বিশ্ব শিশু দিবস: শীতকালে শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুস্থতা নিশ্চিত করার উপায়
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০৭:৫৩ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

||ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ|| 
 
প্রতিবছর ২০ নভেম্বর উদযাপিত হয় বিশ্ব শিশু দিবস, যা শিশুদের অধিকার, সুস্থতা, নিরাপদ পরিবেশ এবং শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে পালিত হয়। শিশুদের সুস্থতা কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি পুরো সমাজের ভবিষ্যতের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শীতকাল শিশুদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জের সময়। এই সময় ঠান্ডা, ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যায়। তাই শীতকালে শিশুদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখার জন্য অভিভাবক এবং সমাজের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য।
 
শীতকালে শিশুদের জন্য প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকি
 
শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম হওয়ায় তারা সহজেই সংক্রমণ এবং বিভিন্ন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। শীতকালে সাধারণত দেখা যায় নিম্নলিখিত স্বাস্থ্য সমস্যা:
 
১. ঠান্ডা লাগা ও সর্দি-কাশি
ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে শিশুদের নাক, গলা এবং ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
 
২. জ্বর ও ইনফ্লুয়েঞ্জা
হঠাৎ জ্বর বা শীতলজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
 
৩. শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া
বিশেষ করে যেসব শিশুর দম-কষ্ট, অ্যাজমা বা অ্যালার্জি আছে তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেশি।
 
৪. ত্বক শুকিয়ে যাওয়া ও চর্মরোগ
শুষ্ক আবহাওয়া শিশুর ত্বককে রুক্ষ এবং সংবেদনশীল করে তোলে, যা চর্মরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
 
৫. পুষ্টি ঘাটতি
শীতকালে শিশুদের খাবারের অভ্যাস পরিবর্তিত হতে পারে। পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
 
শীতকালে শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায় করণীয়
 
শিশুদের শীতকালীন স্বাস্থ্য রক্ষা করতে অভিভাবকরা কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সেগুলো হলো:
 
১. সঠিক পোশাক পরানো
 
শিশুকে শীতকালে উষ্ণ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বহুস্তরীয় পোশাক ব্যবহার করা উচিত। যেমন: আভ্যন্তরীণ তুলো বা কটন শার্ট, মধ্যস্তর উষ্ণ সোয়েটার, এবং বাহ্যিক স্তর ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট।
মাথা, হাত ও পা উষ্ণ রাখতে টুপি, দস্তানা ও মোজা ব্যবহার করুন।
ঘরের ভিতরে খুব বেশি গরম রাখার পরিবর্তে ছোট স্তর ব্যবহার করলে শিশুর শরীর স্বাভাবিকভাবে উষ্ণ থাকে।
 
২. পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা
 
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সঠিক খাদ্য অপরিহার্য।
ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাবার: দই, ফলমূল, সবজি, ডিম, মাছ ও মাংস।
পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খাওয়ানো।
চিনি ও ফাস্টফুডের অতিরিক্ত ব্যবহার এড়ানো।
 
৩. হাত ধোয়া ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা
 
শিশুরা সহজেই ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের শিকার হয়।
খাবার আগে এবং বাইরে থেকে ফিরে হাত ধোয়ার অভ্যাস করানো।
নাক বা মুখ স্পর্শ করা এড়ানো।
শীতকালে শিশুদের জুতো, জামা ও অন্যান্য পোশাক নিয়মিত পরিষ্কার রাখা।
 
৪. শারীরিক ব্যায়াম ও খেলাধুলা
 
শিশুর শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত খেলাধুলা ও ব্যায়াম জরুরি।
ঘরের ভিতরে বা নিরাপদ জায়গায় দৌড়ঝাঁপ ও লাফালাফি।
পর্যাপ্ত সূর্যের আলো নেওয়া, যা ভিটামিন ডি উৎপাদনে সহায়ক।
 
৫. ঘরের পরিবেশ ও উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ
 
শীতকালে ঘরের সঠিক উষ্ণতা শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ঘর খুব বেশি গরম বা ঠান্ডা রাখা উচিত নয়।
আদ্রতা বজায় রাখতে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে।
ধূমপান ও ধোঁয়া সম্পূর্ণভাবে এড়ানো।
 
৬. রোগের প্রাথমিক লক্ষণ চিহ্নিত করা
 
শিশুদের শীতকালীন রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
হঠাৎ জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা দীর্ঘস্থায়ী কাশি দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।
নাক দিয়ে নির্গমনের রঙ পরিবর্তন বা ত্বকে অস্বাভাবিক রঙ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা।
শিশু ঘুমাতে অস্বস্তি বা কম খেলাধুলা করলে সতর্ক হওয়া।
 
৭. টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করা
 
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে টিকা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা শীতকালের আগে দেওয়া।
অন্যান্য শিশু টিকা যেমন পোলিও, ডিপথেরিয়া, কাশি, টিটানাস আপডেট থাকা।
 
৮. মানসিক ও সামাজিক যত্ন
 
শিশুর মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা বজায় রাখা শারীরিক যত্নের সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
শীতকালে শিশুর সঙ্গে গেম, গল্প এবং সময় কাটানো।
সামাজিক যোগাযোগ সীমিত হলেও পরিবারের সঙ্গে গুণগত সময় কাটানো।
শিশুর নিরাপদ ও সুখী পরিবেশ নিশ্চিত করা।
 
অভিভাবকের দায়িত্ব
 
শিশুদের সুস্থ রাখতে অভিভাবকরা নিয়মিতভাবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য করবেন:
শিশুর শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করা।
শিশুর শারীরিক কার্যকলাপ এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়মিত নজর রাখা।
শীতকালীন অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা মাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
শিশুর খেলাধুলা এবং ঘরের উষ্ণতা ঠিক রাখা।
স্কুল ও সমাজে শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া।
 
পরিশেষে বলতে চাই,বিশ্ব শিশু দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে শিশুদের সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সমাজের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। বিশেষ করে শীতকালে শিশুরা সংক্রমণ ও বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিতে থাকে। তাই অভিভাবক এবং সমাজের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য।
 
শিশুদের সঠিক পোশাক, পুষ্টিকর খাদ্য, পরিচ্ছন্নতা, টিকা এবং পর্যাপ্ত খেলাধুলা তাদের শীতকালীন স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়ক। সুস্থ শিশুরা ভবিষ্যতে সমাজ ও জাতিকে শক্তিশালী এবং স্বাস্থ্যবান রাখে।
 
শিশুদের প্রতিটি শীতকালের দিনকে নিরাপদ, উষ্ণ এবং আনন্দময় করে তোলা আমাদের সকলের দায়িত্ব। তাদের সুস্থতা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং শক্তিশালী জাতি গঠনের মূল চাবিকাঠি।
 
লেখক: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল:drmazed96@gmail.com
 
এলএইস/