হবে।”

এই কথা শুনে মাওলানা আলাউদ্দীন সৌদি সীমান্তসংলগ্ন জর্ডানে যান এবং সেখানে গিয়ে ভিসা নবায়ন করেন। ফিরে এসে ইউনিভার্সিটির প্রিন্সিপাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন—

“দরখাস্তটি কি নজমে (কবিতায়) লিখবো, নাকি নছরে (গদ্যে)?”

এই প্রশ্ন শুনে প্রিন্সিপাল সাহেব বিস্মিত হয়ে হাসিমুখে বলেন,

“তোমার যেটা সুবিধা মনে হয়, সেটাতেই লেখো!”

অবশেষে তিনি মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কুল্লিয়াতুল লুগাহ আল-আরাবিয়্যাহ’ বিভাগে ভর্তি হন এবং সেখানে চার বছরব্যাপী আরবি ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।

উস্তাদবৃন্দ

দারুল উলূম দেওবন্দে পড়াকালীন যুগশ্রেষ্ঠ আসাতিযায়ে কেরামের কাছে দরস নেন তিনি। তাঁর উস্তাদদের মধ্যে অন্যতম হলেন, আল্লামা শরীফুল হাসান রহ., শায়খুল আদব আল্লামা ওয়াহীদুজ্জামান কিরানভী রহ., আল্লামা রিয়াসাত আলী বিজনুরী রহ., আল্লামা নাসীর খান রহ., আল্লামা কামরুদ্দীন সাহেব দা. বা., আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.। মদিনা ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে মিশরীয়, সিরিয়ান, সুদানী ও আফ্রিকান শায়খদের কাছে ইলমে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন প্রচারবিমুখ এ আলেম।

কর্মজীবন ও খেদমত

মাওলানা আবুল হাসান মুহাম্মদ আলাউদ্দীন কাসেমী হাফিজাহুল্লাহর কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফরিদাবাদ জামিয়া থেকে। সে সময় এই প্রতিষ্ঠান ছিল দেশের অন্যতম সেরা ও আলোকিত মাদরাসা, যেখানে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন রাহবারে মিল্লাত আল্লামা নূর হোছাইন কাসেমী রহ.-সহ দেশসেরা অনেক মনীষী।

ফরিদাবাদ মাদরাসায় শিক্ষকতার সময় আল্লামা কাসেমী রহ.-এর সঙ্গে তাঁর পূর্ববর্তী দেওবন্দের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক আরও গভীর ও ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়।

আরব শায়খ কর্তৃক সৌদি আরবে যাওয়ার আমন্ত্রণ

কিছুদিন ফরিদাবাদে খেদমত করার পর, আরবের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী শায়খ আব্বাস—এর আহ্বানে তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমান। সেখানে শায়খের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি আরবদের সঙ্গে গভীর সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর আরবি ভাষার উৎকৃষ্ট উচ্চারণ ও প্রকৃত আরব লাহজায় কথা বলার ক্ষমতা আরবদেরও বিস্মিত করত। সৌদি আরবে সফলভাবে কিছু সময় কাটানোর পর তিনি ফের মাতৃভূমি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় যোগদান

দেশে ফিরে আসার পর একদিন তিনি জাতীয় সংসদের এমপি হোস্টেলে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস রহ.-এর সঙ্গে। সে সময় মুফতি ওয়াক্কাস সাহেব তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য ছিলেন। 

এই সাক্ষাতে উপস্থিত ছিলেন ‘আল্লামা নূর হোছাইন কাসেমী রহ.’ও। দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়ায় পুরনো স্মৃতিচারণে উভয়ের মাঝে হৃদয়গ্রাহী মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। আল্লামা কাসেমী রহ. আগে থেকেই তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এইবার সে ভালোবাসার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। 

এ সময় আল্লামা কাসেমী রহ. জানতে চান: ‘‘আপনি এখন কী করবেন? আবার বিদেশে যাবেন, নাকি দেশেই থাকবেন?’’

মাওলানা আলাউদ্দীন কাসেমী হাফি. দেশেই থাকার আগ্রহ প্রকাশ করলে, আল্লামা কাসেমী রহ. তাঁকে সঙ্গে করেই বারিধারা জামিয়ায় নিয়ে আসেন এবং বলেন, “আপনি আগামীকাল থেকে বারিধারাতে ইনশাআল্লাহ দরস দিবেন।”

এরপর তিনি ইলমে হাদীসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কিতাব, তিরমিজি শরীফের মাধ্যমে বারিধারায় শিক্ষকতা জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেন।

তিনি ২০০১-২০০২ শিক্ষাবর্ষে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠা, মনোযোগ ও আন্তরিকতার সঙ্গে এ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে চলেছেন।

আরবি সাহিত্য ও দাদা হুজুর

আরবি সাহিত্য ও আল্লামা আলাউদ্দীন কাসেমী— যেন একই সূত্রে গাঁথা দুটি নাম। সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রেম শৈশব থেকেই। আরব জাহানের খ্যাতনামা ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যে তিনি সাহিত্যের মণিমুক্তা অর্জন করেন। আধুনিক আরবিতে তাঁর দখল অভাবনীয়। বারিধারা জামিয়ায় দীর্ঘদিন তিনি ‘কিসমুল আদাবীল আরাবী’র প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. এর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক

১৯৭৪ সালে, দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে আল্লামা আবুল হাসান মুহাম্মদ আলাউদ্দীন হাফিজাহুল্লাহ-র প্রথম সাক্ষাৎ হয় আল্লামা নূর হোছাইন কাসেমী রহ.-এর সঙ্গে। সে সময় দেওবন্দের মশহুর শায়খ আল্লামা আব্দুল আহাদ সাহেব রহ. আল্লামা কাসেমী রহ. কে বেড়ীজাতপুরে খেদমতের উদ্দেশ্যে পাঠান। ঐ মজলিসে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আবুল হাসানও।

হাদীসের তবকাহ অনুসারে, আল্লামা কাসেমী রহ. ছিলেন মাওলানা আবুল হাসান সাহেবের এক ধাপ উপরের স্তরের ছাত্র। তবুও তাঁদের মধ্যে ছিলো গভীর মুহাব্বত ও হৃদ্যতা। দেওবন্দে অবস্থানকালে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিলো মিছালের মতো মিলদার ও আন্তরিক।

পরবর্তী সময়ে যদিও দুজন আলাদা হয়ে যান, কিছুদিন পর ফরিদাবাদ জামিয়ায় পুনরায় একত্রিত হন। পরে আল্লামা কাসেমী রহ. মালিবাগে চলে গেলে মাওলানা আবুল হাসান কাসেমী হাফি. বিদেশে পাড়ি জমান।

দীর্ঘকাল পর পুনরায় সাক্ষাতে, আল্লামা কাসেমী রহ. তাঁকে গভীর ভালোবাসা ও সম্মানের সঙ্গে আপনজনের কাতারে স্থান দেন। মাদরাসার গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ, দায়িত্বশীল পদ এবং বিভিন্ন দীনী খেদমতে তাঁকে যুক্ত করেন— যা তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

হজরত ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেবের খেলাফত লাভ

দারুল উলূম দেওবন্দে থাকাকালীন হযরত মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ.-এর কাছে বায়আত হন মাওলানা আবুল হাসান আলাউদ্দীন হাফি.। ঐ সময়ে গাঙ্গুহী রহ.-এর খাদেম ছিলেন হজরত মাওলানা ইব্রাহিম আফ্রিকী দামাত বারাকাতুহুম।

গাঙ্গুহী রহ.-এর ইন্তেকালের পর মাওলানা আবুল হাসান আলাউদ্দীন সাহেব তাঁর খাদেম ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেবের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় সফরে গিয়ে হযরতের খেদমতে নিয়োজিত থাকেন। এ সময়ে তাঁর ইখলাস, মুজাহাদা এবং রুহানিয়াতের গভীরতা তাঁকে তাসাউউফের পথে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

পরবর্তীতে হযরত ইব্রাহিম আফ্রিকী সাহেব বাংলাদেশ সফরে এলে, মাওলানা আবুল হাসান আলাউদ্দীন হাফি.-কে আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাফত প্রদান করেন।

বারিধারায় শায়খুল হাদীস হিসেবে যোগদান

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা আজ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম। বর্তমান ১৪৪৬-৪৭ হি./২০২৫-২৬ ঈসায়ী শিক্ষাবর্ষে জামিয়ার পরিচালনা পর্ষদ মাওলানা আবুল হাসান মুহাম্মদ আলাউদ্দীন কাসেমী হাফিজাহুল্লাহকে বারিধারার প্রধান শায়খুল হাদীসের দায়িত্বভার গ্রহণের আবেদন করলে তিনি তাতে সম্মত হন।

তাঁর দরসে শিক্ষার্থীরা শুধু হাদীসের ইবারতই নয়, বরং হাদীসের গভীর তাৎপর্য, আদব, আখলাক, তাকওয়া ও রুহানিয়াতের শিক্ষা লাভ করে। তিনি তৈরি করছেন এমন সব আলেম, যারা কেবল জ্ঞানধারক নন, বরং নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও আদর্শিকভাবে পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বৈশিষ্ট

আল্লামা আলাউদ্দীন কাসেমী হাফিজাহুল্লাহ এক নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ, আত্মমগ্ন আলেম। খ্যাতির পেছনে নয়, বরং ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতের পথে নিরব সাধনায় নিয়োজিত থেকেছেন আজীবন। তাঁর ইলম, তাকওয়া ও আখলাকের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী, উস্তাদ, বুযুর্গ ও সাধারণ মানুষের অন্তরে।

সামাজিক প্রভাব

দেশ-বিদেশের বহু মাদরাসা, খানকা ও দীনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁর অসংখ্য ছাত্র বর্তমানে ইলমে দীনের খেদমতে নিয়োজিত আছেন।

উপসংহার

আল্লামা আবুল হাসান মুহাম্মদ আলাউদ্দীন কাসেমী হাফিজাহুল্লাহ একজন আদর্শ আলেম। যিনি ইলম, আদব ও তাকওয়ার এক অপূর্ব প্রতীক। আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতার দীপ্ত আলোকবর্তিকা। আজকের যুগে এমন নীরব দীপ্তিমান ব্যক্তিত্ব আমাদের জন্য পরম প্রেরণা। আল্লাহ তাআলা তাঁর হায়াতে বরকত দান করুন, তাঁর তাকরীরকে দীনের খেদমতে কবুল করুন। আমীন।

লেখক: মাদরাসা শিক্ষক ও সাংবাদিকে

এমএইচ/