||ওলিউল্লাহ মুহাম্মাদ||
উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ওয়াজ মাহফিল দীর্ঘকাল ধরে ঈমানি জাগরণ, নৈতিক সংস্কার ও সামাজিক সংশোধনের এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। একসময় এই মাহফিলগুলো ছিল সার্বজনীন দাওয়াহর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ—যেখানে সকল শ্রেণি, সকল মত ও সকল পথের মানুষ নির্বিশেষে এক কাতারে বসে আল্লাহর বাণী শুনত, রাসূল ﷺ–এর সুন্নাহর আলোকে জীবন গঠনের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করত এবং আত্মিক ব্যাধি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেত। বক্তার কণ্ঠস্বর হতো একজন দায়ীর আদর্শ কণ্ঠস্বর—যিনি বিভাজন নয়, বরং সংযোগ সৃষ্টি করতেন; দূরে ঠেলে দেওয়া নয়, কাছে টেনে নেওয়াই ছিল যার মূল লক্ষ্য।
ওয়াজ মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য কখনোই নির্দিষ্ট কোনো দল, গোষ্ঠী কিংবা রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার ছিল না। এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষের অন্তর সংশোধন, আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া অর্জন, সমাজে প্রচলিত অন্যায় ও ভ্রান্তি দূর করা এবং সুন্নাহভিত্তিক জীবনব্যবস্থার বাস্তব দিকনির্দেশনা প্রদান। একজন প্রকৃত বক্তার বয়ানে থাকার কথা ছিল এমন যোগ্যতা, যা সকল মতপথের মানুষকে একত্রে বসিয়ে “দিনের কথা” বলার সক্ষমতা রাখে—যেন কেউ নিজেকে উপেক্ষিত বা পরিত্যক্ত মনে না করে, বরং আরও আগ্রহ নিয়ে দ্বীনের দিকে এগিয়ে আসে।
কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে এই চিত্র ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। বহু ওয়াজ মাহফিলে আজ আর আত্মশুদ্ধিমূলক গভীর আলোচনা, জীবনঘনিষ্ঠ সমস্যার কার্যকর সমাধান কিংবা নৈতিক সংস্কারের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায় না। সমাজে প্রচলিত ভুল বিশ্বাস ও অনৈতিক চর্চা সংশোধনের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে হিংসাত্মক ভাষা, উসকানিমূলক বক্তব্য, রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন এবং ভিন্নমতের প্রতি বিদ্বেষমূলক আক্রমণ। দাওয়াহর মিম্বর যেন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে রাজনৈতিক প্রচারণার মঞ্চে।
এর স্বাভাবিক পরিণতিতে ওয়াজ মাহফিলের সার্বজনীন চরিত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একসময়ের সকলের জন্য উন্মুক্ত এই ধর্মীয় আয়োজনগুলো আজ দলীয়করণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অনেক এলাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক বা আদর্শিক ঘরানার বক্তা না হলে মাহফিল আয়োজনই সম্ভব হয় না। এমনকি গ্রামভিত্তিক ছোট ছোট মাহফিলও রাজনৈতিক বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। ধর্মীয় সমাবেশ রূপ নিচ্ছে রাজনৈতিক সভায়—যেখানে জনসাধারণের সম্মিলিত অনুদান ও শ্রম ব্যবহৃত হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি পক্ষের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। নৈতিকতা ও দাওয়াহ—উভয় বিবেচনাতেই এটি গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বাস্তবতা হলো, ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের পেছনে সমাজের সকল শ্রেণি ও মতের মানুষের আর্থিক সহযোগিতা, শ্রম ও সমর্থন জড়িত থাকে। অথচ সেই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল যখন সকলের জন্য আত্মিক খোরাক না হয়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষের প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অনীহা, ক্ষোভ ও মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তারা অনুভব করে—নিজেদের অর্থে আয়োজিত মাহফিলই যেন তাদের মতাদর্শগত প্রতিপক্ষের প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
এই প্রবণতার আরেকটি মারাত্মক পরিণতি হলো ওয়াজ মাহফিলের ক্রমহ্রাসমান গ্রহণযোগ্যতা। একসময়ের লোকে-লোকারণ্য মাহফিলগুলো আজ অনেক স্থানে দর্শকশূন্যতায় ভুগছে। তরুণ সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, সাধারণ মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে প্রশাসনিক নজরদারি ও হস্তক্ষেপ। কোথাও কোথাও এমন পরিস্থিতিও দেখা যাচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মঞ্চে উঠে ওলামায়ে কেরামের ওপর প্রভাব বিস্তার করছেন—যা তাঁদের মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রশ্নকে গভীর সংকটে ফেলছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখনই প্রয়োজন আন্তরিক আত্মসমালোচনা। ওয়াজ মাহফিলকে পুনরায় তার মৌলিক উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে—দাওয়াহ, তাযকিয়া ও সমাজ সংস্কারে। বক্তাকে হতে হবে দলনিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ও দূরদর্শী। ওয়াজের মঞ্চ কোনো রাজনৈতিক দলের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়; এটি উম্মাহর আমানত। এখানে আলোচনার ভিত্তি হবে কুরআন ও সুন্নাহ, বিষয়বস্তু হবে জীবনঘনিষ্ঠ, ভাষা হবে শালীন ও হৃদয়স্পর্শী।
নিশ্চয়ই রাজনীতি ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বাধীনতার বিষয়; এর জন্য আলাদা মঞ্চ, আলাদা ব্যানার ও আলাদা সমাবেশ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মসভাকে রাজনৈতিক সমাবেশে রূপান্তর করা ওয়াজ মাহফিলের সার্বজনীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং এই মহা আমানতের প্রতি খেয়ানতের শামিল।
ওয়াজ মাহফিল যদি আবারও সকলের জন্য আশার বাতিঘর, আত্মার আশ্রয় ও সমাজ সংস্কারের কেন্দ্র হয়ে উঠতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই দলীয় সংকীর্ণতা, হিংসাত্মক ভাষা ও রাজনৈতিক বাণিজ্য থেকে মুক্ত হতে হবে। অন্যথায় এই ঐতিহ্যবাহী দাওয়াহি মাধ্যম ধীরে ধীরে তার গ্রহণযোগ্যতা, কার্যকারিতা ও মর্যাদা—সবই হারাবে; যার ক্ষতি কোনো একক গোষ্ঠীর নয়, বরং পুরো মুসলিম সমাজের জন্যই হবে অপূরণীয়
লেখক, শিক্ষক, গবেষক ও প্রবন্ধকার
এনএইচ/