
|
বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস ২০২৫: জীবন রক্ষায় সচেতনতার নতুন অঙ্গীকার
প্রকাশ:
১৬ নভেম্বর, ২০২৫, ০৮:২৬ রাত
নিউজ ডেস্ক |
||ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ||
১৭ নভেম্বর (সোমবার) বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস ২০২৫। বিশ্বব্যাপী নবজাতকের মৃত্যুহারের অন্যতম কারণ হলো প্রিম্যাচিওর বা অপরিণত শিশু জন্ম। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যাটি আরও ভয়াবহভাবে দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে প্রতি পাঁচজন নবজাতকের একজন অপরিণত জন্মজনিত জটিলতার কারণে মারা যায়। ফলে নবজাতক মৃত্যুহার কমাতে জন্মের পরপরই অপরিণত ও কম ওজনের শিশুদের ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখ শিশু প্রিম্যাচিওর জন্মায়। বৈশ্বিকভাবে এই সংখ্যা প্রায় ১৫০ লাখ। প্রতি ১০টি নবজাতকের মধ্যে একটি শিশু সময়ের আগে জন্মায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো প্রিটার্ম বার্থ। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ শিশু শুধু অপরিণত জন্মের কারণেই মারা যায়। তাই প্রিম্যাচিওর জন্ম, এর ঝুঁকি ও জটিলতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজন, যার লক্ষ্যেই বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস পালিত হয়।
বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যুহার ৩১ এবং নবজাতক মৃত্যুহার ২০। এর মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ মৃত্যুর পেছনে অপরিণত ও কম ওজনের শিশুর ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট জন্মগ্রহণকারী শিশুর ১৯.১ শতাংশই অপরিণত—যা তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বেশি।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যুহার ২৫-এ এবং নবজাতক মৃত্যুহার ১২-এ নামিয়ে আনতে হলে অপরিণত শিশুদের চিকিৎসা, পরিচর্যা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আরও জোরদার করা জরুরি।
প্রিম্যাচিওর বেবি বলতে কী বোঝায়?
গর্ভধারণের নির্ধারিত সময় ৩৮–৪২ সপ্তাহ। এই সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুকে বলা হয় ‘প্রিম্যাচিওর’। চিকিৎসাবিজ্ঞানে দুটি মানদণ্ড ব্যবহৃত হয়—
১. ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম → প্রিম্যাচিওর
২. EDD–এর ৩ সপ্তাহ আগে জন্ম → অপরিণত।জন্মের সময়কাল ও ওজনের ওপর শিশুর ঝুঁকি নির্ভর করে। ১৫০০ গ্রাম-এর কম ওজন হলে তাকে Preterm Low Birth Weight বলা হয়।
প্রিম্যাচুরিটি ডে-এর ইতিহাস
২০০৮ সালে ইউরোপীয় ফাউন্ডেশন ফর কেয়ার অফ নিউবর্ণ ইনফ্যান্টস (EFCNI) এবং বিভিন্ন অভিভাবক সংগঠন একত্রে প্রথম ১৭ নভেম্বরকে প্রিম্যাচিওরিটি ডে হিসেবে ঘোষণা করে। বিশেষ একটি আবেগঘন ঘটনার সঙ্গে এই তারিখটি যুক্ত—EFCNI–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের সন্তান এই দিনে জন্ম নিলেও পূর্ববর্তী সন্তানকে তিনি হারিয়েছিলেন প্রিম্যাচিওর জটিলতায়।
২০১১ সাল থেকে দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। বর্তমানে ৬০টিরও বেশি দেশ এ উদ্যোগে যুক্ত।
দিনটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বজুড়ে প্রিম্যাচিওর জন্মের হার বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। বিশেষ করে—* অযাচিত সিজারিয়ান বৃদ্ধি
* চিকিৎসকের আগাম সিদ্ধান্ত * পরিবারের ভয় ও চাপ * গর্ভবতী মায়েদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা
বাংলাদেশেও নির্ধারিত সময়ের আগেই সিজারিয়ান করার প্রবণতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে, যার ফলেও প্রিম্যাচিওর শিশুর সংখ্যা বাড়ছে।
‘লেট প্রিটার্ম’ (৩৪–৩৭ সপ্তাহ) শিশুর জটিলতা কম হলেও ৩২ সপ্তাহ বা তার আগে জন্ম নেওয়া শিশুর ঝুঁকি বেশি—* হার্টের সমস্যা * শ্বাসকষ্ট
* মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ * দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি * শ্রবণ ক্ষমতা কমে যাওয়া
* শেখার সমস্যা।
উন্নত দেশে ২৫–২৬ সপ্তাহেও ‘মাইক্রো প্রিমি’ শিশুকে NICU–তে বাঁচিয়ে তোলার সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে এ সুবিধা সীমিত হলেও উন্নতি দ্রুত হচ্ছে।
স্ক্রিনিং (ROP Screening): অপরিণত শিশুর জন্য জীবনরক্ষাকারী পরীক্ষা
ROP – Retinopathy of Prematurity এমন একটি রোগ যা জন্মের সময় থাকে না, কিন্তু জন্মের ৩–৪ সপ্তাহের মধ্যে দ্রুত বাড়ে।
স্ক্রিনিংয়ের সময়সীমা—
৩৫ সপ্তাহের আগে জন্ম + ওজন < ২০০০ গ্রাম → ৩০ দিনের মধ্যে ROP পরীক্ষা
২৮ সপ্তাহের আগে জন্ম + ওজন < ১২০০ গ্রাম → ২০ দিনের মধ্যে বাধ্যতামূলক স্ক্রিনিং একদিন দেরিতেও শিশুর দৃষ্টিশক্তি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
অপরিণত শিশুর জন্মের কারণ
গবেষণায় পাওয়া যায়, প্রায় ৫০টিরও বেশি কারণ প্রিম্যাচিওর জন্মে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রধান কারণগুলো— * ডায়াবেটিস * উচ্চ রক্তচাপ বা প্রি-এক্লাম্পসিয়া * মাল্টিপল প্রেগনেন্সি * জরায়ুর সংক্রমণ * মূত্রনালীর সংক্রমণ
* ধূমপান * মানসিক চাপ * অপুষ্টি
* অতিরিক্ত ওজন কম থাকা
* প্লাসেন্টা প্রিভিয়া * অ্যাবরাপসিও প্লাসেন্টা * দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করা * ১৮ বছরের কম বা ৩৫ বছরের বেশি বয়সে গর্ভধারণ।অনেক সময় কোনো কারণ না পেলেও প্রিম্যাচিওর জন্ম ঘটতে পারে।
অপরিণত শিশুর সাধারণ জটিলতা
* শ্বাসকষ্ট * কম ওজন * দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে না পারা
* বুকের দুধ খেতে সমস্যা * খিঁচুনি
* ফ্যাকাশে বা হলুদ ত্বক * হার্ট ফেইলিওর * ডিহাইড্রেশন * জীবন-সংকটজনক জটিলতা—* ব্রেইন হেমোরেজ * পালমোনারি হেমোরেজ
* হাইপোগ্লাইসেমিয়া * নিউমোনিয়া
* অ্যানিমিয়া।
প্রিম্যাচিওর জন্ম প্রতিরোধে করণীয়
১. প্রাইমারি কেয়ার
* গর্ভাবস্থায়— ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
* অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ * সংক্রমণ চিকিৎসা * পুষ্টিকর খাবার * নিয়মিত প্রেনাটাল চেকআপ।এসব নিশ্চিত করলে প্রিম্যাচিওর জন্ম ৩০–৪০% কমানো সম্ভব।
২. সেকেন্ডারি কেয়ার
প্রি-টার্ম লেবার শুরু হলে_* টকোলাইটিক এজেন্ট দিয়ে কিছুদিন প্রসব বিলম্ব * অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া
* মায়ের বিশ্রাম * পানি–লবণ ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ
৩. টারশিয়ারি কেয়ার
* কর্টিকোস্টেরয়েড দিয়ে শিশুর ফুসফুস পরিণত করা * NICU প্রস্তুত রাখা * মায়ের বয়স, স্বাস্থ্য, গর্ভকাল—সব বিবেচনায় সিদ্ধান্ত
জনসচেতনতা বাড়ানোর উপায়
* সেমিনার * ক্যাম্পেইন * অভিভাবক প্রশিক্ষণ * গণমাধ্যম প্রচার * সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য ছড়ানো * হাসপাতালভিত্তিক KMC প্রশিক্ষণ।বাংলাদেশে অনেক হাসপাতাল এখন ROP স্ক্রিনিং ও KMC বিষয়ক ওরিয়েন্টেশন দিচ্ছে, যা ইতিবাচক অগ্রগতি।
হোমিওসমাধান: অপরিণত নবজাতক
অপরিণত শিশুর বিভিন্ন জটিল সমস্যা ব্যবস্থাপনায় হোমিওপ্যাথি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিক মায়াজমিক বিশ্লেষণ (PTS, PRS, জেনেটিক ও পারিবারিক ইতিহাস) অনুযায়ী ওষুধ নির্বাচন করা হয়। রোগীর রোগের লক্ষণ অনুযায়ী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক গন প্রাথমিকভাবে যেই সব ঔষধ নির্বাচন করে থাকে,
থুজা, মেডোরিনাম, সিফিলিনাম, টিউবারকুলিনাম, সোরিনাম, সালফার, ক্যালকেরিয়া কার্ব, ক্যালকেরিয়া ফস, ক্যালকেরিয়া ফ্লোর, কস্টিকাম, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া, মার্কসল, ন্যাট্রাম মিউর, ন্যাট্রাম সালফ।তাই নিজে নিজে ওষুধ না খাইয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
পরিশেষে,অপরিণত শিশুর জন্ম শুধু শিশুর জীবনে নয়, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক বাস্তবতা, তথ্যের অভাব ও ভয়—সব মিলিয়ে এ এক অসহায় সংগ্রাম। আবার অপরিণত শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশও অন্যদের চেয়ে ভিন্ন।
তবুও সঠিক চিকিৎসা, সময়মতো পরিচর্যা, পরিবার–সমাজের সহানুভূতি এবং চিকিৎসা প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে প্রিম্যাচিওর শিশুরাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে—বরং জীবনে অসাধারণ সাফল্যও অর্জন করতে পারে।
অপরিণত শিশুদের অনেকেই পরবর্তীতে বিজ্ঞানী, লেখক, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজনেতা—অগণিত মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। সময়মতো যত্ন পেলে তারাই হতে পারে আগামী দিনের দৃঢ় নায়ক—যারা পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার শক্তি রাখে।
লেখক: চিকিৎসক ও কলাম লেখক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
এলএইস/
|