
|
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৬ হাজার ফিলিস্তিনির অঙ্গচ্ছেদ, শিশুরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত
প্রকাশ:
১২ নভেম্বর, ২০২৫, ০৯:৪৬ সকাল
নিউজ ডেস্ক |
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের টানা দুই বছরের সামরিক আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই উপত্যকায় এখন মানবিক বিপর্যয় চরমে। হাজার হাজার মানুষ কেবল প্রিয়জনই হারাননি, হারিয়েছেন নিজেদের শরীরের অংশও। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত অন্তত ৬ হাজার ফিলিস্তিনি অঙ্গচ্ছেদ হয়েছেন—যার এক-চতুর্থাংশই শিশু। এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান কেবল যুদ্ধের নিষ্ঠুরতাই নয়, এক প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ধ্বংসেরও ইঙ্গিত দেয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার সূত্রপাত ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে, যখন ইসরায়েল গাজায় টানা বিমান ও স্থল হামলা শুরু করে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই আগ্রাসনে শহরগুলো পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে, হাসপাতাল ও ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি ছিল হামাসকে দমন করা, কিন্তু বাস্তবে তার সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ—বিশেষ করে নারী ও শিশু। মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫-এ তুরস্কভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আনাদোলু তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই ভয়াবহ অঙ্গচ্ছেদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, অঙ্গচ্ছেদের শিকারদের মধ্যে ২৫ শতাংশ শিশু এবং ১২ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। অর্থাৎ, গাজার আহতদের বড় অংশই সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও নিরীহ শ্রেণি—যারা যুদ্ধ বুঝে না, কেবল এর নিষ্ঠুরতা ভোগ করে। হাসপাতালগুলো এখন পরিণত হয়েছে কষ্টের আশ্রয়কেন্দ্রে। আহতদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা কার্যত হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ এবং কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির উপকরণ ভয়াবহভাবে ঘাটতি পড়েছে। গাজার হাসপাতালগুলোতে আজ সবচেয়ে বড় সমস্যা চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সহায়ক উপকরণের অভাব। যুদ্ধবিরতি চললেও ইসরায়েলের অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে হাজারো আহত মানুষ পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন না, অনেকের ক্ষত সংক্রমিত হয়ে নতুন করে জীবনহানির আশঙ্কা তৈরি করছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, আহতদের পুনর্বাসন ও অঙ্গচ্ছেদ হওয়া মানুষদের জন্য মানসিক এবং সামাজিক সহায়তা এখন একান্ত জরুরি। বিশেষ করে যেসব শিশুরা শৈশবেই শরীরের অঙ্গ হারিয়েছে, তাদের মানসিক ট্রমা থেকে মুক্ত করতে আন্তর্জাতিক সাহায্য অপরিহার্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই পরিসংখ্যানগুলো গাজায় হাজারো আহত মানুষ ও তাদের পরিবারের গভীর মানবিক যন্ত্রণাকেই সামনে তুলে ধরে।” বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, আহতদের বড় অংশ এখন ঘরে বা আশ্রয়কেন্দ্রে অচল হয়ে পড়ে আছেন। অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনই আহত, শিশুদের কেউ দেখাশোনা করার নেই। এমন অবস্থায় মানবিক সহায়তার পাশাপাশি পুনর্বাসন কর্মসূচি না হলে, এই প্রজন্ম শারীরিক ও মানসিকভাবে স্থায়ীভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ এখন পর্যন্ত গাজায় ৬৯ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু ঘটিয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার ৬০০ জন। তাদের অনেকের শরীরে চিরস্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রায় ৯ হাজার ৫০০ মানুষ এখনো নিখোঁজ, যাদের অনেকে ধসে পড়া ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিদিনই উদ্ধারকাজের সময় নতুন নতুন মৃতদেহ বা বিকলাঙ্গ জীবিত মানুষ উদ্ধার হচ্ছে। গাজার যুদ্ধ এখন শুধুমাত্র একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়, এটি এক ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। অঙ্গচ্ছেদ হওয়া হাজারো মানুষ এখন হুইলচেয়ার বা কাঠের ক্রাচের ওপর নির্ভরশীল। তাদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, এখন সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছেন। শিশুরা স্কুলে ফিরতে পারছে না, অনেকেই পড়াশোনা বন্ধ করেছে। চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভাবে তারা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক মহল এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, সহায়তা পৌঁছাতে পারছে না অবরোধকৃত গাজায়। চিকিৎসা সরঞ্জাম, খাদ্য ও জ্বালানির অভাবে প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গাজার এই পরিস্থিতি এখন “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” হিসেবে তদন্তের দাবি রাখে। তথ্যসূত্র : আনাদোলু এজেন্সি এনএইচ/ |