ইসলামপন্থীদের ‘একবাক্স নীতি’ কি মুখ থুবড়ে পড়ছে?
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১০:০৭ রাত
নিউজ ডেস্ক

বিশেষ প্রতিনিধি

ইসলামি ও সমমনা দলগুলো একসঙ্গে নির্বাচনে লড়বে- এমন একটি আলোচনা গত কয়েক মাস ধরেই চলছে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দল এই লক্ষ্য সামনে রেখে একসঙ্গে পথচলাও শুরু করেছে। রাজপথে আন্দোলন, বিভাগীয় সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে একমঞ্চে জড়ো হয়েছেন দলগুলোর নেতারা। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসেছেন দফায় দফায়। দৃশ্যগুলো দেখতে বেশ সুন্দর ছিল। দেশের ইসলামপ্রিয় মানুষ এই দৃশ্য দেখে অনেকটা আশায় বুকও বেঁধেছিল।

তবে নির্বাচনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার শেষ মুহূর্তে এসে সেই ঐক্যে অনেকটা চিড় ধরেছে। কোটি মানুষের কাঙ্ক্ষিত ‘একবাক্স নীতি’ মুখ থুবড়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইসলামপন্থীদের ভোট একবাক্সে আর পড়ার সুযোগ থাকছে না বলেই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও অনেকে এখনো আশায় বুক বাঁধছেন। তারা বলছেন, যেকোনো মূল্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে এবং একবাক্স নীতির ওপর সবাইকে অটল থাকতে হবে।

আট দলের আসন সমঝোতার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। শিগগির আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হবে এমনটা জানানো হয়েছে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে। তবে শেষ খবর হলো, আট দলের মধ্যে অন্তত দুটি দল সেই সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দল দুটি হলো- পীর সাহেব চরমোনাইয়ের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। আট দলের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা দল দুটি এই সমঝোতা থেকে বেরিয়ে গেলে উদ্যোগটি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

কে কত আসনে লড়বে এটা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। এর মধ্যেই খবর আসে, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে জামায়াত। এনসিপি শেষ পর্যন্ত জামায়াত জোটে আসছে এবং দলটিকে ৩০টি আসনে ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে জামায়াত সম্মত হয়েছে। খবরটি গণমাধ্যমে আসার পরই মূলত ক্ষেপেছেন ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতারা। তারা বলছেন, আট দলের আলোচনা চলছে সম্মিলিতভাবে। এখানে নতুন করে কোনো দল যুক্ত হওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আছে। এর মধ্যে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা না করে এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের এই আলোচনা সন্দেহজনক। তাহলে কি তারা আট দলকে এড়িয়ে যাচ্ছে?

এই ঐক্যকে জোট বলতে অনীহা রয়েছে বেশির ভাগ নেতার। কারণ জামায়াতের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে বিরোধ পুরনো। এজন্য তারা এটাকে নির্বাচনি সমঝোতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে যেহেতু এখানে জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিক বিচারে সবার চেয়ে এগিয়ে এজন্য গণমাধ্যমসহ অনেকেই এটাকে জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট হিসেবেই আখ্যায়িত করে থাকেন। আর অন্য দলগুলো কতটি আসনে ছাড় পাবে সেটার আলোচনা জামায়াতের সঙ্গেই হচ্ছে। তবে ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ অন্য দলগুলো যে কয়টি আসন দাবি করছে, তাতে জামায়াতের জন্য তেমন কোনো আসনই থাকে না। অথচ অনেক জায়গায় অন্য দলগুলোর তেমন শক্তিমত্তা নেই। এখানেই জামায়াতের আপত্তি। দলটি বলছে, বিজয়ী হয়ে আসার মতো সক্ষমতা থাকলে আমাদের আসন ছাড়তে বাধা নেই। তবে দুর্বল প্রার্থীকে আসন ছাড়লে সেটা হারানোর শঙ্কাই বেশি।

সূত্রে জানা গেছে, পীর সাহেব চরমোনাইয়ের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন শতাধিক আসন দাবি করছে। আর মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চাচ্ছে ২৫ থেকে ৩০টি আসন। খেলাফত মজলিসের অপর অংশও বেশ কিছু আসন চাইছে। এভাবে সবার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে জামায়াতের তেমন কোনো আসনই থাকে না। এজন্য জামায়াত বিকল্প ভাবছে এবং এনসিপিকে কাছে টানছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি আট দলের একবাক্স নীতি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়নি, তবে অন্যদের অনেকটা এড়িয়ে যাচ্ছে।

এদিকে জামায়াতের এই হঠকারী সিদ্ধান্তে ক্ষেপেছে অন্য দলগুলো। বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নেতাকর্মীদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামায়াতকে ইঙ্গিত করে সমালোচনা করছেন। আট দলের আসন সমঝোতার আলোচনার মধ্যেই আগামী ৯ জানুয়ারি রাজধানীতে এককভাবে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। অন্যদিকে মাওলানা মামুনুল হক দলের জরুরি শুরা অধিবেশন ডেকে নেতাদের বলেছেন, কারো অনুকম্পায় নয়; সংগঠনের নিজস্ব ভোটে আমাদের নিজেদের ফসল ঘরে তুলতে হবে। এসব দ্বারা এটা স্পষ্ট হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত আট দলের উদ্যোগ আলোর মুখ নাও দেখতে পারে। এতে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বহুল কাঙ্ক্ষিত ‘একবাক্স’ নীতি।

তবে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ‘একবাক্স নীতি’ থেকে সরে দাঁড়ায়নি দলগুলো। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, আসন সমঝোতার বিষয় নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে। এনসিপিকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। আরও কিছু দল আসতে চাচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য একটু সময় লাগছে।

আর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, প্রত্যেকটা দলের আসন সংখ্যার চাওয়া-পাওয়ার সমাধান করা নিয়ে দেরি হচ্ছে। আমরা চাই সুষ্ঠু ও সম্মানজনক একটা সমাধান হোক। দুই-একদিনের মধ্যে এ নিয়ে শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হবে।

ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা এবং ঢাকা-৯ আসনের প্রার্থী শাহ ইফতিখার তারিক আওয়ার ইসলামকে আসন সমঝোতা প্রসঙ্গে বলেন, এ ব্যাপারে খবর দেওয়ার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। হলে আপনারা জানতেন। এখনো আলোচনা চলছে। আমরা আমাদের আগের অবস্থানেই আছি।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঐক্য প্রক্রিয়া ভেঙে যাওয়া প্রসঙ্গে খবরের ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, অনেকে অনেক উদ্দেশে নিউজ করায়। সেগুলোও এমনই কিছু হতে পারে। যদিও তিনি জানান, পৃথিবীতে সবকিছুর সম্ভাবনাই থাকে। কোনো সম্ভাবনা বা শঙ্কাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তবে শাহ ইফতিখার তারিক বলেন, কেউ যদি ধরে নেয় হঠাৎ করে তাদের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে, তাহলে ভুল হবে। কোনো বিশেষ দলের বিশেষ আকর্ষণ হঠাৎ করে বেড়ে যায়নি। এটা সবার মাথায় রাখতে হবে।

আরএইচ/