মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম (রহ.): তাসাউফ, সমাজসংস্কার ও ইসলামী নেতৃত্বের অনন্য পথপ্রদর্শক
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর, ২০২৫, ০৯:৪৮ রাত
নিউজ ডেস্ক

||ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ||
 
২৫ নভেম্বর—মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম (রহ.)-এর ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। আপোষহীন ইসলামি আদর্শ, আধ্যাত্মিকতা ও নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন, তা আজও লাখো মানুষের হৃদয়ে তাজা। চরমোনাই দরবারের এই মহান পীর শুধু একটি দরবারের প্রধানই ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক যুগের চিন্তা–চেতনার নির্মাতা, সমাজসংস্কারক এবং রাজনৈতিক বিকল্পের পথিকৃৎ।
 
শৈশবেই দ্বীনের আলোয় বেড়ে ওঠা
 
১৯৩৭ সালে বরিশালের চরমোনাইতে জন্ম নেওয়া এই মহাজন ছিলেন চরমোনাই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা শায়েখ মাওলানা সৈয়দ ইছহাক (রহ.)-এর মেঝ ছেলে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল দ্বীনের প্রতি গভীর অনুরাগ। পিতার কাছেই শুরু হয় তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা, ইলম ও তাসাওউফের যাত্রা।
 
চরমোনাই আলিয়া মাদরাসায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন (১৯৫৭)। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি নিজ মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করে কুরআন–হাদিসের আলো ছড়িয়ে যেতে থাকেন।
 
আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের প্রারম্ভ
 
১৯৭৩ সালে পিতার ইন্তেকালের পর তিনি চরমোনাই দরবারের আমীরুল মুজাহিদীন হিসেবে দায়িত্ব পান। তাঁর নেতৃত্বেই চরমোনাই দরবার শুধু আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।
 
চরমোনাই বার্ষিক মাহফিল—যা আজ দেশের অন্যতম বৃহত্তম দ্বীনি সমাবেশ—তাঁর হাত ধরেই পেয়েছে সুসংগঠিত কাঠামো। তাঁর ওয়াজ, দোয়া, তাজকিয়া এবং সুলুক–তেরবিয়তের কার্যক্রম লাখো মানুষের হৃদয়ে পরিবর্তনের সঞ্চার করেছে।
 
দাওয়াতি কর্মকাণ্ডে তাঁর অনন্য অবদান
 
যুবক বয়সে তিনি নাছিরে মিল্লাত নামে ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে সংগঠিত করেন।
 
প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি দেশময় গ্রাম-গঞ্জ ঘুরে ইসলাম প্রচার করেছেন। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানসহ এশিয়ার বহু দেশে নিয়মিত সফর করেছেন।
 
মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকায় তাঁর অসংখ্য মুরিদ রয়েছে—যা তাঁর দাওয়াতি প্রভাবের সত্যিকারের নিদর্শন।
 
ইসলামী রাজনীতিতে দৃঢ় অবস্থান
 
মাওলানা ফজলুল করীম (রহ.) ছিলেন একজন নীতিবদ্ধ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। ছাত্রজীবনেই তিনি পিতার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। পরবর্তীতে হাফেজী হুজুরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন।
 
১৯৮০ দশকে ধর্মবিরোধী চেতনার উত্থান, নারীবাদী চাপে ইসলামি মূল্যবোধ ক্ষয়—এই বাস্তবতা তাঁকে নতুন এক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করে।
 
১৯৮৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, যা আজকের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তাঁর নেতৃত্বে এ আন্দোলন হয়ে ওঠে নৈতিকতার পুনর্জাগরণ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের একটি শান্তিপূর্ণ ধারক।
 
তসলিমা নাসরিন ইস্যুতে তিনি ছিলেন সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়কারী। বিএনপি আমলে ওলামা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে যে দৃঢ়তা তিনি দেখিয়েছিলেন, তা তাঁকে জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে আনে।
 
১৯৯৬–২০০১ মেয়াদে ফতোয়া বিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে কাফনের কাপড় নিয়ে তাঁর আন্দোলন ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে—যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় তাঁর আপোষহীন চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
 
ভ্রান্ত আকিদার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান
 
তিনি ছিলেন আকিদাগত শুদ্ধতা, সুন্নি মনোভাব, নৈতিকতা ও সমাজসংস্কারের অটল প্রতিষ্ঠাতা।
ভ্রান্ত মতবাদের প্রচারণা, নাস্তিকতা বা ধর্মবিরোধী ফিতনা—কোনো কিছুর সামনে তিনি নতি স্বীকার করেননি। নারী নেতৃত্বের প্রশ্নে শরিয়াহ ভিত্তিক মতাদর্শ তুলে ধরে তিনি দেশের ইসলামি রাজনৈতিক আলোচনাকে নতুন মাত্রা দেন।
 
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি
 
আটকোণে সীমাবদ্ধ ছিলেন না তিনি। বরং তিনি ছিলেন বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর একজন বড় ভিশনারি।
 
আরাফাতের ময়দানে খুতবায় তিনি জাতিসংঘকে ‘সাম্রাজ্যবাদের রাবার স্ট্যাম্প’ আখ্যায়িত করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামী জাতিসংঘ গঠনের আহ্বান জানান। তাঁর এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনার জন্ম দেয়।
 
শিক্ষা, কল্যাণ ও সমাজ সংস্কারে তাঁর অবদান
 
চরমোনাই দরবার আজ যে উন্নত শিক্ষা-ব্যবস্থা, মাদরাসা–মসজিদ প্রতিষ্ঠা, এতিমখানা পরিচালনা এবং সামাজিক কল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে—তার মূল ভিত্তি স্থাপন করেন তিনিই।
 
তিনি বিশ্বাস করতেন—“একটি ভালো সমাজ চাইলে দরকার দীন, নৈতিকতা, এবং শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা।এই চিন্তা থেকেই তিনি সারাদেশে অসংখ্য মাদরাসা, দাওয়াতি কেন্দ্র ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
 
ইন্তেকাল: এক যুগের অবসান
 
২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর সকাল ৯টায়, চরমোনাই বার্ষিক মাহফিল শুরুর মাত্র একদিন আগে, জিকিররত অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু ছিল শান্ত, নীরব, আরাধ্য বন্ধুর সঙ্গে মিলনের মতো এক প্রশান্ত বিদায়।
 
লাখো মুরিদ, আলেম, ধর্মপ্রাণ মানুষ তাঁর মৃত্যুসংবাদে শোকে কাতর হয়ে পড়ে। চরমোনাইতে যে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, তা দেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ জানাজার একটি।
 
তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার
 
মাওলানা ফজলুল করীম (রহ.) যেন চলে যাওয়ার পর আরও বড় হয়ে ওঠেন—আধ্যাত্মিকতার ধারাবাহিকতা আজও বজায় আছে চরমোনাই দরবারে।
 
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাঁর চেতনা ধারণ করে জনমানুষের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
 
দাওয়াতি কার্যক্রম দেশজুড়ে ব্যাপকতা পেয়েছে
 
নৈতিক, স্বচ্ছ, সৎ সমাজব্যবস্থার যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন, তা আজো বহু মানুষের প্রেরণার উৎস
 
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে নতুন দিগন্ত তিনি দেখিয়েছিলেন, তা নতুন প্রজন্মকে ভাবতে শিখাচ্ছে
 
পরিশেষে বলতে চাই, মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম (রহ.) ছিলেন এমন একজন মানুষ, যাঁকে একক কোনো পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না। তিনি ছিলেন পীর, আলেম, সংগঠক, সমাজসেবক, নীতিবদ্ধ রাজনীতিবিদ এবং সাহসী নেতৃত্বের প্রতীক।
 
তাঁকে স্মরণ করা মানে শুধু একজন ব্যক্তিকে স্মরণ করা নয়; বরং এক আদর্শ, এক সংস্কার, এবং নৈতিক সমাজ গঠনের এক উজ্জ্বল স্বপ্নকে স্মরণ করা।
 
আল্লাহ তাআলা তাঁর কবরকে নূরানিয়্যতে ভরিয়ে দিন, তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন—আমিন।
 
লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক 
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
 
এলএইস/