চীন–বাংলাদেশ কৃষি সহযোগিতা গভীরতর করার কৌশলগত ভিত্তি হিসেবে সার
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৯:১১ সকাল
নিউজ ডেস্ক

 উ জিয়ানবো

 

কৃষি এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এটি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, গ্রামীণ জীবিকাকে টিকিয়ে রাখে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। ধান, শাকসবজি ও আলু বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনের প্রধান ভিত্তি। উচ্চ জনঘনত্ব ও সীমিত আবাদযোগ্য জমির বাস্তবতায় স্থিতিশীল ফলন বজায় রাখতে কার্যকর, সুষম এবং পরিবেশবান্ধব সার ব্যবহারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়।
উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে পটাশ ও ফসফেট সার বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পটাশ ফসলের চাপ সহনশীলতা বাড়ায়, ফলনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং গুণগত মান উন্নত করে। অন্যদিকে ফসফরাস শিকড়ের বিকাশ, প্রাথমিক বৃদ্ধি এবং দানা গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের নিবিড় ধানভিত্তিক চাষ ব্যবস্থায় চাষের প্রাথমিক পর্যায়ে ডিএপি (DAP) ও টিএসপি (TSP) ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, যা শিকড়ের দৃঢ়তা নিশ্চিত করে এবং ফসলের সমান বৃদ্ধি ঘটায়। ফলে ফলনের স্থিতিশীলতা ও মাটির ঊর্বরতা ব্যবস্থাপনায় ফসফেট সার অপরিহার্য। খাদ্য চাহিদা পূরণে চাষাবাদ যতই বাড়ছে, ততই এমওপি (MOP), ডিএপি ও টিএসপির মতো সার শুধু উৎপাদনশীলতার জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে।

তবে বাংলাদেশের সার সরবরাহ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দেশে বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন সার ব্যবহৃত হয়, যার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থাকলেও তা ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়—বিশেষ করে পটাশ ও ফসফেটভিত্তিক সারের ক্ষেত্রে। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সুষম পুষ্টি ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই ভূমি ব্যবহারের নীতির কারণে ২০২৫–২০২৯ সময়কালে সার চাহিদা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

এই কাঠামোগত নির্ভরতা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার একটি তুলনামূলকভাবে পরিপক্ব ক্রয়ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দরপত্র ও সরকার-টু-সরকার (G2G) চুক্তির আওতায় সার আমদানি করা হয়, যা মৌসুমি প্রাপ্যতা ও মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। এমওপি ছাড়াও প্রতি বছর প্রধান রোপণ মৌসুমের আগে বিপুল পরিমাণ ডিএপি ও টিএসপি আমদানি করা হয়, যা জাতীয় ফসল পরিকল্পনায় ফসফেট সারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২০টি সার আমদানিকারক দেশের একটি ছিল, যেখানে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।

এই বাস্তবতা কেবল বাণিজ্যের সুযোগই নয়, বরং আরও গভীর ও কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে—বিশেষ করে চীনের সঙ্গে। চীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সার ও কৃষি উপকরণ উৎপাদক দেশ, যেখানে পটাশভিত্তিক সার, ডিএপি, টিএসপি, যৌগিক সার এবং ক্ষুদ্র পুষ্টি উপাদানসহ একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। সরবরাহ সক্ষমতার পাশাপাশি, চীন সার প্রকৌশল, জ্বালানি-দক্ষ উৎপাদন প্রযুক্তি এবং সবুজ উৎপাদন মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যান্ট ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।

বাংলাদেশের জন্য চীনের সঙ্গে সার সহযোগিতা কেবল আমদানি নিরাপত্তার বিষয় নয়; বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি কৃষি স্থিতিশীলতা জোরদারের একটি সুযোগ। অন্যদিকে চীনের জন্য বাংলাদেশ একটি নীতিগতভাবে সমর্থিত, স্থিতিশীল বাজার, যেখানে পুরো ভ্যালু চেইনজুড়ে সহযোগিতা সম্প্রসারণ সম্ভব। এই পারস্পরিক সম্পূরকতা কয়েকটি সম্ভাবনাময় পথ খুলে দেয়।

প্রথমত, ডিএপি ও এমওপির মতো গুরুত্বপূর্ণ সারের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি সরবরাহ নিরাপত্তা বাড়াতে পারে এবং স্বল্পমেয়াদি বাজার অস্থিরতার ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করবে। পূর্বনির্ধারিত পরিমাণ ও মূল্য কাঠামো উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক এবং জাতীয় খাদ্য উৎপাদন পরিকল্পনাকে সহায়তা করে।

দ্বিতীয়ত, স্থানীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্লেন্ডিং কারখানা স্থাপন যৌথ মূল্য সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করতে পারে। যৌগিক সার বা পটাশ ব্লেন্ডিং প্ল্যান্টে যৌথ বিনিয়োগ পরিবহন ব্যয় কমাবে, প্রযুক্তি স্থানান্তর নিশ্চিত করবে এবং দক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে স্থানীয় মাটি ও ফসলের উপযোগী, কম পরিবেশগত প্রভাবযুক্ত সার উৎপাদন সম্ভব হবে।

তৃতীয়ত, সার সহযোগিতা স্বাভাবিকভাবেই কৃষিযান্ত্রিকীকরণ ও প্রিসিশন ফার্মিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। সার প্রয়োগ যন্ত্রপাতি, মাটির পুষ্টি পরীক্ষা এবং ড্রোনভিত্তিক ছিটানো প্রযুক্তিতে চীনের অগ্রগতি বাংলাদেশে সার ব্যবহারের দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে। সার, যন্ত্রপাতি ও কৃষি সেবার সমন্বিত প্রয়োগ কৃষকদের কম ইনপুটে বেশি ফলন নিশ্চিত করবে এবং পরিবেশবান্ধব, জলবায়ু-সহনশীল কৃষিতে অবদান রাখবে।

চতুর্থত, লজিস্টিকস ও বিতরণ অবকাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশেষ করে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক সংরক্ষণাগার, গুদাম ও বন্দরভিত্তিক লজিস্টিকসে বিনিয়োগ মৌসুমি সময়ে সার সরবরাহের দক্ষতা বাড়াবে এবং সময়মতো সার পৌঁছাতে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তা কমাবে।

সার কেবল একটি কৃষি উপকরণ নয়; এটি শিল্প সক্ষমতা ও খাদ্য নিরাপত্তার মধ্যে একটি কৌশলগত সেতুবন্ধন। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও সেবা—এই সব ক্ষেত্রে সারকে কেন্দ্রবিন্দু করে সহযোগিতা গড়ে তুললে চীন ও বাংলাদেশ এমন একটি অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যা কৃষির আধুনিকায়নকে এগিয়ে নেবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও সবুজ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। এই ধরনের সহযোগিতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য একটি অধিক স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব কৃষি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

লেখক: সচিব-জেনারেল, গ্রিন অ্যান্ড স্মার্ট এনার্জি অর্গানাইজেশন

এনএইচ/