
|
মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী আমাদের আলোকবর্তিকা, সাহসের ঠিকানা
প্রকাশ:
০৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০৭:২৭ সকাল
নিউজ ডেস্ক |
মুফতি এনায়েতুল্লাহ ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাজায়ে মওত কার্যকর করা হয়। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাবেক মন্ত্রী ও ছয়বারের এমপি এই বিএনপি নেতার জানাজা পড়ান হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। তখন তিনি হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ছিলেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ি সংলগ্ন মসজিদের পাশে তার জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এ সময় বাড়ির আশেপাশে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির কড়া প্রহরা ছিল। মাওলানা বাবুনগরীকেও জানাজায় আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে, তবুও তিনি এসেছেন এবং জানাজা পড়িয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর মন্তব্য ছিলো, ‘আমাদের কপাল অনেক ভালো, আব্বার জানাজা আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সাহেব পড়িয়েছেন!’ মাওলানা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। দেশের অন্যতম বর্ষীয়ান আলেম। ফটিকছড়ির আল জামিয়া ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদরাসা মুহতামিম। তাকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। তবে তার সাহসি কিছু কাজের আলোচনা হওয়া দরকার। তরুণ প্রজন্মের অনেক আলেম তার সম্পর্কে না জেনে যেভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য করেন, এ সময়ে এটা বেশ জরুরি। মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী দেশের ধর্মীয় অভিভাবকে হিসেবে নিজের জায়গা এমনি এমনি পাননি, তার রয়েছে দীর্ঘ স্পষ্ট অবস্থান। যেটা তার শক্তি। লেখার শুরুতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জানাজা পড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তিনি জানতেন- তার সমস্যা হতে পারে, কিন্তু না- তিনি সবকিছু উপেক্ষা করে জানাজ পড়িয়েছেন। তেমনি ২০১৮ সালে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আওয়ামী এজেন্টদের সঙ্গে আমি নেই’ ঘোষণা দিয়ে ইসলামী ঐক্যজোট এবং হেফাজতে ইসলামের পদ ছেড়ে দেন। এ সময় তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির ও ইসলামী ঐক্যজোটের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। পদ ছাড়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী জাতীয় এক দৈনিকে দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ২০১৮। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম উলামায়ে কেরামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। যে সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল ১৩ দফা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর যে আইন-কানুন করেছেন এগুলো ইসলামবিরোধী। সেগুলো পরিবর্তন করার জন্য আলেম-উলামা মিলে আন্দোলন শুরু করেন। এ নিয়ে শেখ হাসিনার সাথে গণভবনে বৈঠক হয়। এতে ৬৮ জন আলেমসহ আমরা গিয়েছিলাম। শেখ হাসিনা কিছু কিছু দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য দাবি দিলে শেখ হাসিনা নিজেই বলেন, এ শিক্ষা ছাড়া নৈতিক চরিত্র গঠন সম্ভব হয় না। তাই আমি সর্বস্তরে ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করবো। কিন্তু এরপরে যা ছিল তাও বন্ধ করে দিয়েছেন। আমাদের ১৩ দফার একটিও মানেননি। এরমধ্যে কওমি সনদের স্বীকৃতির কথা উঠে আসে। ওলামাদের কেউ তা চাইলেও কেউ কেউ চাননি। শেষে সবাই একত্রিত হয়ে শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে স্বীকৃতির দাবি তুললে তিনি তা দেয়ার আশ্বাস দেন এবং স্বীকৃতিও দিয়েছেন। যারা স্বীকৃতির বিরুদ্ধে ছিল তাদের মত হচ্ছে- এগুলো দেওবন্দী মাদরাসা। দেওবন্দী উসুলে সরকারি স্বীকৃতি নেয়ার কোন নজীর নেই। এটি উসুলের খেলাপ- এ জন্যই তারা বিরোধীতা করেন। তারপরও সবাই যেহেতু স্বীকৃতি নিচ্ছেন- বিরোধীরাও চুপ মেরে থাকেন। এ স্বীকৃতি পাওয়ার পর হেফাজতের ১৩ দাবির কোন কথা আর বলা হচ্ছে না। এখন হেফাজতের মুরব্বীরা স্বীকৃতি পেয়ে হাসিনার পক্ষে কথা বলা শুরু করেছেন। সংবর্ধনা দিচ্ছেন, এটি দিচ্ছেন ওটি দিচ্ছেন। ১৩ দাবির কোনটি তো পূরণ করেননি। সে গুলো নিয়ে কথাও বলা হচ্ছে না। হেফাজত গঠিত হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য। যেহেতু তা করা হচ্ছে না, তাই আমি হেফাজত থেকে ইস্তফা দিয়েছি।’ আর ইসলামী ঐক্যজোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইসলামী ঐক্যজোটে আমি গেছি মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর আহবানে এবং দলের সভায়ও শরীক হয়েছি। তিনি বয়সে আমার ছোট হলেও মানুষটি সাহসী, হকের উপর জানবাজ। দ্বীনের জন্য নি:স্বার্থবান মুজাহিদ ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষবাদের সাথে আপোষহীন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাই তার সাথে আমি কাজ করেছি। পরে তিনি ইন্তিকাল করেছেন। তারপরও পূর্বের ন্যায় আমি ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে ছিলাম। কিন্তু দেখছি পরবর্তী নেতৃত্ব তার আদর্শের উপর স্থিত নেই। যেহেতু আমার বয়স হয়ে গেছে; সেহেতু আমার পক্ষে ওখানে (ঢাকায়) গিয়ে তার অভাব-অনুপস্থিতির ঘাটতি পূরণ করাও সম্ভবপর হচ্ছে না। সে রকম সুযোগও নেই। এ কারণে আমি ইসলামী ঐক্যজোট থেকেও ইস্তফা দিয়ে ফেলছি।’ বর্ষিয়ান এ আলেমেদ্বীন বলেন, ‘হাইয়াতুল উলিয়া ও বেফাকুল মাদারিসের কর্মকান্ড দেওবন্দের নীতি বিরোধী। তাই এ ব্যাপারেও আমার আপত্তি ছিল এবং এখনো আছে। এতে করে কওমী আলেমদের শিক্ষার মান অধপতনে যেতে পারে। এ বিষয়টি ওলামায়ে কেরামের গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত।’ এই হলো মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সাহস। কোনো লুকোচুরি নেই, মনে ভয় নেই, সত্য উচ্চারণে শংকা নেই। মনে আসছে, বলেছেন এবং এখনও বলছেন। তিনি শোকরানা মাহফিলে আসেননি, স্বীকৃতির প্রতিবাদের নিজের মাদরাসাকে বেফাক থেকে প্রত্যাহার করেছেন। আর আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া তরুণরা অপদার্থের মতো বলছেন, ‘হেফাজতে ইসলামের আমিরের বয়স হয়ে গেছে, বর্তমানে তিনি নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।’ কথাগুলো যারা বলছেন, ‘তাদের কাছে জানতে চাই, আপনার আর হেফাজত আমিরের গত সাত দিন, না হলে মাত্র তিন দিনের কাজের রুটিন প্রকাশ করুন। দেখি, কে এখনও সতেজ, কাজে-কর্মে সবল; কথাবার্তায় শতভাগ ফিট।’ মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী আমাদের আলোকবর্তিকা। শুধু কওমি মাদরাসা নয়, এই সমাজের, ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর- লেখাপড়া, ধর্মীয় জাগরণ, স্বকীয়তা, ঈমান-আকিদা রক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন উঠলেই এখন প্রথমে অকুণ্ঠচিত্তে উচ্চারিত হয় মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর নাম। আওয়ামী আমলে তিনি ছিলেন এক নির্ভীক প্রাণ, আর এখন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ধর্মের আলোয় আলোকিত করার, জাতিকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তার এই ইচ্ছার প্রতিফলিত রূপই আমরা দেখতে পাচ্ছি। যা অনেকের মনে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে, সংঘবদ্ধভাবে তাকে নানাভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, সমালোচনা করা হচ্ছে। এসব কাঁটাকে মাওলানা বাবুনগরী থোরাই কেয়ার করেন। মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী আলেমদের মাথা উঁচু করে বাঁচানোর মিশন নিয়ে বৃদ্ধ বয়সে ছুটছেন। ক্ষমতার দেয়াল আর চেয়ারে তার বড় অনীহা। এগুলো তার জন্য কল্পনাতীত। সম্পর্কের প্রতিবন্ধকতাও তার সত্যভাষণের কাছে ম্রিয়মান। ভেতরে ভেতরে তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে আছেন, সেই তৃষ্ণা ঈমান রক্ষার, ইসলাম রক্ষার ও দেওবন্দিয়াত চর্চার। দেশের সর্বস্তরের আলেম-উলামার মুক্তি ও জাগরণ তার স্বপ্ন। তিনিই এখন আলেমদের রাজনৈতিক গুটি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। অভাবনীয় আর্থিক লোভ তাকে কাবু করতে পারেনি। তিনি তার সমস্ত শক্তি ও জীবন দিয়ে আলেমদের রাজনীতির ক্ষেত্রে এখনও দিশা দিয়ে যাচ্ছেন। এনএইচ/ |