মাদারিসে কওমিয়া সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনো কারিকুলাম নয়
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৫:০৫ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

||আশরাফুল হক||

কওমি মাদরাসার মূল উদ্দেশ্য চাকরি নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দ্বীন সংরক্ষণ। তাই কাতার বা ইউরোপে হাইস্কুল সার্টিফিকেট চাইলে সেটা কওমির মান কম বলে নয়, বরং তাদের চাকরি ব্যবস্থার নিজস্ব নিয়ম। দাওরা ইফতা করপোরেট ডিগ্রি নয়, যেমন মেডিকেল সনদ দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায় না ঠিক তেমনি দাওরা দিয়ে ব্যাংক বা অফিসের চাকরিতে প্রতিযোগিতা করা স্বাভাবিক দাবিও না। দুই জগৎ দুই উদ্দেশ্যে চলে।

বিদেশে মেশকাত, দাওরা বা হাইয়াতুল উলইয়ার নাম পরিচিত না হওয়া কোনো অভিযোগ নয়। তাদের কারিকুলামে এসব নেই, তাই তারা জানবে কেন। অপরিচিত হওয়া মানেই মূল্যহীন নয়, বরং উদ্দেশ্যে ভিন্নতা।

এই সমালোচকদের আসল সমস্যা সার্টিফিকেট নয়, চেতনার সংকট। তারা আসলাফদের পথ থেকে সরে গিয়ে মনে করে আমাদের মুরুব্বিরা নাকি দুনিয়া বোঝেননি। অথচ ইতিহাস সাক্ষী যে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, উবায়দুল্লাহ সিন্ধি, শাইখুল হিন্দ, সাইয়্যিদ মাদানী—এরা দুনিয়া বোঝা, সমাজ পরিবর্তন, রাষ্ট্রচিন্তা, সংস্কার, রাজনীতি, তাজদিদ—সব ক্ষেত্রেই যুগের অগ্রভাগে ছিলেন। তাদের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে আরব, আফগান, তুরান, আরব উপদ্বীপ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। তারা কোন পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে কাজ করেছিলেন? তারা যে উচ্চতায় উঠেছিলেন তার ভিত্তি ছিল কওমির ইলম, কওমীর ইস্তিদাদ, কওমীর ফিকির, কওমির রুহানি শক্তি।

সমস্যা কওমীর না, সমস্যা সেই ছাত্রের যে মন দিয়ে পড়ে না, কিতাব নিয়ে বসে না, ইস্তিদাদ তৈরি করে না, সারা বছর মোবাইল আর ঘোরাঘুরিতে সময় নষ্ট করে। পরে কওমীর কারিকুলামকে দোষ দেয়। যারা সত্যিকারের ছাত্র, যারা ইলমের স্বাদ পেয়েছে, তারা কখনো হীনমন্যতায় ভোগে না। তারা জানে দাওরা ইলমের মুকুট, চাকরির বিকল্প নয়। উদ্দেশ্য ভুল হলে অভিযোগ জন্মায়, উদ্দেশ্য ঠিক থাকলে ইলম নিজেই মর্যাদা দেয়।

কওমি মাদ্রাসা সমাজবিচ্ছিন্ন নয় বরং সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেবাগুলো পূরণ করে। অন্য সেক্টরে বেকারত্ব যেখানে বাড়ছে, কওমীতে তার এক অংশও নেই। দেশজুড়ে হাজার হাজার আলেম, ইমাম, খতিব, হাফেজ, শিক্ষক, গবেষক নিয়মিত কাজ পান। কওমি মানুষ সিভি হাতে রাস্তায় ঘোরে না, কারণ তাদের কাজের ক্ষেত্র নিজেই স্থায়ী এবং প্রয়োজনীয়।

দেওবন্দে বিশটির বেশি বিভাগ আছে। ফিকহ, হাদিস, তাফসির, সাহিত্য, গবেষণা, অনুবাদ, কিরাআত, তাজবিদ, ইফতা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি কারিগরি ও প্রয়োজনীয় দক্ষতার বিভাগও আছে। সুযোগের অভাব নেই। প্রশ্ন হলো ছাত্র সুযোগ খুঁজেছে কি না। দেওবন্দ, নাদওয়া বা বড় বড় মাদ্রাসার ছাত্ররা ইলম শেষ করে কখনো কাঁদে না যে বিদেশে আমার সার্টিফিকেট কেউ চেনে না। কারণ তারা জানে দাওরার উদ্দেশ্য ইলম, চাকরি নয়।

যদি কেউ বিদেশে পড়তে বা চাকরি করতে চায়, তবে হাইস্কুল, কলেজ, সমমান—এসব পাশ করা তার নিজের দায়িত্ব। হাজারো কওমী ছাত্র এটা করছে, সফলও হচ্ছে। ব্যক্তিগত প্রস্তুতির ঘাটতিকে কারিকুলামের দোষ বানানো ন্যায়সঙ্গত নয়।

কওমি মাদ্রাসা তোমাকে চাকরির সার্টিফিকেট দিতে আসেনি। তারা তোমাকে আলিম বানাতে এসেছে। দ্বীনের ভার বহন করার মানুষ বানাতে এসেছে। তুমি যদি আলিমের পথ বেছে নিয়ে কর্পোরেট প্রতিযোগিতার দাবি করো, তবে ভুলটা কওমীর নয়, তোমার নিজের। কওমির ইলম কখনো অমূল্য হয় না, অমূল্য হয়ে যায় সেই দৃষ্টি যা নিজের পথই চিনতে পারে না।

লেখক: আলেম ও চিন্তক

এলএইস/