
|
২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দিবস ২০২৫: বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
প্রকাশ:
২০ নভেম্বর, ২০২৫, ০৯:০৫ রাত
নিউজ ডেস্ক |
||ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ||
দেশপ্রেম কেবল আবেগ নয়; এটি শক্তি, পরিকল্পনা, দক্ষতা ও ধৈর্যের সমন্বয়ও প্রয়োজন। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং দেশের শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী—সেনা, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী—আমাদের রক্ষাকবচ। প্রতি বছর ২১ নভেম্বর পালিত সশস্ত্র বাহিনী দিবস কেবল সৈনিকদের সম্মান প্রদর্শনের দিন নয়; এটি নাগরিকদের জন্যও স্মরণ করায় যে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা আমাদের সকলের চলমান দায়িত্ব।
সশস্ত্র বাহিনীর অবদান সীমাবদ্ধ নয় শুধুমাত্র সামরিক শক্তিতে; তারা দেশের শান্তি, উন্নয়ন, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং আন্তর্জাতিক মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সীমান্ত রক্ষা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনে তাদের অবদান দেশের স্থিতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নাগরিকরা যদি এসব কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব বুঝতে পারে, তবে দেশপ্রেম কেবল আবেগ নয়, বরং কার্যকর কর্মেও পরিণত হয়।
সামরিক বরাদ্দ: দায়িত্ব ও প্রস্তুতি
২০২৫‑২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৪০,৬৯৮ কোটি টাকা, যা দেশের সামরিক গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। যদিও এটি গত বছরের ৪২,০১৪ কোটি থেকে সামান্য কম, তবুও এটি বাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রম এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য শক্ত ভিত্তি প্রদান করে।
বাজেটের প্রধান অংশ:
চলমান ব্যয় (পরিচালন খরচ): ৩৭,৮১২ কোটি টাকা
উন্নয়ন খরচ: ৯১৬ কোটি টাকা
পরিচালন খাতে বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হলেও, উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ যথেষ্ট কি না তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সামরিক শক্তি কেবল অস্ত্র বা সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, আধুনিকায়ন এবং প্রযুক্তি গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি বাজেট বরাদ্দ শুধু অর্থের হিসাব নয়; এটি দায়িত্ব, পরিকল্পনা এবং কার্যকারিতার প্রতিফলন। নাগরিক ও গবেষকের দায়িত্ব হলো এর ব্যবহার মনিটর করা এবং প্রয়োজনে সমালোচনা বা সমর্থন করা।
সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্ব ও সক্ষমতা
সশস্ত্র বাহিনী সীমান্ত রক্ষা, প্রশিক্ষণ, গঠন, রক্ষণাবেক্ষণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিয়োজিত। তবে নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে:
সীমান্ত নিরাপত্তা ও অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ
প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়
শুধু বর্তমান সক্ষমতা বজায় রাখলেই হবে না; উন্নয়ন, আধুনিকীকরণ এবং প্রযুক্তি গ্রহণ অপরিহার্য। প্রতিটি সীমান্ত এলাকা, নদী ও সমুদ্রসীমা সুরক্ষিত রাখতে আধুনিক অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং পরিকল্পিত কৌশল গ্রহণ জরুরি।
আধুনিকীকরণ ও “ফোর্সেস লক্ষ্য ২০৩০”
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা “ফোর্সেস লক্ষ্য ২০৩০” গ্রহণ করেছে, যা তাদের আধুনিক, দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
পরিকল্পনার মূল উপাদান:
১. ত্রি-শাখার সমন্বয়: সেনা, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী একত্রিত করে দ্রুত ও কার্যকর প্রতিক্রিয়া।
২. স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্প গঠন: বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় অস্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন।
৩. উন্নত অস্ত্র সংগ্রহ: আধুনিক প্রযুক্তি ভিত্তিক অস্ত্র সীমান্ত রক্ষা ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া শক্তিশালী করে।
৪. প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ ও প্রযুক্তি গ্রহণ: নতুন দক্ষতা, ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার প্রতিরক্ষা।
পরিকল্পনা ধীর হলেও এটি বাহিনীর ক্ষমতা, দক্ষতা এবং প্রস্তুতির মান বৃদ্ধির প্রতীক। বাজেট সীমাবদ্ধতা, প্রশাসনিক বাধা ও স্বচ্ছতার অভাব এই ধীরগতি বাড়াতে পারে।
জনশক্তি ও মানবিক দিক
সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি কেবল অস্ত্র নয়; এটি মানুষের জীবন, শ্রম ও আত্মত্যাগের প্রতিফলন। ২০২৫ সালে সক্রিয় সদস্য সংখ্যা প্রায় ২০৪,০০০, যারা দেশের সীমান্ত রক্ষা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি গ্রহণ এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করে সৈন্যরা আরও কার্যকর হতে পারে। তারা শুধু সৈনিক নয়, পরিবারের অভিভাবক এবং নাগরিক হিসেবেও দায়িত্বশীল। তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
দেশের জন্য বহুমাত্রিক অবদান
সীমান্ত নিরাপত্তা:
সেনা স্থলসীমা ও পাহাড়ি এলাকা রক্ষা করে।
নৌবাহিনী নদী ও সমুদ্রসীমা রক্ষা করে এবং অবৈধ প্রবেশ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিমানবাহিনী আকাশসীমা রক্ষা করে, দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করে এবং জরুরি সহায়তা প্রদান করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক সহায়তা:
২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা ও ২০২০ সালের আম্পান ঘূর্ণিঝড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও আশ্রয় প্রদান করেছে। নদী ভাঙন প্রতিরোধ ও ত্রাণ পৌঁছানোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অভ্যন্তরীণ শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা:
প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে সন্ত্রাস, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবেলা।
অবকাঠামো উন্নয়ন:
রাস্তা, সেতু, স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণে সহায়তা। নদী তীরের বাঁধ এবং প্লাবন প্রতিরোধক কাঠামো তৈরি।
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশন:
আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য অঞ্চলে জাতিসংঘের মিশনে অংশগ্রহণ। যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন।
জাতীয় উন্নয়ন ও মানবসম্পদ:
স্থানীয় প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা। সামাজিক উদ্যোগে অংশগ্রহণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ জটিল ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে অবস্থান করছে। সীমান্ত অনুপ্রবেশ, সাগরসীমার বিবাদ, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং কৌশলগত আকাঙ্ক্ষা প্রতিরক্ষা নীতি জটিল করে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সাইবার হুমকিও নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাজেট ও আধুনিকীকরণ পরিকল্পনা নিরাপত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিহীন হলে বিপজ্জনক হতে পারে। বাহিনীকে কেবল শক্তিশালী করা নয়; দীর্ঘমেয়াদী, সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা জরুরি।
নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব
সশস্ত্র বাহিনী আমাদের গর্ব এবং নিরাপত্তার প্রতীক। তবে গর্বের সঙ্গে আসে দায়িত্ব।
স্বচ্ছতা: বাজেট বরাদ্দ ও ব্যবহার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা।
সংশ্লিষ্টতা: আধুনিকীকরণ প্রকল্পের অগ্রগতি জনসমক্ষে উপস্থাপন।
সমর্থন ও সমালোচনা: নাগরিকরা শুধু ভোক্তা নয়, সমালোচক ও সমর্থক হিসেবেও কাজ করবে।
শক্তিশালী বাহিনী গড়ে ওঠে জনগণের আস্থা, অংশগ্রহণ এবং দায়িত্ববোধের মাধ্যমে।
প্রযুক্তি ও আধুনিকীকরণ
সশস্ত্র বাহিনী আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা, ড্রোন, রাডার এবং ন্যাভিগেশন প্রযুক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিকীকরণ কেবল অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি নয়; এটি প্রশিক্ষণ, পরিচালন, কৌশল এবং তথ্য সংগ্রহের দক্ষতাও বাড়ায়।
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না বাড়ালে সীমান্ত রক্ষা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রম দুর্বল হতে পারে। আধুনিক সেনা হলো তথ্যভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল।
পরিশেষে বলতে চাই, সশস্ত্র বাহিনী দিবস কেবল অতীতের গৌরব এবং সাহসিকতার স্মরণ করায় না; এটি আমাদের ভবিষ্যতের এক অটুট প্রতিজ্ঞা—দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সদা প্রস্তুত থাকার। সামরিক বাজেট, জনশক্তি, আধুনিকীকরণ পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রমাণ করে যে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে দেশের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সতর্ক পরিকল্পনা ও আধুনিক দক্ষতা অপরিহার্য।
সশস্ত্র বাহিনী শুধু অস্ত্রশক্তি নয়; এটি গর্ব, নৈতিক দায়িত্ব, মানবিক মূল্যবোধ এবং দেশের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার প্রতীক। তাদের আত্মত্যাগ, কঠোর প্রশিক্ষণ এবং সীমাহীন দায়িত্ববোধ আমাদের সকলকে স্মরণ করায় যে দেশের সুরক্ষা কেবল বাহিনীর দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সকলের একসাথে পালনীয় কর্তব্য। তাদের অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া এবং উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া আমাদের নাগরিক হিসাবে অপরিহার্য। সশস্ত্র বাহিনী আমাদের গর্ব, কিন্তু আমাদের দায়িত্বও; একসাথে সচেতন, সংহত এবং দায়িত্বশীল থাকলে আমরা দেশের জন্য স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা এবং প্রগতি নিশ্চিত করতে পারব।
লেখক: কলাম লেখক ও সমসাময়িক বিষয়ক গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
ইমেইল, drmazed96@gmail.com
এলএইস/
|