
|
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস: মানবতার হাতে হাত রাখা এক আলোকযাত্রা
প্রকাশ:
০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৮:৫৬ রাত
নিউজ ডেস্ক |
||ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ||
মানবসভ্যতার বিকাশে প্রযুক্তি, স্থাপনা বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এগুলোর কোনোটিই মানবতার ভিত্তিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। সভ্যতার আসল শক্তি নিহিত মানুষের অন্তর্গত সেই গুণে—যা তাকে অন্যের কষ্ট বুঝতে শেখায়, সাহায্যের হাত বাড়াতে অনুপ্রাণিত করে এবং নিঃস্বার্থ সেবার মাধ্যমে একে অপরকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই মানবিকতার চর্চাকে স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণা দিতে প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস। দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষ মানুষের জন্য হওয়াই মানবতার মূল এবং নিঃস্বার্থ সেবার চেয়ে মহত্তর কিছু পৃথিবীতে আর নেই।
স্বেচ্ছাসেবক: ছোট শব্দ, বিশাল দর্শন
স্বেচ্ছাসেবী হওয়া কোনো আনুষ্ঠানিক পরিচয় নয়; এটি একটি মানসিকতা। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না রেখেই সমাজ, পরিবেশ ও মানবতার কল্যাণে নিজেদের শ্রম, সময় ও দক্ষতা বিনিয়োগ করেন। এদের কাছে সম্পদ বা খ্যাতি মুখ্য নয়; তাদের পরিতৃপ্তি অন্যের মুখে ফুটে ওঠা হাসিতে, দুর্দশা লাঘবের আনন্দে, আর এক শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার নিশ্চয়তায়।
১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবসকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ডিজিটাল যুগে মানুষের ব্যস্ততা যত বেড়েছে, একে অপরের সঙ্গে সংযোগের অভাবও তত গভীর হয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তেই স্বেচ্ছাসেবীরা মনে করিয়ে দেন—মানুষের প্রকৃত শক্তি তার মানবিকতায়, হৃদয়ে, সহমর্মিতায়।
নিঃস্বার্থতা ও দায়িত্ববোধ: স্বেচ্ছাসেবার দুই মূল স্তম্ভ
স্বেচ্ছাসেবার দর্শন দুই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে—নিঃস্বার্থতা এবং দায়িত্ববোধ।
নিঃস্বার্থতা মানুষকে প্রতিদানহীন সেবায় উদ্বুদ্ধ করে।
দায়িত্ববোধ তাকে সামাজিক কর্তব্যের প্রতি সজাগ রাখে।
সমাজ যখন ক্রমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে, তখন এই দুটি গুণই মানবিকতার নতুন পথরেখা আঁকে। একজন স্বেচ্ছাসেবকের কাছে তার পরিচয়, উপাধি বা অর্জন গৌণ; প্রাধান্য পায় মানুষের সেবা এবং সমাজের উন্নয়ন।
স্বেচ্ছাসেবী হতে বয়স, পেশা বা পরিচয়ের প্রয়োজন নেই
স্বেচ্ছাসেবার সৌন্দর্য এখানেই যে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। স্বেচ্ছাসেবী হতে পারে—
দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সাধারণ পথচারী,
বন্যার পানিতে নেমে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া যুবক,
অবসরে অসহায় শিশুদের পড়ানো গৃহবধূ,
রক্তদানকারী কলেজছাত্র,
আহত প্রাণীর পাশে দাঁড়ানো কিশোর।
সমাজে এরা সকলেই নীরব নায়ক। এদের একমাত্র পরিচয়—তারা মানুষকে ভালোবাসে।
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবসের লক্ষ্য
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবসের দুটি মূল উদ্দেশ্য:
১. বিশ্বের কোটি স্বেচ্ছাসেবীর অবদানকে সম্মান জানানো।
২. আরও মানুষকে মানবতার কাজে যুক্ত করা।
দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—একজন মানুষের ছোট্ট সাহায্যও বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। রাষ্ট্রীয় নীতি বা আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মানবিকতা সমাজকে অনেক দ্রুত বদলে দিতে পারে।
বিশ্বে স্বেচ্ছাসেবকদের অবদান
মানবতার ইতিহাসে সংকটই প্রমাণ করেছে—স্বেচ্ছাসেবীরাই মানবতার প্রথম সৈনিক।যুদ্ধক্ষেত্র, মহামারি, দুর্যোগ, খাদ্যসংকট বা আশ্রয়হীনতা—যেখানে মানবিক সংকট তীব্র হয়েছে, সেখানেই স্বেচ্ছাসেবীরা জীবন বাজি রেখে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট, ইউএনভি, ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাফল্যের পেছনে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবীর ত্যাগ ও নিবেদন রয়েছে।
বাংলাদেশ: মানবিকতায় উজ্জ্বল এক ভূখণ্ড
বাংলাদেশ মানবিকতার অনন্য উদাহরণ। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অগ্নিকাণ্ড কিংবা মহামারি—প্রতিটি সংকটেই হাজারো মানুষ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে।রক্তদান, শিক্ষা বিস্তার, ত্রাণ বিতরণ, পরিবেশ রক্ষা, হাসপাতাল-ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবা—প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের যুবকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবামূলক উদ্যোগগুলো শুধু মানবিকতার বিকাশ নয়; বরং জাতির শক্তি ও সংহতির প্রতীক। বিশেষ করে যুবসমাজের সচেতনতা ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ভবিষ্যতের জন্য এক বড় আশার আলো।
জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি: চিকিৎসা ও মানবতার একটি শক্তিশালী মডেল
বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনগুলোর মধ্যে জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি এক উজ্জ্বল উদাহরণ। দেশের অসংখ্য মানুষ আজও চিকিৎসা ব্যয় বহনের সামর্থ্য হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। এই সংগঠনটি তাদের নির্ভরতা হয়ে উঠেছে।
সংগঠনটি—আর্থিকভাবে অক্ষম রোগীদের জরুরি চিকিৎসা সহায়তা,
প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ,অপারেশনের খরচে সহযোগিতা,হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবা প্রদান,ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ক্যাম্প আয়োজন,
মা–শিশু স্বাস্থ্য সচেতনতা—এমন নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব বা দুর্ঘটনার সময় স্বেচ্ছাসেবীরা যেভাবে মাঠে নেমে কাজ করেন, তা দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে অমূল্যভাবে সমর্থন করে।
স্বেচ্ছাসেবার প্রভাব: সমাজ ও ব্যক্তিত্ব দুয়োতেই ইতিবাচক
স্বেচ্ছাসেবা সমাজকে:বৈষম্য কমায়,
সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করে,দুর্বল মানুষের কষ্ট লাঘব করে,মানবিক সম্পর্ককে দৃঢ় করে।
স্বেচ্ছাসেবীর ব্যক্তিত্বে:আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়,নেতৃত্বগুণ তৈরি হয়,মানবিকতা গভীর হয়,সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ে,জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
স্বেচ্ছাসেবীদের চ্যালেঞ্জ
স্বেচ্ছাসেবীর পথ মানবিকতার আলোয় ভরা হলেও বাস্তবতায় এতে রয়েছে অনেক বাধা।
অর্থের সংকট,সরঞ্জামের অভাব,
সময় ব্যবস্থাপনার কঠিনতা,শারীরিক ঝুঁকি,সামাজিক ভুল বোঝাবুঝি—
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই প্রতিদিন কাজ করতে হয়। তবুও স্বেচ্ছাসেবীরা থেমে থাকেন না, কারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
স্বেচ্ছাসেবা শুরু করার জন্য প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা
স্বেচ্ছাসেবী হতে বড় কোনো আয়োজনের প্রয়োজন নেই। আজ থেকেই শুরু করা যায়—একজন রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে,রক্তদান করে,
গাছ লাগিয়ে কিংবা পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রেখে,দুর্ঘটনায় আহতকে সাহায্য করে,শিশুকে পড়িয়ে বা বৃদ্ধকে সহায়তা করে।
এই ছোট ছোট কাজই সমাজের বৃহৎ পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করে।
পরিশেষে বলতে চাই,আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবসের মূল বার্তা একটাই—মানবতার আলোই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে।
জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি যেভাবে রোগীর পাশে দাঁড়ানোর এক মানবিক মডেল তৈরি করেছে, তেমনি আমরা প্রত্যেকে যদি একটি ছোট কাজও করি, সমাজে আলোর বিস্তার আরও দ্রুত ঘটবে। পরিবর্তনের শুরু হয় একটি ছোট্ট সিদ্ধান্ত থেকে—মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত।
আর সেই মানবতার আলো জ্বালাতে পারে—তুমি, আমি, আমরা সবাই।
লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: drmazed96@gmail.com
এলএইস/
|