
|
আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস: সহনশীলতা ছাড়া শান্তি অসম্ভব
প্রকাশ:
১৫ নভেম্বর, ২০২৫, ০৫:৪২ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
||ডা. মু. মাহতাব হোসাইন মাজেদ|| মানব সভ্যতার ইতিহাসে সহনশীলতা সব সময়ই সমাজের ভিত্তি হয়ে এসেছে। ভিন্ন মতামত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতি, এমনকি ভিন্ন জীবনধারাকে সম্মান জানানোই সহনশীলতার মূল। প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব পরিচয় ও মূল্যবোধের অধিকার রাখে, এবং অন্যকে একই অধিকার দেওয়াই মানবিকতার চিহ্ন।
আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস প্রথমবারের মতো ২০০২ সালের ১৬ নভেম্বর ইউনাইটেড নেশনস (জাতিসংঘ) কর্তৃক ঘোষণা করা হয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সহনশীলতা কোনো ঐশ্বরিক অনুদান নয়; এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। সহনশীল সমাজই শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মানবিকতার দিকে এগিয়ে যায়।
সহনশীলতা মানে শুধু অন্যকে ক্ষমা করা নয়; এটি সক্রিয়ভাবে চর্চা করতে হয়। এটি হল অন্যের মতামত, বিশ্বাস এবং অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া। একজন সহনশীল মানুষ কেবল নিজের মত প্রকাশ করে না, সে অন্যের কথা ও ভাবনাকেও গ্রহণযোগ্য মনে করে। পার্থক্য মানেই বিভাজন নয়, বরং এটি আমাদের শক্তি হতে পারে।
আজকের বিশ্বে আমরা নানা ধরনের বৈষম্য ও সংঘাতের সাক্ষী। ধর্মীয় হিংসা, জাতিগত বৈষম্য, সামাজিক অবহেলা—সবই সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই প্রেক্ষাপটে সহনশীলতা কেবল নৈতিক গুণ নয়; এটি অপরিহার্য সামাজিক কৌশল। পার্থক্যগুলোকে গ্রহণ করে আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ তৈরি করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, একটি সম্প্রদায়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একসাথে বাস করে এবং একে অপরের উৎসব ও রীতিনীতি সম্মান করে, সেখানে সংঘাতের সম্ভাবনা কম থাকে এবং সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়।
শিক্ষা ক্ষেত্রে সহনশীলতার গুরুত্ব অপরিসীম। যখন একজন মানুষ ছোটবেলা থেকে শেখে যে, অন্যের মতামত বা ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি, তখন সে সমাজে হিংস্রতা ও দ্বন্দ্ব কমাতে পারে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সহনশীলতার শিক্ষা দেওয়া মানে ভবিষ্যতের নেতৃত্বকে মানবিক ও সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলা। শিক্ষার্থীরা যদি শিখে যে বিতর্ক বা দ্বন্দ্বের সময় শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধান করা যায়, তাহলে সমাজে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা ভিন্ন মতামতের উপর আলোচনা করে এবং একে অপরের যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে করে, তখন তারা শিখে যায় যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব।
সহনশীলতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ নয়; এটি রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুত্বপূর্ণ। জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য মানেই সংঘাত ঘটবে এমন নয়। বরং, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সম্প্রদায় যদি একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করে, তাহলে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখা সম্ভব। আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সংলাপ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন দেশের মানুষ একে অপরের সংস্কৃতি ও রীতিনীতিকে বোঝার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে পারে।
একটি সহনশীল সমাজে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমঝোতার বীজ বপন হয়। একজন ব্যক্তি যখন নিজের মতামত প্রকাশ করতে স্বাধীন হয় এবং অন্যের মতও সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, তখন সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। সহনশীলতা কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়; এটি মানসিক সুস্থতা এবং সামাজিক উন্নয়নেরও ভিত্তি। উদাহরণস্বরূপ, একটি ছোট গ্রামের মানুষ যখন একে অপরের বিভিন্ন মতামতকে স্বাগত জানায়, তখন সামাজিক সমস্যা সমাধান দ্রুত হয় এবং গ্রামের মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হয়।
আধুনিক বিশ্বের নানা চ্যালেঞ্জ যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন সমস্যা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলায় সহনশীলতা কার্যকরী হাতিয়ার। পার্থক্য মেনে নেওয়া এবং একে অপরকে সহায়তা করা বড় সমস্যাগুলো সমাধানে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, একাধিক দেশের মানুষ পরিবেশ রক্ষা বা মানবিক সাহায্য কার্যক্রমে মিলিত হলে বৃহত্তর সাফল্য অর্জন সম্ভব।
ধর্মীয় সহনশীলতার গুরুত্বও অপরিসীম। বিশ্বে নানা ধর্মের মানুষ বাস করে। ধর্মের নামে সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘ, কিন্তু সহনশীলতা শেখায় যে প্রতিটি ধর্মের মূল উদ্দেশ্য শান্তি, ভালোবাসা এবং মানবিকতা প্রচার করা। অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান দেখানো মানে নিজের ধর্মেরও মর্যাদা বজায় রাখা। উদাহরণস্বরূপ, একটি শহরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করলে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয় এবং সহনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।
সহনশীলতা সামাজিক ন্যায় এবং মানবাধিকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যখন সমাজে নির্যাতিত বা অবহেলিত মানুষদের কথা শোনা হয়, তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়, তখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রসারিত হয়। এটি সমাজের দুর্বল এবং অবহেলিত সদস্যদের সুরক্ষা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, নিপীড়িত গোষ্ঠীকে সমান অধিকার প্রদানের মাধ্যমে সংহতি ও সমতা বজায় রাখা যায়।
পরিবার হল সহনশীলতার প্রথম বিদ্যালয়। শিশু যখন বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিখে যে পার্থক্যকে গ্রহণ করা উচিত এবং সহমর্মিতা দেখানো উচিত, তখন সে বড় হয়ে সমাজে সহানুভূতিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। পরিবারে সহনশীলতার শিক্ষা দেওয়া মানে সমাজে শান্তি, সম্মান এবং সমঝোতার ভিত্তি স্থাপন করা।
সহনশীলতা শুধু নৈতিক চেতনা নয়; এটি একটি চর্চা। দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট কাজেও অন্যকে সম্মান করা সহনশীলতার চর্চা। রাস্তার যাত্রা, কর্মক্ষেত্র, বাজার কিংবা সামাজিক মেলায়—প্রতিটি ক্ষেত্রেই সহনশীলতা প্রদর্শিত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পার্থক্যকে বিভাজনের হাতিয়ার নয়, শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। লক্ষ্য হওয়া উচিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, যেখানে প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে নিজের পরিচয় ধরে রাখতে পারে এবং অন্যের পরিচয়কেও সম্মান করতে পারে। সহনশীলতা মানুষকে সংহতি এবং সমঝোতার পথ দেখায়। এটি শেখায় যে বিতর্কে জয়লাভের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা। মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক চেতনা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা সব সময় সমাজকে শক্তিশালী করে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন এক গ্রামে ধর্মীয় উৎসব এবং সামাজিক অনুষ্ঠান একসাথে উদযাপন করা হয়, তখন গ্রামের মানুষরা শিখে যায় যে পার্থক্য মানেই শত্রুতা নয়। বরং এটি নতুন বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং সামাজিক বন্ধনের ভিত্তি হতে পারে। আরেকটি বাস্তব উদাহরণ হলো, আন্তর্জাতিক সহনশীলতা কার্যক্রমে অংশ নেওয়া তরুণরা বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি এবং জীবনধারার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখে, যা তাদের ভবিষ্যতের নেতৃত্বকে মানবিক ও বুদ্ধিমান করে তোলে।
সহনশীলতা মানব সমাজের মেরুদণ্ড। এটি ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত শান্তি, সম্মান এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। এটি শুধু অন্যকে ক্ষমা করা নয়; সক্রিয়ভাবে বোঝা, শ্রদ্ধা করা এবং শান্তিপূর্ণভাবে পার্থক্য মেনে নেওয়াই সহনশীলতার চূড়ান্ত চর্চা।
শেষ পর্যন্ত, সহনশীলতা কেবল একটি নৈতিক মূল্যবোধ নয়, এটি একটি জীবনধারা। এটি শেখায় যে, ভিন্নতার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়, শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ তৈরি করা যায় এবং মানবিকতা ও সহমর্মিতা বাড়ানো সম্ভব। সহনশীলতা সমাজের শক্তি, শান্তি ও সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি।
লেখক: কলাম লেখক ও প্রবন্ধকার
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
এলএইস/
|