সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি: কওমি মুরব্বিদের প্রতি একটি নিবেদন
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৭:১৭ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

নুরুযযামান নাহিদ

পটিয়ায় পড়াকালীন আলিয়ায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ছিল আমার। বিনা পয়সায় ঘরে বসে সব বন্দোবস্ত হওয়ার মত ছিল। আমার সহপাঠীদের একটা বিরাট অংশ তখন আলিয়াতে পরীক্ষা দিয়েছেন। বিশেষত, আন-নাদি আস-সাকাফিতে যাদের সাথে খুবই সুন্দর দুটো বছর কাটিয়েছি আমি, একজন ছাড়া, বাকি সবাই পরীক্ষা দিয়েছেন। পটিয়া ছাত্র থাকাকালীন অনেকে চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছেন এবং নিয়মিত লেখাপড়াও করেছেন। তবে পুরো কাজটাই তাদের গোপনে করতে হয়েছে। মাদ্রাসার আইন কড়া ছিল। ধরা পড়লেই বহিষ্কার। কিন্তু একই সাথে ছয়শ-সাতশ ছাত্র পরীক্ষা দিতে যেত; তারপরও ধরা পড়তো না। বিষয়টা ওপেন সিক্রেট ছিল। মাদ্রাসার আইন খুব কড়া; কিন্তু প্রায় সবাই জানতো নিয়মিত এখানকার ছেলেরা পরীক্ষা দেয় এবং চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে আসা-যাওয়া করে। চাইলে এই সুযোগটা আমি নিতে পারতাম। নিই নি। কেন নিচ্ছি না, এজন্য আমার শুভাকাঙ্ক্ষী কয়েকজন সহপাঠী বাক-বিতন্ডায়ও লিপ্ত হয়েছে আমার সাথে। আমি তুমুল তর্ক করেছি; কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নিই নি।

অবশ্য পরীক্ষা দিলে আরো আগেই দেওয়া যেত। মিজানের বছরই আলিয়াতে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। কওমি মাদরাসা ছেড়ে যেতে চেয়েছিলাম। তখনই রেজিস্ট্রেশন করা হয়ে গিয়েছিল। তারপর তো রাব্বে কারীম ঘাড় ধরে ফিরিয়ে আনলেন। এবং তারপর থেকে আজ অব্দি ওদিকে মুখ করার ইচ্ছে হয়নি। রেজিস্ট্রেশন আমার ছিল। আমার সহপাঠীদের কারো ছিল না। কিন্তু জামাতের শীর্ষে থাকা আমার আশেপাশের দুজন সহপাঠী ঠিকই পরীক্ষা দিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে গেল। শুনেছি, একজন নামকরা একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ধর্মশিক্ষক হিসেবে আছে। মাইনে ভালো। আরেকজন পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসার হয়েছে। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে শুকরিয়া করি। সকল প্রশংসা রব্বে কাবার জন্য। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। দুনিয়াবি ওই 'সবব' (সার্টিফিকেট) হাতে চলে এলে হয়তো আমিও ইলমের কাননে অহরাত্রি পড়ে থাকার পরম প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতাম।

জীবনে একবারের জন্যও আমার মনে হয়নি একটা সার্টিফিকেট দরকার। বরং সারাজীবন ভেবে এসেছি, কওমিতে পড়ে আলিয়াতে পরীক্ষা দেওয়ার অর্থ হলো ইলমের ইহানত করা। উত্তম প্রাপ্তির পরে অধমের প্রতি লালায়িত হওয়া। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জৌলুসে প্রলুব্ধ হয়ে সতত স্নিগ্ধ ইলমের ফল্গুধারাকে অবজ্ঞা করা। এখনো এই বিশ্বাসে আমি অটল। নিজের জন্য এবং নিজের সন্তানের জন্য আমি এই আদর্শই লালন করবো। রব্বে কারিমের দরবারে মিনতি জানাবো, কিয়ামত পর্যন্ত আমার বংশধরদের মধ্যে যাতে এই আদর্শ ও আবেগ টিকে থাকে।

কিন্তু, নিজে আযিমতের ওপর চলবো বলে অন্যকেও সেই কষ্টের পথে টেনে নেবো; এটা আমার  ভুল মনে হয়। ইলমের জন্য যে জীবনকে উৎসর্গ করতে রাজি, সার্টিফিকেট নিয়ে হায়-হুতাশ তার কখনোই হবে না। এমনকি যে অভিভাবক সন্তানকে ইলমের জন্য ওয়াকফ করে দেবেন, সার্টিফিকেট নিয়ে তার মাথাব্যথা আদৌ হবে না। তিনি শুধু চাইবেন কলিজার টুকরা সন্তানটি যেন জান্নাতে, রব্বুল ইজ্জতের দিদারের মজলিসে উলামায়ে কেরামের কাতারে থাকে এবং অভিভাবক হিসেবে তিনি যেন লাভ করতে পারেন সম্মাননা মুকুট।

বাস্তবতা হলো, এই উচ্চস্তরের তাওয়াক্কুলওয়ালা লোকের সংখ্যা নগণ্য হবে। ফলে, শিক্ষা ব্যবস্থার কল্যাণ ও অকল্যাণ চিন্তা করতে হবে অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা সামনে রেখে। কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নামক আপদের হাতে পড়ে লেখাপড়া প্রায় শিকেয় উঠে যাচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে। বোর্ড পরীক্ষায় শীর্ষস্থান প্রাপ্তির প্রতিযোগিতার যাঁতাকলে পড়ে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা দিন দিন তলানিতে নামছে। উপরন্তু, সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে ভালো শিক্ষার্থীরাও পরিচিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের সংস্কৃতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং সেসবের জৌলুস দেখে তারা হীনম্মন্যতায় ভোগা শুরু করেছে। তাদের মনে হচ্ছে, বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হতে না পারলে শেখার অনেক কিছুই বাকি থেকে যাবে তার। জীবনের অনেক অর্জনই হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিংবা অনেক যোগ্যতা অর্জন করেও উপযুক্ত মর্যাদা পাওয়া যাবে না। ফলে সে অস্থির হয়ে উঠছে। এবং অস্থিরতার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। অনেকে ভাবেন, সরকারিভাবে সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি সম্ভবত দুর্বল ছাত্রদের প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো, দুর্বল ছাত্রদের তেমন কোনো প্রয়োজনই নাই। প্রয়োজন ভালো ছাত্রগুলোর। যারা মেধাবী এবং যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের অনেকেই চায় পৃথিবীর নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী হিসেবে যুক্ত হতে। তাদের এই আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

জোর করে এই আকাঙ্ক্ষা দমন করার ফল ভালো হওয়ার কথা না। ভবিষ্যতে এরাই কওমি মাদরাসার কর্ণধার হবে। বর্তমান মুরুব্বিয়ানে কেরাম বুঝেশুনে প্রয়োজনীয় শর্ত যুক্ত করে যদি এই সুযোগকে উন্মুক্ত করে রেখে যান তাহলে ভবিষ্যতের কর্ণধাররা বড়সড় ভুল করার হাত থেকে বেঁচে যাবেন। এটা তো সত্যি, ইলম, তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল এখন নিম্নমুখী। পরবর্তীদের ওপর এই নাযুক সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে যাওয়া কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। আশা করবো, আন্তরিকতার সাথে বড়রা বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

আরএইচ/