ইতালি যাওয়ার পথে গুলিতে মাদারীপুরের তিন যুবক নিহত
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০৬:১৪ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ার দালালদের গুলিতে মাদারীপুরের তিন যুবক নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) রাতে উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের দালাল সেলিম খান তাদের মৃত্যুর খবর পরিবারের সদস্যদের জানান।

নিহতরা হলেন- মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের হাজী মো. তৈয়ব আলী খানের ছেলে ইমরান খান (২২), রাজৈর উপজেলার দুর্গাবদ্দী গ্রামের ইমারত তালুকদারের ছেলে মুন্না তালুকদার (২৪), একই উপজেলার ঘোষলাকান্দি গ্রামের কুদ্দুস শেখের ছেলে বায়েজিত শেখ (২০)।

অভিযুক্ত দালাল হলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের লালু খানের ছেলে শিপন খান ও তার বড় ভাই সেলিম খান।

স্থানীয় ও নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২২ লাখ টাকায় সরাসরি ইতালি পৌঁছে দেবে এমন শর্তে প্রতিবেশী ও মানবপাচারচক্রের সদস্য মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের লালু খানের ছেলে শিপন খান ও তার বড় ভাই সেলিম খানের সঙ্গে চুক্তি হয়। এই দুজনের মধ্যে শিপন খান লিবিয়ায় থাকেন আর দেশে থাকেন তার বড় ভাই সেলিম খান। দেশের সব কাজ ও লেনদেন করেন সেলিম খান। লিবিয়ায় বাকি কাজ করেন শিপন।

তাদের সঙ্গে চুক্তির টাকা দেওয়ার পর গত ৮ অক্টোবর ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইমরান খান বাড়ি ছাড়েন। ইমরান লিবিয়ায় পৌঁছলে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এরপর তার মুক্তির জন্য পরিবার থেকে আরও ১৮ লাখ টাকা নেয় দালালরা। সবশেষ ১ নভেম্বর ইমরান তার মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেন। তখন ইমরান জানান, তাকে সেখানে অনেক নির্যাতন করা হচ্ছে। জানেন না কী হবে। এ ঘটনার ১৮ দিন পর মঙ্গলবার রাতে দালাল সেলিম খান জানান ইমরান পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন।

শুধু ইমরান নন, একইভাবে গুলিতে একইদিন মারা যান জেলার রাজৈর উপজেলার দুর্গাবদ্দী গ্রামের মুন্না তালুকদার ও একই উপজেলার ঘোষলাকান্দি গ্রামের বায়েজিত শেখ। এদিকে ঘটনা জানাজানি হলে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন দালাল পরিবারের সদস্যরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানান, কয়েক বছর ধরে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন শিপন। তিনি সেখানে বসেই মানবপাচারের কাজ করেন। দেশে বসে শিপনের বড় ভাই সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যরা এলাকার যুবকদের খুব সহজে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখায়। সরাসরি ইতালি নেওয়ার কথা বলে ফাঁদে ফেলেন। শিপন লিবিয়ায় থাকেন বলে অনেকে সহজেই ব্যাপারটি বিশ্বাস করেন। এর আগেও তাদের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার পথে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। মূলত তারা লিবিয়ার দালালদের ঠিকমতো টাকা দেয় না। নিজেরাই টাকা নিয়ে নেন। তাই লিবিয়ার মাফিয়াচক্র টাকা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের মেরে ফেলেছে। এই দালালচক্রের সঠিক বিচার না হলে আরও অনেক যুবকের প্রাণ যাবে।

ইমরানের বড় বোন ফাতেমা আক্তার বলেন, শিপন দালাল আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। এই দালালের কঠিন বিচার চাই। সরকারের কাছে দাবি, আমার ভাইয়ের মরদেহটি যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়। যাতে একবারের জন্য হলেও আমরা তাকে দেখতে পাই।

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রথমে কেউ জানি না, শিপনের প্রলোভনে আমার ভাই ইতালি যাবে বলে সব ঠিক করেছিল। পরে আমাদের জানান। তখন শিপন আর তার ভাই সেলিমের সাথে আমরা কথা বলি। তারা বলেছিলেন আমার ভাইকে সরাসরি ইতালি নিয়ে যাবে। ভালো হোটেলে রাখবে, ভালো খাওয়াবে। কিন্তু তারা তা করেনি। লিবিয়ায় নিয়ে অনেক নির্যাতন করেছে। আমার ভাইকে বাঁচানোর জন্য সব জমি বিক্রি করে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছি। এখন আমাদের থাকার এই বাড়িটি ছাড়া কিছুই নেই। ঋণ করেও টাকা দিয়েছি। তবুও ওরা আমার ভাইকে গুলি করে মেরে ফেললো। আসলে শিপন আর সেলিম সব টাকা একাই খেয়ে ফেলেছে। তাই টাকা না পেয়ে লিবিয়ার দালালরা গুলি করে ভাইকে মেরে ফেলেছে। আমি শিপন আর সেলিমের ফাঁসি চাই।

ইমরান খানের মা রেহেনা বেগম বলেন, আমার একটাই ছেলে, ৪০ লাখ টাকা দিয়েও ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না, আমার আর তো কিছুই থাকলো না। আমার তো সব শেষ হয়ে গেলো। আমি দালালদের ফাঁসি চাই।

এদিকে নিহত মুন্নার খালা খাদিজা আক্তার বলেন, দালাল শিপনকে ধারদেনা করে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছি। আমরা ভাগিনার মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এই দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। পাশাপাশি মুন্নার মরদেহ দেশে ফিরিতে আনতে সরকারের কাছে দাবি জানাই।

নিহত বায়েজিতের বাবা কুদ্দুস শেখ বলেন, আমার ছেলের এমন মৃত্যু কিভাবে মেনে নিবো। দালাল প্রথমে স্বীকার করেনি। পরে লিবিয়া থেকে আমাদের জানানো হয়। এই দালাল এখন পালিয়েছে। এতগুলো টাকা দিয়ে ছেলের এমন মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না।

দালাল শিপনের চাচী সেতারা বেগম বলেন, শিপন অনেক মানুষকেই ইতালি নিয়েছে। কিন্তু গুলিতে কেউ মারা গেছে বা কাউকে গুলি করে মেরে ফেলেছে এই ঘটনা আমরা এর আগে কখনই শুনিনি।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লিবিয়ায় গুলিতে তিন যুবকের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এই ঘটনায় নিহতের পরিবার থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরএইচ/