শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪ ।। ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ৯ রবিউস সানি ১৪৪৬


কওমি শিক্ষার্থীদের প্রতি সকল বৈষম্যের অবসান হোক: সেমিনারে বক্তারা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
বৈষম্য নিরসনে কওমি সনদের যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়নের দাবিতে জাতীয় সেমিনার

দেশের ঐতিহ্যবাহী অন্যতম শিক্ষাধারা কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বরাবরই বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকার পরও রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিতই থেকেছে সবসময়। সর্বশেষ বিগত সরকারের আমলে কওমি মাদরাসার তাকমীল তথা দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্স সমমান দিয়ে গেজেট পাশ করা হলেও এর আইনী ও নৈতিক দিকগুলো একদমই অস্পষ্ট। যার ফলশ্রুতিতে সনদের স্বীকৃতি আসলেও এর যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন এখনও পর্যন্ত অধরাই থেকে গেছে।

আজ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ইং বৃহস্পতিবার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ সভাপতি মাওলানা নূরুল হুদা ফয়েজীর সভাপতিত্বে আয়োজিত “বৈষম্য নিরসনে কওমি সনদের যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়নের দাবিতে জাতীয় সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সেমিনারে উপস্থিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম শায়েখে চরমোনাই বলেন, সনদের স্বীকৃতি এটা কোন অনুকম্পা নয়; এটা কওমী শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার। তাই এর যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন রাষ্ট্রকেই করতে হবে।

বক্তারা আরও বলেন, কওমি মাদরাসার বিশেষ স্বকীয়তা আছে, নিজস্বতা আছে। তাই সনদের বাস্তবায়ন হতে হবে কওমির মৌলিকত্ব ও এর ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে আপন জায়গায় ঠিক রেখে। তারা বলেন, সনদের বাস্তবায়ন বলতে আমরা চাচ্ছি এতটুকু সুযোগ, যাতে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের মেধাকে মেলে ধরার সুযোগ পায়। উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলোতে এবং যে কোন প্রতিযোগিতায় বাধাহীনভাবে যেন তারা অংশগ্রহণ করতে পারে। তাদেরকে যেন সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করার সুযোগ কেউ না পায়। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়াও কওমি শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে কষ্টসাধ্য করে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে, সুযোগ পেলে যা আরও বহুগুণে ত্বরান্বিত হবে। দেশ ও জাতি তাদের দ্বারা আরও বেশি উপকৃত হবে।

সেমিনারে আারও বক্তব্য রাখেন শাইখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, নারায়ণগঞ্জ ডিআইটি মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুল আউয়াল, জামিয়াতুস-সুন্নাহ‘র পরিচালক মাওলানা নিয়ামতুল্লাহ ফারিদী, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী, জামিয়া নূরিয়া কামরাঙ্গীরচরের মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এর যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লা আমিন, মুফতি মুশতাকুন্নবী কুমিল্লা, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মাওলানা হাসান জামিল, বিশিষ্ট দায়ী মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আল মোবারক, মুফতি হেমায়েতুল্লাহ কাসেমী, মুফতি আব্দুর রাজ্জাক কাসেমী মুফতি ইমাদ উদ্দিন, মাওলানা তাজ উদ্দিন হামিদী, মুফতি লুৎফর রহমান ফরায়েজী, মুফতি মাহমুদ মাদানী, মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক, মুফতি আব্দুল্লাহ ইয়াহিয়া, মাওলানা এনামুল হক মুসা, মাওলানা আতাউল করিম মাসুদ, মুফতি আবু মোহাম্মদ রাহমানী, মুফতি আম্মার হোসাইন, মাওলানা ইউনুস ঢালী, মুফতি তাজুল ইসলাম মোমেনশাহী, মুফতি সাকিবুল ইসলাম কাসেমী, মাওলানা কাজী ইয়াকুব আত-তাকওয়া ফাউন্ডেশন, মুফতি মোহাম্মদ আলী, মুফতি আমিমুল এহসান, আল-মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ এর মাওলানা হামজা বিন শহিদুল ইসলাম প্রমুখ।

সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করেন বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ মুফতি আবদুল্লাহ মাসুম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন মুফতি রেজাউল করীম আবরার, মফতি ইসমাইল সিরাজী আল-মাদানী, মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফী, মুফতি আবদুল আজীজ কাসেমী, মাওলানা নূরুল করীম আকরাম।

সেমিনারে ১০ দফা প্রস্তাবনা এবং ০২ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়:

স্বীকৃতির মানোন্নয়ন বিষয়ক প্রস্তাবনা: ১. কওমি মাদরাসা সমূহের সনদ ইস্যু, স্বীকৃতি ও মানোন্নয়নের জন্য অনতিবিলম্বে আল-হাইআতুল উলয়ার অধীনে 'ইউজিসি'র অনুমোদনক্রমে কওমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (ঘধঃরড়হধষ ছধসির টহরাবৎংরঃু-ঘছট) প্রতিষ্ঠা করা হবে। ২. দাওরায়ে হাদিস বা তাকমীলের উক্ত সনদ ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিষয়ে 'কওমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়' থেকে প্রদান করা হবে। ৩. তাকমীলের প্রয়োজনীয় শিক্ষাক্রম তৈরি, সিলেবাস পূণর্গঠন, পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়ন সার্বিক বিষয় কওমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হবে। ৪. শুধু দাওরায়ে হাদিস নয়, বরং কওমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক হিসেবে ফযিলতের স্বতন্ত্র স্বীকৃতিও প্রদান করা হবে। ৫. নাহবেমীর জামাতকে এসসএসসি, কাফিয়া জামাতকে এইচএসসি মানের স্বীকৃতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষার অধীনে প্রদান করা হবে। এর জন্য একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে। যার মাঝে বিদ্যমান সিলেবাস ৮০% বহাল থাকবে। বাকি ২০% হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক বাংলা, ইংরেজী ও অংক যুক্ত হবে। উক্ত শিক্ষাক্রম তৈরির জন্য পূর্বোক্ত জাতীয় কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশন সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার দু'জন প্রতিনিধি থাকবেন। যারা কেবল বাংলা, ইংরেজী ও অংক বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে মানোন্নয়নের পরামর্শ প্রদান করবেন। মাদরাসার অন্যান্য সিলেবাস বিষয়ে তাদের ভোটাধিকার থাকবে না। উক্ত দুটি ক্লাসের পরীক্ষা কওমি মাদরাসার সকল বোর্ড স্বতন্ত্রভাবে এখন যেভাবে নিচ্ছে, সেভাবে নিতে পারবে। তবে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম অনুসরণ করতে হবে। পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন ও সনদ ইস্যুর জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হবে। এতে প্রত্যেক মাদরাসা বোর্ডের একজন প্রতিনিধি এবং পদাধিকার বলে জাতীয় কওমি বিশ্ববিদ্যালয়র মঞ্জুরী কমিশনের প্রধান ও সহকারী প্রধান সদস্য হিসেবে থাকবেন। সাথে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার দু'জন প্রতিনিধিও থাকবেন। জাতীয় কওমি বিশ্ববিদ্যালয়র মঞ্জুরী কমিশনের প্রধান পদাধিকার বলে কমিটির প্রধান নির্বাচিত হবেন। ৬. সকল তাখাসসুস (অন্তত দুই বছর মেয়াদী)-কে নিজ নিজ সাবজেক্টে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা হিসেবে জাতীয় কওমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বীকৃতি ও সনদ প্রদান করা হবে। এর জন্য জাতীয় কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্ববধানে একটি শিক্ষাক্রম তৈরি করা হবে। এতে ৮০% থাকবে বিদ্যমান সিলেবাস। বাকি ২০% থাকবে সংশ্লিষ্ট সাবজেক্টের উপর স্বীকৃত রিসার্চ মেথডোলজি অনুসারে প্রস্তুতকৃত একটি রিসার্চ পেপার। যার শব্দ সংখ্যা হবে ৩০০০ থেকে ৪০০০ শব্দ। প্রত্যেক মাদরাসা উক্ত শিক্ষাক্রম অনুসারে পরীক্ষা ও রিসার্চ পেপার গ্রহণ করবে। সিলেবাস বিষয়ে প্রস্তাবনা: ৭. দাওরায়ে হাদিসের জন্য জাতীয় কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্ববধানে একটি শিক্ষাক্রম এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেখানে বিদ্যমান সিলেবাস ৯০% বহাল থাকবে। পঠিত বিষয়ের সাথে সমন্বয় করে ১০% নতুন করে যুক্ত হবে। সেই ১০% এর একটি অন্যতম সংযোজন হবে হাদিস বা ফিকহ বিষয়ে একটি অ্যাসাইনম্যান্ট পত্র তৈরি করে জমা দেয়া। এর শব্দ সংখ্যা ২০০০ থেকে ৩০০০ এর মধ্যে হবে। ৮. ফযিলত স্তরের জন্য ইসলামী ভ্রান্ত মতবাদ বিষয়ক একটি প্রেজেন্টেশন সিলেবাসে যুক্ত থাকবে। এর জন্য তাকমিলের মতো একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম তৈরি করা হবে, যার মাঝে ৯৫% থাকবে বিদ্যমান সিলেবাস। শুধু ৫% যুক্ত হবে প্রেজেন্টেশন এর মাধ্যমে। ৯. এছাড়া নাহবেমীর ও কাফিয়া জামাতসমূহে বাংলা, ইংরেজি ও অংকের প্রাথমিক পাঠদানের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। উচ্চ শিক্ষা: ১০. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডাবল মাস্টার্স এবং পিএইচডি করার সুযোগ প্রদান করা হবে। কর্মস্থল: ১১. সরকারী বা বেসরকারী চাকরিতে উক্ত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত যেসব পদ রেয়েছে, যেমন: সরকারী মসজিদে ইমাম-খতিব, কাযি পদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ- বিজিবিসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষক পদ ইত্যাদি, এগুলোতেও উক্ত সনদকে গ্রহণ করা হবে। বিবিধ: ১২. যারা বিগত সময়ে উক্ত প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের আগে দাওরায়ে হাদিস বা তাকমীলে পাশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদেরকে পূর্বোক্ত প্রস্তাবনা অনুসারে অ্যাসাইনম্যান্ট পত্র লেখার শর্তে কওমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই মানের মাস্টার্স এর সনদ প্রদান করা হবে। ১৩. যারা ইতোমধ্যে তাখাসসুস সম্পন্ন করেছেন, তারা পূর্বোক্ত প্রস্তাবনা অনুসারে নির্ধারিত রিসার্চ পেপার জমা দেয়ার শর্তে কওমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সংশ্লিষ্ট সনদ প্রদান করা হবে।

কর্মসূচি : এক. ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ অক্টোবর’২৪ পর্যন্ত দেশব্যাপী জেলা পর্যায়ে উক্ত দাবী বাস্তবায়নে সেমিনার ও শিক্ষা অফিসার বরাবর স্মারকলিপি পেশ। দুই. অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় জাতীয় সমাবেশ।

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ