
|
জন্মলগ্ন থেকে বৈষম্যের শিকার কওমিয়ানরা
প্রকাশ:
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৪২ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
আসলাম বিন আঃ হক স্বাধীনতার পর অর্ধশতাধিক বছর কেটে গেছে। দেশ এগিয়েছে প্রযুক্তিতে, উন্নয়নে, শিক্ষায়—কিন্তু রাষ্ট্রের এক বিশাল অংশ, কওমি অঙ্গনের লক্ষ-কোটি মানুষ, এখনও দাঁড়িয়ে আছে ‘স্বীকৃতি’ নামক একটি মৌলিক ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে। সমাজের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনে অমূল্য অবদান রাখলেও কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি বাস্তবায়ন এখনো রয়ে গেছে অর্ধসমাপ্ত, উপেক্ষিত এবং প্রবহমান এক বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে। রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে চলে আসা এই অবহেলা শুধু একটি সনদের প্রশ্ন নয়—এটি কওমিয়ানদের জীবনসংগ্রাম, অর্থনৈতিক বাস্তবতা, মর্যাদা ও অধিকার বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস। ‘কওমি’ শব্দটি যেমন জাতিকে বোঝায়, তেমনি ‘মাদ্রাসা’ মানে হলো একটি জাতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ কওমি মাদ্রাসা—এ দেশের মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও চাহিদা থেকে গড়ে ওঠা এক বিশুদ্ধ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা। আর ‘স্বীকৃতি’—এর শাব্দিক অর্থ গ্রহণ বা মেনে নেওয়া; পরিভাষায় জ্ঞান বা ডিগ্রিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেওয়া। তাই সনদের স্বীকৃতি কোনো দাবি নয়, এটি নাগরিক অধিকার—রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। দেওবন্দসহ প্রাচীন মাদ্রাসাগুলো অতীতে কাগজের সনদ দিত না, কিন্তু এখন বিশ্বের সব মাদ্রাসায় একাডেমিক সনদ দেওয়া হয়, যা জ্ঞানের স্বীকৃতি ও মর্যাদার প্রতীক। সুতরাং সনদ গ্রহণ দেওবন্দবিরোধী নয়—বরং জ্ঞানের স্বীকৃতি সর্বদা সম্মানজনক। স্বীকৃতি বাস্তবায়ন—কেন প্রয়োজন? কারণ, এ বৈষম্যের ক্ষত বহন করছেন সেই ইমাম, যাঁর মাসিক বেতন মাত্র সাত হাজার টাকা। রমজানে পরিবারকে নিয়ে একবেলা গরুর মাংস খেতে মন চায়—কিন্তু দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাম জিজ্ঞেস করার সাহস পান না। এ কথা সেই মোয়াজ্জিনের, যার বেতন আসে গ্রামের মানুষের মুষ্টিভর্তি চাল আর অল্প কিছু দান থেকে। সেই মুদাররিসের, যিনি নিজের স্ত্রীকে হাসপাতালে নিতে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা খোঁজেন। সেই আলেমের, যিনি সারাজীবন মসজিদ-মাদ্রাসায় সেবা দিয়েছেন অথচ শেষ বয়সে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুশয্যায় কাতরান। দ্বীন শিখেছি বলে রুটি-রুজির প্রয়োজন নেই—এমন ধারণা ইসলামের নয়। আল্লাহ নিজেই শিক্ষা দিয়েছেন দোয়া করতে— رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً (হে আল্লাহ! আমাদের দুনিয়ার কল্যাণ দাও।) দ্বীন ও দুনিয়া দুই বিপরীত নয়—বরং পরিপূরক। জাগতিক জ্ঞান দুনিয়া নয়; বরং যা মানুষকে আল্লাহ থেকে গাফেল করে সেটাই দুনিয়া। ইতিহাস সাক্ষী—দ্বীনদার আলেমরা কখনো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী–তাবেঈন থেকে শুরু করে দেওবন্দের আকাবিরগণ—সকলেই দ্বীন ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয়েই নেতৃত্ব দিয়েছেন।রিফাআহ রাঃ ছিলেন বিখ্যাত সার্জন আমর ইবনে আস রাঃ আন্তর্জাতিক কূটনীতিক সালমান ফারসি রাঃ ছিলেন কৌশলবিদ ও নকশাবিদ ইমাম আজম রহঃ ছিলেন ব্যবসায়ী ইমাম শাফেয়ী রহঃ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দের বহু শুরা সদস্য ছিলেন আইন উপদেষ্টা, পার্লামেন্ট সদস্য, রাষ্ট্রদূত এ সবই প্রমাণ করে—কওমিরা দুনিয়ার কাছে দ্বীন বিক্রি করেন না; বরং দুনিয়াকে দ্বীনের আলোয় পরিচালনার সক্ষমতা রাখেন, যদি প্রয়োজনীয় সুযোগ থাকে। স্বীকৃতি বাস্তবায়নের রূপরেখা রূপরেখা–১ : পাঠ্যক্রম সংস্কার ও সমন্বিত স্তর উন্নয়ন নিচের স্তরের স্বীকৃতি ছাড়া উপরের স্তরের স্বীকৃতি কার্যকর হয় না। এ কারণেই আমরা পিছিয়ে। সব বোর্ড ও এলাকার পাঠ্যসংস্করণ এক করে একটি一 পাঠ্যক্রম প্রণয়ন প্রয়োজন। হিফজ–নাজেরা–মাকতব–ইবতেদায়ী–সানাবিয়া পর্যন্ত ৭০% নেজামী + ৩০% জেনারেল বিষয় যুক্ত করা যেতে পারে। দাওরা থেকেই পুরোপুরি নেজামী রাখা—উচ্চতর আরবি ডিগ্রি হিসেবে। ফলাফল ঝরে পড়া হাজারো শিক্ষার্থী অন্তত এসএসসি–এইচএসসি সমমান সার্টিফিকেট পাবে। ইমাম–মুদাররিসদের জন্য রাষ্ট্রীয় চাকরি, ব্যাংক–হজ্জ মিশন–ধর্ম মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন সম্ভব হবে। রূপরেখা–২ : স্বতন্ত্র কওমি ওপেন ইউনিভার্সিটি / ওপেন বোর্ড ২০১১ সালের জমিয়তের ‘জমিয়ত ওপেন স্কুল’ মডেলের মতো— একটি স্বাধীন বোর্ড নিজস্ব ক্যাম্পাস, বিজ্ঞান–আইটি ল্যাব মানবিক/বিজ্ঞান/ব্যবসায় বিভাগে এক বছরের এইচএসসি সমমান কোর্স অনলাইন–অফলাইন ক্লাস GPA ভিত্তিক সনদ, যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়–মেডিকেল–জব—সব জায়গায় আবেদন সম্ভব বাস্তব উদাহরণ একজন ছাত্র ২২–২৩ বছর বয়সে তাকমিল শেষ করে + ১ বছর এইচএসসি কোর্স নিলে বয়স হবে ২৪। এরপর ৪ বছরের অনার্স করলে ২৯–৩০ বছর। চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৩২—অর্থাৎ সময় যথেষ্ট। উপসংহার স্বীকৃতি বাস্তবায়ন কওমিদের দাবি নয়—রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যে শিক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ-কোটি মানুষের ঈমান, নৈতিকতা, সমাজজীবন ও জাতীয় চরিত্র গঠনে অমূল্য ভূমিকা রাখে, সেই ব্যবস্থা আজও পূর্ণ স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। দ্বীন ধরে রেখে, নিজস্ব স্বকীয়তায় থেকে— কওমিয়ানরাই পারে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্বীনদার নেতৃত্ব দিতে, যদি দরজা খোলা হয়। এটাই সময়—দ্বীন ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার। আরএইচ/ |